॥ আরমীন আমীন ঐশী ॥
শহরের প্রতিটি সকাল যেন এক যুদ্ধের আহ্বান। কাঁধে ব্যাগ, চোখে স্বপ্ন নিয়ে তরুণরা ছুটছে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ধরতে, কেউ চাকরির ইন্টারভিউতে, কেউ ক্ষুদ্র বা বৃহৎ ব্যবসার কাজে। কিন্তু এ ছুটে চলা যেন বারবার থেমে যায় ইট-পাথরের শহরের শেকল, ট্রাফিক জ্যামে। শুধু মানুষই নয়; স্বপ্ন, সময় আর সম্ভাবনাও ‘ট্রাফিক জ্যামে’ আটকে থাকে।
একজন তরুণ দিনের শুরুতে ঠিক করে নেয় আজ সে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাবে, নতুন কিছু শিখবে, কিছু করবে। কিন্তু শহরের অলিগলিতে থাকা জ্যাম তাদের সে পথ বন্ধ করে দেয়। ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মিনিট যেন তার জীবনের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনার মতো বড় শহরগুলোতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যানজট। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে সে সাথে বাড়ছে যানবাহনও। ফলে রাস্তায় চলাচলের জটিলতা বাড়ছেই। যারা প্রতিদিন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র বা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের স্বপ্ন পূরণে ছুটছে তাদের জন্য এ যানজট নির্মম বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫% তরুণ। তরুণেরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে, দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে। কিন্তু তারাই প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তাদের মূল্যবান সময় হারাচ্ছে। ঢাকায় সাধারণত একজন মানুষ প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা সময় হারায় ট্রাফিক জ্যামে। বছরে প্রায় ১০৯৫ ঘণ্টা বা ৪৫ দিন। এ বিশাল সময়ের ক্ষয় শিক্ষার্থী আর কর্মজীবীদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।
যানজটের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে ফলে তরুণ সমাজকে অনেক বেশি ভুগতে হয়। বাংলাদেশের শহরগুলোতে নগরায়ণের সময় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব লক্ষ্য করা যায়। নতুন ভবন, মার্কেট, স্কুল কলেজ গড়ে উঠেছে কিন্তু সেসবের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে না। ঢাকাসহ অনেক শহরেই গণপরিবহনের সংকট রয়েছে, আর যেগুলো রয়েছে তা অনিয়মিত, অনিরাপদ। ফলে তরুণরা সময়মতো বাস না পেয়ে রিকশা বা ব্যক্তিগত যান ব্যবহার করে, যা যানজট আরও বাড়ায়। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম সে সাথে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নেই বললেই চলে। সিগনাল বাতি প্রায় সময়ই অকার্যকর থাকে। ফলে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বিত্তশালী পারিবারগুলো তাদের সন্তানদের জন্য প্রাইভেট গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়, এতে সড়কে ব্যক্তিগত যানবাহনের চাপ পড়ে। আবার রাস্তার পাশে দোকান, ফুটপাত, ভ্যান রিকশার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য চলাচলের রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে।
যানজট সমস্যার সমাধান করা খুব সহজ কাজ নয়, তবে কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তরুণদের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও মুক্ত করা সম্ভব। নিরাপদ, নিয়মিত ও তরুণবান্ধব গণপরিবহন চালু করা গেলে তরুণরা ব্যক্তিগত যানবাহনের ওপর নির্ভরতা কমাবে। এর একটি বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে ঢাকা মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ। স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম, সিগনাল কন্ট্রোল প্রযুক্তি, সিসি ক্যামেরা, রিয়েল টাইম ট্রাফিক আপডেট অ্যাপ চালু করতে পারলে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি একই সময়ে ক্লাস শুরু করে তাহলে নির্দিষ্ট সময়ে যানবাহনের ওপর চাপ পড়ে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময় কিছুটা পরিবর্তন করে দিলে একই সময়ে যানবাহনের ওপর এতটা চাপ পড়বে না। যারা প্রযুক্তিনির্ভর পেশায় আছেন তাদের আংশিক সময় বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ করে দিলে অফিসে যাতায়াতের সময় বাঁচাতে পারবেন। তরুণরা যদি ট্রাফিক আইন মানে, গাড়ি শেয়ার করে, হেঁটে চলাফেরা বা সাইকেল ব্যবহার করে তাহলে একটি বড় পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের মেধা, সময় ও স্বপ্নের যথাযথ ব্যবহারের ওপর জাতির অগ্রগতি নির্ধারিত হয়। কিন্তু যখন প্রতিদিন তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকে তখন তাদের সেই স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে মলিন হয়ে পড়ে।
এ অনিয়ন্ত্রিত সিস্টেমের কারণে তরুণদের যে মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, রাষ্ট্রের উচিত এ সমস্যাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। যানজট শুধু ট্রাফিক ইস্যু নয়, এটি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, মানবিক স্বাস্থ্য আর জাতীয় উৎপাদনশীলতার বিষয়। আমাদের প্রয়োজন পরিকল্পিত ও তরুণবান্ধব শহর ব্যবস্থাপনা করা। এর জন্য দরকার মানসিকতা এবং নীতির পরিবর্তন। সময় এখনই, ট্রাফিক জ্যামে নয়, তরুণদের স্বপ্ন এগিয়ে যাক নতুন গন্তব্যে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।