আসিফ আরসালান

গত শুক্রবার ২১ মার্চ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিগন্তে অকস্মাৎ ঘন কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। আমি সাধারণত দৈনিক ৮টি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক পড়ি। এগুলো পড়তে পড়তেই আমার প্রায় দুপুর ১টা বেজে যায়। এরপর গোসল। রমযানের দিন না হলে দুপুরের খাওয়া খেয়ে কম্পিউটারে বসি। আর রমযান মাসে কিছুটা রেস্ট নিয়ে বিকাল ৩টার দিকে কম্পিউটার নিয়ে বসি। কম্পিউটারে আমি প্রথমে ইমেইল চেক করি। এরপর ইউটিউব ও ফেসবুকে দেখি, কোনো লেটেস্ট খবর আছে কিনা। এরপর আবার দেশের ও বিদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকার অনলাইন এডিশন চেক করি। এভাবে সর্বশেষ খবর পাওয়ার পর আমি লিখতে বসি। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে লেখা শুরু করতে করতে অনেক সময় সন্ধ্যা হয়ে যায়।

যথারীতি ২১ মার্চেও (শুক্রবার) খবরের কাগজ নিয়ে বসি। আধাঘন্টার ভেতরেই একটি ফোন পাই। বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা এবং বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর ভেরিফায়েড ফেসবুকে ওর স্ট্যাটাসটি পড়ুন। যথারীতি পত্রিকা পড়া বাদ দিয়ে কম্পিউটারে বসলাম এবং হাসনাতের স্ট্যাটাসটি পড়লাম। পড়ার পর, সত্যি বলতে কী, একেবারে বাকরুদ্ধ এবং স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হাসনাতের স্ট্যাটাসের শিরোনাম দিয়েছে একটি জাতীয় বাংলা দৈনিক এভাবে, “এই পোস্ট দেওয়ার পর আমার কি হবে জানি না’, ভারতের পরিকল্পনায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আ’লীগকে ফেরানোর ষড়যন্ত্র: যে ভয়ঙ্কর তথ্য দিলেন হাসনাত”।

সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ, আজকে আমি নিজে কোনো মন্তব্য করবো না। অথবা নিজ থেকেও বেশি কথা লিখবো না। আজকে বেশিরভাগই আমি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ থেকে উদ্ধৃত করবো। প্রথমে দেখুন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার স্ট্যাটাস। কিভাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ড. ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে প্রচণ্ড বাধা এসেছিল। সে তথ্য ফাঁস করেছেন সজীব ভূঁইয়া। সজীব ভূঁইয়া লিখেছেন, “সেনাপ্রধানের দিক থেকে মূল ভেটো ছিল, ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন? কেন অন্য কোনো ব্যক্তি নয়? ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে মামলা আছে। তিনি একজন কনভিক্টেড ব্যক্তি। একজন কনভিক্টেড ব্যক্তি কিভাবে একটা দেশের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। আওয়ামী লীগ একজন লোককে একেবারেই দেখতে পারছে না। এছাড়া বাংলাদেশে ৩০-৪০ শতাংশ ব্যক্তি আওয়ামী লীগ সাপোর্ট করে। এ ৩০-৪০ শতাংশ ব্যক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে একজন ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করা উচিত? সেনাপ্রধান লাস্ট আমাদেরকে বলেছিলেন যে আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে এ সিদ্ধান্তটা মেনে নিচ্ছি।”

হাসনাত আব্দুল্লাহ সজীব ভূঁইয়ার আগেই একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। ঐ পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেছেন, “১১ই মার্চ, সময় দুপুর ২:৩০। কিছুদিন আগে আমি আপনাদের বলেছিলাম যে, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরিন শারমিন, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। আমিসহ আরও দুইজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ই মার্চ দুপুর ২:৩০এ। আমাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদেরকে বলা হয়- ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে-তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। আমাদেরকে আরো বলা হয়-রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।

আমাদেরকে এই প্রস্তাব দেওয়া হলে আমরা তৎক্ষণাৎ এর বিরোধিতা করি এবং জানাই যে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করুন। এর উত্তরে আমাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে কোন ধরনের বাধা দিলে দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে এবং ‘আওয়ামী লীগ মাস্ট কাম ব্যাক’।

আলোচনার এক পর্যায় বলি-যেই দল এখনো ক্ষমা চায় নাই, অপরাধ স্বীকার করে নাই, সেই দলকে আপনারা কিভাবে ক্ষমা করে দিবেন! অপরপক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে, ‘ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম এন্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর এটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। তোমার বয়সের থেকে বেশি। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া ‘ইনক্লুসিভ’ ইলেকশন হবে না।’

উত্তরে বলি, ‘আওয়ামী লীগের সাথে কোন ইনক্লুসিভিটি হতে পারে না। আওয়ামী লীগকে ফেরাতে হলে আমাদের লাশের উপর দিয়ে ফেরাতে হবে। আওয়ামী লীগ ফেরানোর চেষ্টা করা হলে যে সংকট তৈরি হবে, তার দায়ভার আপনাদের নিতে হবে’।

মিটিং অসমাপ্ত রেখেই আমাদের চলে আসতে হয়। আজকেও ক্যান্টনমেন্টের চাপকে অস্বীকার করে আমি আবারও আপনাদের উপরেই ভরসা রাখতে চাই। এ পোস্ট দেওয়ার পর আমার কী হবে আমি জানি না। নানামুখী প্রেশারে আমাকে হয়তো পড়তে হবে হয়তো বিপদেও পড়তে হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোন ধরনের আপস করার সুযোগ নাই। জুলাইয়ের দিনগুলোতে জনগণের স্রোতে ক্যান্টনমেন্ট আর এজেন্সির সকল প্রেসক্রিপশন আমরা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আজ আবারও যদি আপনাদের সমর্থন পাই, রাজপথে আপনাদের পাশে পাই তবে আবারও এই আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের ভারতীয় ষড়যন্ত্রও আমরা উড়িয়ে দিতে পারবো।”

॥ দুই ॥

২১ জুন শুক্রবারের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর সচেতন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। খবরটির শিরোনাম, “আ’লীগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা নেই, নির্বাচনের তারিখ পেছাবে না: প্রধান উপদেষ্টা”। খবরে বলা হয়, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কোনও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভোট বিলম্বিত না করে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার করেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘দলটিকে নিষিদ্ধ করার কোনও পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তবে দলটির নেতৃত্বের মধ্যে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দেশের আদালতে বিচার করা হবে।’ বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) ড. কমফোর্ট ইরোর নেতৃত্বে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।”

খবরটি পড়ে আমার একটি খটকা লাগে। হঠাৎ করে প্রধান উপদেষ্টা আওয়ামী লীগ সম্পর্কে এমন কথা বলতে গেলেন কেন? আসলে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে একটি প্রেক্ষাপট থাকে। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপট কী? হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল। গত ১৯ মার্চ বুধবার সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বলা হয়েছে যে, এ সাক্ষাৎকালে তিনি দেশের নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা করেন। এর পরদিন অর্থাৎ ২০ মার্চ বৃহস্পতিবার ড. ইউনূস বলেন যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে না। একটির সাথে আরেকটিকে অনেকে মিলাবার চেষ্টা করেছেন।

এর মধ্যে এসে গেল সজীব ভূঁইয়া ও হাসনাত আব্দুল্লাহর স্ট্যাটাস। তার কিছুক্ষণ পর অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের একটি বিবৃতি। বিবৃতির শিরোনাম, “আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন জনগণ মেনে নেবে না: ডা. শফিকুর রহমান”। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “জামায়াতের আমীর লিখেছেন, বাংলাদেশ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক অতিক্রম করছে। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের পর ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই একটি নতুন বাংলাদেশ মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে উপহার হিসেবে পেয়েছে জাতি। এ জন্য মহান রবের দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া। এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পতিত ফ্যাসিবাদীরা দেশের ভেতরে-বাইরে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে মন্তব্য করেন শফিকুর রহমান। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের নির্যাতিত ১৮ কোটি মানুষের দাবি হলো, গণহত্যাকারীদের বিচার। চব্বিশের শহীদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসন। আহত-পঙ্গু অসংখ্য ছাত্র-তরুণ-যুবক-মুক্তিকামী মানুষের সুচিকিৎসা। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ১৫ বছরের সৃষ্ট জঞ্জালগুলোর মৌলিক সংস্কার সাধন করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। জামায়াতের আমীর আরও লেখেন, এ সময় জনগণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গণহত্যার বিচার দেখতে চায়। এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই।”

॥ তিন ॥

রাজনৈতিক দৃশ্যপট সুস্পষ্টভাবে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করতে চায় তারা একটি ভাগ। আরেকটি ভাগ হলো, এনসিপি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রাজনীতির স্বাভাবিক গতিধারায় দু’তিন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা ২৪ ঘন্টার মধ্যে সকলকে আবার এক কাতারে শামিল করেছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মূখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ফেসবুকে বলেছেন, লড়াইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের জন্য আমরা প্রস্তুত। গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ পর্যন্ত এ লড়াই চলবে। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম শুক্রবার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের অপচেষ্টা রুখে দিতে ছাত্র-জনতা আবারও প্রস্তুত। রক্তের দাগ শুকায়নি। এ রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আমার ভাইয়ের খুনিদের ফেরানোর কোন চেষ্টা আমরা সফল হতে দিবো না।

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সমন্বয়ক ও চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক হান্নান মাসউদ তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে বলেন, জলপাই রঙ কিংবা ইন্ডিয়া যারাই আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের চেষ্টা করবে, তা জুলাইয়ের মতোই প্রতিহত করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদের যারা তাদের এ এজেন্ডায় সায় দিবে তারা উপদেষ্টা থাকার নৈতিক অধিকার হারাবে। ধীরে ধীরে সব প্রকাশ করা হবে....

জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, আমি বিএনপি, জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই। ছাত্র-জনতা আবারও প্রস্তুত আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের অপচেষ্টা রুখে দিতে। জাতীয় নাগরিক কমিটির সাবেক যুগ্ম সদস্যসচিব রাফে সালমান রিফাত ফেসবুকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ প্রশ্নে জুলাইকে ফিরিয়ে আনা আবশ্যক। অন্যথায় লাভ নাই।

এ লেখাটি লিখছি শুক্রবার সন্ধ্যায়। আজ রোববার। আমার সুদীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক বিশ্লেষণী অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনৈতিক দিগন্তে ঘনকালো মেঘ জমেছে। এটি একটি বড় ঝড়ের পূর্বাভাস। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর দেখা যাক, কী ঘটে। ততক্ষণ আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

Email: [email protected]