আর্শিনা ফেরদৌস

আমাদের সমাজ পরিবারকেন্দ্রিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক। তাই নারীর শালীনতা ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা প্রায়ই সামনে আসে। তবে শালীনতা মানে কেবল পোশাকের সীমা নয়; এটি আত্মসম্মান, মানবিকতা ও সামাজিক ভারসাম্যের বহিঃপ্রকাশ। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে নারীর স্বাধীনতা ও শালীনতা একে অপরের পরিপূরক হতে পারে এবং এক্ষেত্রে সমাজের দায়িত্ব কোথায়?

দর্শনের আলোকে শালীনতা : প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘নিজেকে জানো, তাহলেই সত্যিকারের জ্ঞান লাভ হবে।’ শালীনতা আসলে আত্মজ্ঞান ও আত্মসম্মানের একটি রূপ। দর্শনের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা সীমাহীন ভোগ বা অবাধ বিচরণ নয়; বরং দায়িত্বশীলতা ও সংযমের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা আসে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘মধ্যপন্থাই হলো শ্রেষ্ঠ পথ।’ এ কথার মর্মার্থ হলো, অতিরিক্ত উন্মুক্ততা যেমন বিভ্রান্তি তৈরি করে, তেমনি অতিরিক্ত রক্ষণশীলতাও মানবিক বিকাশকে থামিয়ে দেয়। শালীনতা তাই মূলত এক ধরনের ভারসাম্য, যেখানে নারী নিজেকে রক্ষা করে, আবার সমাজের মর্যাদাও অক্ষুণ্ন রাখে।

মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিতে : মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, ‘মানুষের আচরণ পরিবার ও সমাজের অবচেতন প্রভাবে গড়ে ওঠে। একটি পরিবার যদি মেয়েকে শালীনতার শিক্ষা দেয়, তবে সেটি তার অবচেতনে নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, যারা হঠাৎ সামাজিক বা পারিবারিক শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তারা বিভ্রান্তি ও মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। তাই সমাজ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে ভারসাম্য ফিরতে পারে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানও বলছে, শালীনতা আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক; এটি মানসিক সুস্থতা ও সামাজিক মর্যাদাকে রক্ষা করে।

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী : শালীনতা কেবল একটি সংস্কৃতি নয়; বরং প্রায় সব ধর্মেই এটি একটি মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পবিত্র কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘হে নবী! মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন দৃষ্টি অবনত করে, লজ্জাস্থান হেফাজত করে এবং তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে’ (সূরা আন-নূর ২৪:৩১)। এখানে শালীনতা শুধু বাহ্যিক পোশাকে সীমাবদ্ধ নয়; বরং অন্তরের পবিত্রতাও এর অংশ।

হিন্দু ধর্ম : ‘মনুস্মৃতি’-তে উল্লেখ আছে, ‘নারীর আসল অলঙ্কার হলো তার লজ্জা ও শালীনতা।’ এ বিশ্বাস পোশাক নয়, বরং সংযত আচরণকেই প্রকৃত সৌন্দর্য হিসেবে চিহ্নিত করে। বৌদ্ধ ধর্মের ধম্মপদে বলা হয়েছে, ‘সংযমই সর্বোত্তম আচরণ।’ অর্থাৎ আত্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো মুক্তি নেই। খ্রিস্টধর্মের বাইবেলে (১ টিমোথি ২:৯) বলা হয়েছে, ‘নারীরা যেন শালীনতা ও সংযম সহকারে পোশাকে নিজেদের সাজায়।’ খ্রিস্টীয় মূল্যবোধে শালীনতা একধরনের আধ্যাত্মিক মর্যাদা। এ প্রধান চারটি ধর্মের শিক্ষা থেকে বোঝা যায় শালীনতা একটি সর্বজনীন মূল্যবোধ, যা মানবিকতা ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ : বাংলাদেশের মতো সমাজে শালীনতা একটি সামাজিক চুক্তি। এটি পরিবারকে সুরক্ষা দেয়, নারীর মর্যাদা রক্ষা করে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে স্থিতি আনে। তবে সমাজ যদি নারীর স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে কেবল শালীনতাকে সামনে আনে, তবে ভারসাম্য নষ্ট হয়। সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুরখেইম বলেছিলেন, ‘সমাজের সুস্থতা নির্ভর করে প্রতিটি সদস্যের নৈতিক দায়িত্ব পালনের উপর।’ অর্থাৎ নারীর স্বাধীনতা ও শালীনতা উভয়ই সমাজের নৈতিক দায়িত্বের অংশ।

বাংলাদেশের বাস্তবতা : বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরা পরিবার, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে শালীন। তারা সংযত থেকে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তবে কিছু নারী যখন হঠাৎ রক্ষণশীলতা থেকে বেরিয়ে অবাধ উন্মুক্ততায় যায়, তখন বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো প্রয়োজন। শিক্ষা ও সঠিক দিকনির্দেশনা ছাড়া প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয় না।

উপসংহার : শালীনতা ও স্বাধীনতা একে অপরের বিপরীত নয়; বরং পরষ্পর পরিপূরক। শালীনতা নারীর আত্মমর্যাদা রক্ষা করে, আর স্বাধীনতা তার সম্ভাবনাকে বিকশিত করে। সমাজের দায়িত্ব হলো এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে নারীকে তার পোশাক বা বাহ্যিক রূপ দিয়ে বিচার না করে তার জ্ঞান, অবদান ও মানবিক মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

দর্শন শেখায় : ‘ভারসাম্য ছাড়া স্বাধীনতা বিশৃঙ্খলা, আর সংযম ছাড়া স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ।’ ধর্ম শেখায়: শালীনতা মানবতার সৌন্দর্যকে রক্ষা করে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, শালীনতা নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সহমর্মিতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক ভারসাম্যপূর্ণ নারীর উপর যিনি হবেন শালীন, স্বাধীন ও মানবিক।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।