এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী
মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ এবং জীবনদর্শনকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের কোন মডেলই সত্যিকার অর্থে কোন জাতিকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে পারে না, এটা বাস্তবসম্মত নয়। [মাইকেল পি টডারো-Economic Development in the Third world]
মনে রাখতে হবে-রাষ্ট্র সংস্কার কোন পেইড এনজিও বাদী কর্মকাণ্ড নয়। সংস্কারের নামে পশ্চিমা মূল্যবোধ ও কৃষ্টিকালচার চাপিয়ে দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ হতে পারে না। গত ১৯ এপ্রিল সরকার গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা আনয়নের লক্ষ্যে ১৭ টি অধ্যায়ের ৪৩৩ টি সুপারিশ সম্বলিত ১৯৬ পৃষ্ঠা ও সংযুক্তিসহ মোট ৩১৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশ করেছেন।
কমিশনের দীর্ঘ সংস্কার প্রস্তাবে যেসব সুপারিশ সন্নিবেশিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে উত্তরাধিকার আইনে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, কৃষি ও মৎস্য খাতে নারীদের স্বীকৃতি প্রদান এবং যথাযথ পারিশ্রমিকের ব্যবস্থাকরণ, বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মুসলিম আইনের পরিবর্তে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের প্রবর্তন, যৌনকর্মী তথা গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত মেয়েদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি প্রদানসহ, সংসদে নারী আসন ৩০০ বৃদ্ধি ইত্যাদি। অন্যান্য কমিশনের সঙ্গে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের পার্থক্য হলো, অন্য কমিশনগুলো মূলত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য গঠিত হয়েছে। আর নারী কমিশন মূলত নারীদের জীবন ও জীবিকা-সংক্রান্ত নানা বিষয় উন্নয়নের জন্য গঠিত। তাই এ কমিশনের সুপারিশগুলো হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাস্তবায়নযোগ্য এবং অধিকাংশ মানুষের কালচারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শুধুমাত্র প্রতিবেদন তৈরি ও সুপারিশ উপস্থাপনই মূল বিষয় নয়, বরং তা সমাজের সকল শ্রেণীর কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য, যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়া নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, এ প্রতিবেদনের আদ্যোপান্ত-এটার যে মূল ভিত্তি সেটা ইসলামের শাশ্বত বিধান আল্লাহর কুরআনের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষিক। শুধু সংঘর্ষিকই নয়; বরং কুরআনকে কটাক্ষকারী প্রস্তাবনা। এর মধ্যে যে সব বিষয় নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে-
১. ধর্মকে নারীর বৈষম্যের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে।
২. অভিন্ন পারিবারিক আইনের (Uniform family code) মাধ্যমে সব ধর্মের নারীকে সমান অধিকার প্রদান।
৩. উত্তরাধিকার আইনে সমান অধিকার দাবি করেছে।
৪. শ্রম আইনে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সুপারিশ।
৫. হালাল বৈবাহিক সম্পর্কে আপত্তিকর ধর্ষণ (Merital Rappe) শব্দটির ব্যবহার ও স্বামীর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করার সুযোগ চাওয়া
৬. সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে নারীদের জন্য ৩০০ আসন কোটার সুপারিশ-
৭. বিবাহ-শাদীসহ পারিবারিক বিষয়ে জাতিসংঘ প্রণীত আইন বাস্তবায়ন (এটি মূলত ঈঊউঅড সনদ হিসেবে পরিচিত)
৮. সর্বোপরি নারী-পুরুষ উভয়কে পরস্পর পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন।
৯. পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষার নামে ছেলে-মেয়ে উভয়ের সম্মতিতে যৌনতাকে উসকে দিয়ে পাশবিক সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টা।
১০. বিবাহ বিচ্ছেদের সময় ৫০% সম্পদ স্ত্রীকে প্রদান করার সুপারিশের মাধ্যমে বিয়েকে কঠিন এ ব্যাভিচারকে সহজ করার নীল নকশা রয়েছে এ সুপারিশে।
১১. সন্তানের বংশপরিচয়ের ক্ষেত্রে পৈত্রিক পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। অভিভাকত্বের ক্ষেত্রে আল কুরআনের আইনের বাইরে গিয়ে সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে।
১২. “রাষ্ট্র হচ্ছে ইহজাগতিক” বলে মন্তব্য করে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
১৩. সংবিধান থেকে “শালীনতা ও নৈতিকতা” শব্দটি বাদ দেবার সুপারিশ করে অশ্লীল ও পাশবিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে।
১৪. মৃত্যুদণ্ড শব্দটিকে সংবিধানে সংযুক্ত করে মৃত্যুদণ্ডকে রহিত করার প্রস্তাব দিয়েছে যা ইসলাম বিরোধী ও স্ববিরোধী।
১৫. এ প্রতিবেদনে মাতৃত্ব ও নারীত্বের মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। পুরো প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়েছে বিশেষ কোন শ্রেণীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছে এই কমিশন। আরো মনে হয় তারা একটি নারী রাষ্ট্র বানাতে চায়। যেখানে নারীই সব! গুটিকয়েক বাদে অধিকাংশ সুপারিশগুলো এদেশের মানুষের নৈতিকতা ধ্বংসের নীল নকশা। মুসলিম সমাজের পরিবার ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে সমাজে ব্যাভিচার ছড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। প্রস্তাবনার সার কথা-পরিবারবিহীন সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করা এবং সমকামিতার বৈধতা দেবার পরিবেশ সৃষ্টি করা। যৌন কর্মে উৎসাহিত করে পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা এ পৃষ্ঠপোষকতা দেবার সুপারিশ করে গোটা নারী সমাজকে অপমানিত ও লজ্জ্বিত করা হয়েছে। প্রস্তাবে উত্তরাধিকার আইনে তারা সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশের প্রস্তাবনা দিয়েছে। সমাজব্যবস্থায় সম্পদের অংশ পাওয়ার সঙ্গে আরও অনেকগুলো বিষয় ও দায়িত্ব সম্পৃক্ত। খরচের দায়িত্ব, ভরপোষণের দায়দায়িত্ব-এসব বিষয়গুলোর আলোকে সম্পদের মালিকানা নির্ধারণ হবে। এ ক্ষেত্রে কমিশন একদেশদর্শী নীতি অবলম্বন করেছে।
তাছাড়া উত্তরাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলা আছে, কীভাবে তা বণ্টিত হবে। কাজেই এভাবে কুরআনের বিধানকে পরিবর্তন করার প্রস্তাবনা ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না।
সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য অভিন্ন বিবাহ আইনের (Uniform family code) “প্রস্তাব সকল ধর্মের জন্য অগ্রহণযোগ্য। বিয়ে একটি ধর্মীয় বিষয়। এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারণযোগ্য নয়। ইসলামে বিবাহ ও তালাকের ব্যাপারে কুরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সিডো সনদের উপর সংরক্ষণ প্রত্যাহারের দাবি বিগত স্বৈরাচারী সরকারও যেটা করতে সাহস করতে পারেনি। সেখানে বিবাহ-শাদীসহ পারিবারিক বিষয়ে জাতিসংঘ প্রণীত আইন বাস্তবায়ন (এটি মূলত CEDAW সনদ হিসেবে পরিচিত) (গর্ভপাতকে বৈধতাদান ও অভিন্ন পারিবারিক আইনের বাস্তবায়ন)
সংসদে ৬০০ আসনের মধ্যে নারী কোটায় ৩০০ দাবি করা হয়েছে। নারীদের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে তাদের স্ববিরোধিতা ও দ্বৈত নীতির সুর দেখা যাচ্ছে। একদিকে নারীর সংরক্ষিত আসনের ব্যাপারে সমর্থন দিচ্ছে অপরদিকে সরাসরি নির্বাচনের ব্যাপারেও মতামত প্রদান করা হয়েছে।
অন্যায় অযৌক্তিক দাবি সম্বলিত ও স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন এর সুপারিশ কোন নির্বাচিত সরকার এর পক্ষে পাশ করা সম্ভব নয়। তাই তারা তত্ত্বাবধায়ক সময় গুলোকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগায়। বিগত ২০০৮ সালে মঈনউদ্দীন ফখরুদ্দীন সরকারের ঘাড়ে ভর করে তারা বিতর্কিত নারী নীতি পাশ করিয়ে নিয়েছিল। এখন আবার তারা পূর্বের মত বিতর্কিত নারী সংস্কার প্রতিবেদন পাশ করিয়ে নেবার চক্রান্ত করেছে। এ ব্যাপারে তত্ত্ববাবধায়ক সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে এবং নারী বিষয়ক কমিশনের প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যান করা এবং এই কমিশন বাতিল করা এখন সময়ের দাবি, প্রতিটি সচেতন মানুষের দাবি। এই কমিশন বাতিল করে একটি ইনক্লুসিভ কমিশন গঠন করা হোক, সেখানে সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নারী পুরুষের সমন্বয়ে, এদেশের মাটি এ মানুষের কৃষ্টি কালচার ও ধর্মীয় রীতি নীতির উপর ভিত্তি করে নারী বান্ধব গ্রহনযোগ্য সুপারিশমালা প্রনীত হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে জনগন এটাই প্রত্যাশা করে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, মাসুক (মানবাধিকার ও আইনী সুরক্ষা কেন্দ্র)