জাতি, ধর্ম, গোত্র ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ বিশ্বের এক অনন্য সাধারণ দেশ। মূলত, বোধ-বিশ্বাস ও আদর্শের এক অপূর্ব সমন্বয়ই আমাদের দেশকে স্বকীয়তা দিয়েছে। যা গোটা বিশ্বেই এক রোল মডেল। মূলত, আমাদের দেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট কিন্তু জনবহুল রাষ্ট্র। ভূখণ্ডের জনসংখ্যার অধিকাংশ হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহৎ নৃগোষ্ঠী বাঙালি। এছাড়া অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীও রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার ৪৭৮ জন; সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় এক শতাংশের মতো (০.৯৯%)। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলে বসবাস করে। এদের মধ্যে রয়েছে গারো, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খেয়াং, চাক, বম, লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মনিপুরী, হদি ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের অধিকার নিশ্চিত করণের জন্য আমাদের সংবিধানে সুরক্ষাও দেয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ (ক) তে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

বাংলাদেশের প্রধান ও বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠী হলো বাঙালি জাতিগোষ্ঠী। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতে (পশ্চিমবঙ্গে) অনেক বাঙালি বসবাস করে। বাঙালি জাতি কয়েকটি উপভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশে বাঙালিরা প্রধানত ঢাকাইয়া, সিলেটি, চাঁটগাইয়া, নোয়াখালিয়া, বরিশালিয়া, রংপুরি ইত্যাদি কয়েকভাগে বিভক্ত।

বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছে মৌলিকভাবে আর্য জাতিগোষ্ঠী থেকে। তাই বাঙালি জাতিকে ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বাংলা ভাষাকে ইন্দো-আর্য ভাষা-পরিবারের একটি ভাষা হিসেবে অভিহিত করা হয়। যদিও বাঙালি নৃগোষ্ঠী শংকর জাতিগোষ্ঠী হিসেবেও অধিক পরিচিত। এজন্য বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যেমন অস্ট্রিক, দ্রাবিড়দের বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করা যায়। এবং ভাষার ব্যবহারেও ইন্দো-আর্য ভাষা বাদেও বাংলা ভাষায় অস্ট্রিক ভাষা এবং দ্রাবিড় ভাষার উপস্থিতি লক্ষণীয়।

বাংলাদেশের এ ভূখণ্ডে (পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ) আদিকাল থেকে মূলত বাঙালি নৃগোষ্ঠীর বৃহৎ পরিসরে বসবাস বিদ্যমান ছিল। তবে বাঙালি নৃগোষ্ঠীর উদ্ভবের আগে এ বাংলা অঞ্চলে বিভিন্ন আদিবাসীর বসবাস ছিল। এ বাংলা অঞ্চলে আর্যদের আগমনের পূর্বে অনার্য বা আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীগুলো যেমন-নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠী।

বাংলা অঞ্চলে প্রথম মানবগোষ্ঠী হিসেবে আগমন ঘটেছিল নেগ্রিটোদের। এরপর অস্ট্রিক নরগোষ্ঠী এসে নেগ্রিটোদের পরাজিত করে এখানে বসতি স্থাপন করে। এক সময় অস্ট্রিকদের সংখ্যাধিক্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তির ফলে নেগ্রিটোরা ক্রমশ এ অঞ্চল থেকে বিলীন হয়ে যায়। এরপর আগমন ঘটে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর। দ্রাবিড়রা অস্ট্রিকদের সাথে লড়াই করে বাংলা অঞ্চলে বসতি গড়তে সমর্থ হয়। দ্রাবিড়দের আগমনের পর মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয়দের আগমন ঘটেছিল এ অঞ্চলে। অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের সাথে শক্তি ও সামর্থ্যে টিকে থাকতে না পেরে মঙ্গোলীয়রা এ অঞ্চল পরিত্যাগ করে। এরপরেই পুরো ভারতবর্ষসহ এ বাংলা অঞ্চলে আর্যদের আগমন ঘটে। পরবর্তীতে আর্য, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এসব নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙালি নৃগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়।

বাংলাদেশের প্রথম উপজাতি হলো এ অস্ট্রালয়েড বা অস্ট্রিক নরগোষ্ঠীর মানুষেরা। বর্তমানে বাংলাদেশের সাঁওতাল, কোল, ভূমিজ, মুন্ডা, বাঁশফোড়, মালপাহাড়ি, পুলিন্দ, শবর ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ হলো এই অস্ট্রিক নরগোষ্ঠী। অর্থাৎ এরাই অস্ট্রিক নরগোষ্ঠীভুক্ত বাংলা অঞ্চলের প্রাচীনতম উপজাতি। এছাড়া এ অঞ্চলে অস্ট্রিকদের পরে আসা দ্রাবিড়দের বর্তমানে তেমন কোনো উত্তরপুরুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতে এদের অধিক হারে বসবাস রয়েছে। ভারতের নিকটতম দেশের বিচারে এদের দেখা যায় মূলত শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তানে। তেলুগু, তামিল, কন্নড়, মালায়ালম, ব্রাহুই ইত্যাদি ভাষাতাত্ত্বিক পূর্বপুরুষ হলো দ্রাবিড়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়াতে তামিলদের একটি বড় অংশ বসবাস করে। বাংলাদেশের দ্রাবিড়রা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে। এ বিচারে বিশুদ্ধ দ্রাবিড় বাংলাদেশে ততটা দেখা যায় না। তবে পাহাড়িয়া, ওরাওঁ এ দুইটি জাতিগোষ্ঠী এখনও দ্রাবিড় থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ দ্রাবিড় নৃগোষ্ঠীভুক্ত এ দু’টি জাতিগোষ্ঠী এদেশের প্রাচীন উপজাতি হিসেবে বিবেচিত। এরা মূলত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসাবেই স্বীকৃত। যদিও পক্ষ বিশেষ এদেরকে আদিবাসী বলতে চান। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনায় সে দাবির কোন ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।

মূলত, সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীই নিজস্ব স্বাতন্ত্র ও বৈর্শিষ্ট্যের অধিকারী। এদের রয়েছে নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনেও তাদের আদিম সংস্কৃতি ও বৈচিত্রের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধু আমাদের দেশে নয় বরং বিশ্বের সকল দেশেই এদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। আর এদের জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বৈচিত্রময় করে তুলেছে। তবে ঔপনিবেশিক শাসনামলে রাজনৈতিকভাবে এদেশে ভিনদেশী সংস্কৃতির যে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তার প্রভাব সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। ঘটেছে সংস্কৃতির রূপান্তর। সাম্প্রতিক সময়ে এসব অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করার নামে পরিকল্পিতভাবে আদর্শচ্যুতির দিকেই ঠেলে দেয়া হয়েছে। এমনকি উন্নয়নের নামে ধর্মান্তরও ঘটেছে ব্যাপকভাবে। ফলে এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বিপর্যয় আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এ অশুভ বৃত্ত থেকে তারা কোনভাবেই বেড়িয়ে আসতে পারছে না।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ক্ষুদ্র জাতিস্বত্ত্বায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে এসব জাতিগোষ্ঠী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে এদের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ কোটি। মূলত, সকল নৃগোষ্ঠীই স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অধিকারী। ১৯৯১ সালের এক সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৭টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস রয়েছে। এদের নিজস্ব ফোরামের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ৪৪টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এখনও তারা মূলধারা থেকে দূরে থেকে নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি লালনের মাধ্যমে স্বকীয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যত্যয় সৃষ্টি করেছে ধর্মীয় মিশনারীগুলো।

নিকট অতীতেও এদেরকে প্রাগৈতিহাসিক জাতি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, আদিম মানুষ ও উপজাতি নামে চিহ্নিত করা হত। যদিও আন্তর্জাতিক পরিসরে এদেরকে আদিবাসী হিসাবে অভিহিত করা হলেও আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা ও তাদের অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিতর্ক ছিল এবং এখনো রয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পরেও কথিত আদিবাসীদের ব্যাপারে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোন সংজ্ঞায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। সাধারণত কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অণুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত এবং এখনও করে; যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তারাই আদিবাসী। কিন্তু আমাদের দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ও চুলচেরা বিশ্লেষণে এদেকে আদিবাসী বলার সুযোগ নেই বরং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা ক্ষুদ্রজাতিস্বত্ত্বা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ, আমাদের দেশের সংবিধানেও আদিবাসী বলে কোন জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি নেই বরং উপজাতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, এসব অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর প্রায় পাঁচ ভাগ এবং পৃর্থিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ ভাগ। এরা প্রায় ৭ হাজার ভাষায় কথা বলে এবং এদের রয়েছে প্রায় ৫ হাজার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। ঐতিহাসিকভাবে নানা শোষণ, দখলদারিত্ব, নিপীড়ন এবং বঞ্চনার ভেতর দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বাকীয়তা টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের দেশে সাঁওতাল বিদ্রোহ তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। আর এসব নৃগোষ্ঠীই আজকের পৃথিবীটাকে করে তুলেছে বহু-বৈচিত্র্যময় এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের এক সুন্দর আবাসভূমি। অথচ তারা আজও পৃথিবীর নানান দেশে নানা মাত্রায় সামাজিক, সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রান্তিকায়নের শিকার।

কথিত আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার বিশেষ করে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি অনেক রাষ্ট্রের কাছে স্বস্তিদায়ক নয়। কারণ ঐ সমস্ত দেশের জনগণের একটা বড় অংশই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (যেমন- কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত, চীন, পাপুয়া নিউগিনি এবং অধিকাংশ লাতিন আমেরিকার দেশসমূহ)। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি এ সমস্ত দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে প্ররোচিত করবে যা ঐ সব দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের এ ধারণা অনেকাংশে অমূলক বলেই মনে হয়। কারণ, এসব নৃগোষ্ঠীকে কখনোই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী মনে হয়নি। এখনও তারা মূল ধারার বাইরেই অবস্থান করছে।

আমাদের দেশের আর্ত-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এসব নৃগোষ্ঠীর জীবন-বৈচিত্র্য সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, কালের বিবর্তনসহ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ও বৈচিত্র হারাতে বসেছে। এমনকি নিজেদের ধর্মীয় বোধ ও বিশ্বাসও। রাস্তাঘাট, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি জমি বাড়াতে বনাঞ্চল উজাড় ইত্যাদি কারণে উত্তরাঞ্চলের বন্য প্রাণিজগত এমনিতেই বিপন্ন হতে চলেছে। এর বাইরে এদের অন্যতম নেশা বন্যপ্রাণী শিকার করে খাওয়ার প্রবণতায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণি। অপরদিকে এসব নৃগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের নামে যে কাজ হচ্ছে তা হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা। ফলে রীতিমত হুমকীর মুখে পড়েছে এদের সমাজ ও সংস্কৃতি; এমনকি ধর্মীয় মূল্যবোধও।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি জেলায় রয়েছে এদের বসবাস। তবে বৃহত্তর দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁ, পঞ্চগড়, ঘোড়াঘাট, বৃহত্তর রংপুরের লালমনিরহাট, নীলফামারী, বৃহত্তর বগুড়ার জয়পুরহাট; পাঁচবিবি, বৃহত্তর রাজশাহীর নওগাঁ, নাচোল; চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং চলনবিল এলাকায় এদের বসবাস রয়েছে। উপজাতিদের কথিত উন্নয়ন ও ধর্মান্তর কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন চার্চ, মিশনারি সংস্থার কার্যক্রমের পাশাপাশি ওয়ার্ল্ডভিশন ও কারিতাস ইত্যাদি এনজিওর চেষ্টা সত্ত্বে এখনও কমপক্ষে ২৫ লাখ উপজাতি মানুষ আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি বরং তাদের অধিকাংশই হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের ধর্ম, বোধ ও বিশ্বাস। উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে এবং নানাবিধ প্রলোভনে এদেরকে ব্যাপকভারে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে বলে রয়েছে জোরালো অভিযোগ।

নৃগোষ্ঠী বিষয়ক গবেষণা পর্ষদের তথ্য তথ্যমতে, আমাদের দেশ ২৫ লাখ উপজাতি প্রাচীন জীবনধারায় চলছে। এদের বেশিরভাগই সাঁওতাল। প্রায় ভূমিহীন উপজাতিরা স্বভাবতই শহর ও পৌর এলাকা থেকে দূরবর্তী দুর্গম গ্রামাঞ্চলে বসবাস করতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। ভূস্বামী গোত্রের মানুষদের কাছ থেকে এরা সামান্য জমি নিয়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করে আসছে। ভূস্বামীসহ অন্যান্য মানুষের জমিতে ফসল ফলানোই উপজাতি মেয়েদের প্রধান কাজ। কৃষিকাজ ও ঘর গেরস্থালীর কাজ মেয়েরাই করে থাকে। চোলাইমদ তৈরিও এদের অন্যতম একটি কাজ। পুরুষরা মাছ ও বন্যপ্রাণি শিকারের কাজ করে। নদ-নদীতে পানি না থাকা এবং বিল-জলাশয়ে মৎস্যচাষ শুরু হওয়ায় উপজাতিদের মাছ শিকার বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তীর ধনুক নিয়ে পাখি ও বন্যপ্রাণি শিকারই হয়ে উঠেছে তাদের আমিষের চাহিদা মেটানোর একমাত্র অবলম্বন। এটা উপজাতি পুরুষদের নেশাও বটে।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এরা নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য-ধর্ম, আদর্শ ও মূল্যবোধ নিয়েই নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেছে। তবে এসব পশ্চাদপদ নৃগোষ্ঠীকে মূল ধারায় অন্তর্ভূক্ত করা ও উন্নয়নের কথা বলে তাদেরকে ব্যাপকভাবে ধর্মান্তর করা হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অতীতে এসব অভিযোগ সীমিত পর্যায়ে থাকলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এ তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। উন্নত জীবনের প্রলোভনে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী এসব সরল বিশ্বাসী মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। তাদের কাছে ধর্মীয় আদর্শ প্রচার না করে বিভিন্নভাবে প্রলোভিত করা হচ্ছে। উন্নয়ন ও মূলধারায় আত্মীকরণের নামে গণহারে ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছে। এখন আমাদের দেশের এরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি হিসাবে পরিচিত হলেও এদের অধিকাংশ এখন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী। গবেষকরা মনে করেন, এদের নিয়ে যেটুকু কাজ হয়েছে বা হচ্ছে সেটা মূলত খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষার শর্তে উন্নয়ন। বিষয়টি উন্নয়নের নামে এক ধরনের প্রতারণা। আসল উদ্দেশ্য ধর্মান্তকরণ।

আমাদের দেশে যেকোন ধর্ম পালন, প্রচার ও প্রসার প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। তাই যেকোন ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব প্রচার করতেই পারেন। কিন্তু সেবার ছদ্মাবরণে ও নানাবিধ প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরে প্ররোচিত করার কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য ও কাক্সিক্ষত নয়। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ধর্মান্তরে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। কারণ, তাদেরকে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধে আকৃষ্ট করার পরিবর্তে বৈষয়িক লোভ-লালসাকেই প্রাধাণ্য দেয়া হচ্ছে। যা দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। তাই বিষয়টি তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বোধ-বিশ্বাস ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কালের গর্ভের হারিয়ে যাবে। যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত ও গ্রহণযোগ্য নয়।

www.syedmasud.com