মনসুর আহমদ

ইসলামী ক্যলেণ্ডারে রমযান হলো পবিত্রতম মাস। এ মাসে রয়েছে আমাদের জন্য সীমাহীন উপহার। আমরা কি ভেবেছি কী কারণে রমযান এত বিশেষত্ব লাভ করেছে? বছরের অন্য সকল মাসের মধ্যে এ মাসটি কেন এত পবিত্র ও রহমতপূর্ণ? শুধুমাত্র সিয়াম সাধনার কারণেই নয়, এ মাসে রয়েছে সীমাহীন পুরস্কার, আধ্যাত্মিকতার বর্ধন এবং এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহর সাথে এ মাস এমন সম্পর্কের বৃদ্ধি ঘটায় পূর্বে যা সম্ভব হয় না।

রমযানের বিস্ময়কর গুণাবলী ও তাৎপর্য :

রমযান হলো অসংখ্য গুণাবলী ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ কিছু গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো।

১. মহান আল্লাহ এ রমযান মাসে আল-কুরআন নাজিল করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘রমযান মাস, এ মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও মহাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস লাভ করবে তারা যেন সিয়াম পালন করে এবং কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না এ জন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করবার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার। ( সূরা আল-বাকারা-১৮৫)।

২. রমযানে সিয়াম পালন ইসলামের একটি রোকন বা স্তম্ভ। আল্লাহর রাসুল ফরমান, ‘ইসলাম পঁচটি স্তম্ভে উপর দাঁড়িয়ে আছে। (পরীক্ষা করার জন্য যে), তারা স্বীকার করবে আল্লাহ একমাত্র ইলাহ এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রাসুল, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত আদায় করবে, আল্লাহর ঘরে হজ¦ করবে এবং রমযানে সিয়াম পালন করবে। (সহীহ আল- বোখারী, সহীহ মুসলিম)

৩. রমযান মাসের বিশেষ রজনী লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাসে থেকে উত্তম। আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘কদরের (ভাগ্য, শক্তি) রজনী হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’( সূরা আল-কদর-৩)

৪. এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আল্লাহর রাসূল ফরমান, ‘যখন রমযানের মাস শুরু হয় তখন জান্নাতর দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়; শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়।’ ( বোখারী-১৮৯৯)

৫. যারা রমযান মাসকে অবহেলায় কাটায় তাদের জন্য রয়ছে কঠোর হুঁশিয়ারী। যদি তুমি তোমার পাপকে (এ মাসে) ক্ষমা করাতে না পার তবে তুমি বিরাট ক্ষতির মধ্যে পতিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই জিবরিল আমার কাছে এসে বলে গেছে: ‘যে ব্যক্তি রমযান পেল কিন্তু পাপ মুক্ত হলো না, সে জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে এবং আল্লাহ তাকে দূরে ঠেলে দেবেন। তাই আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন।’ (ইবনে হিব্বান-৯০৭)

৬. রমযানের প্রতিদিন আল্লাহ জাহান্নামীদেরকে মুক্তি প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রমযানের প্রতিদিন ও রাতে তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন।’ (মোসনাদে আহমদ-৭৪৫০)

৭. আল্লাহ এক রমযান থেকে পরবর্তী রমযান পর্যন্ত পাপীদের কৃত পাপরাশি মাফ করে দেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় এবং এক শুক্রবার থেকে পরবর্তী শুক্রবার, এবং এক রমযান থেকে পরবর্তী রমযান পর্যন্ত যে সব পাপ করা হয় তা আল্লাহ ক্ষমা করে দেন, যদি সে কবীরা গুনাহ্ থেকে দূরে থাকে। (মুসলিম- ২৩৩)

৮. রমযান মাস হলো আল্লাহভক্তি এবং ধর্মপ্রাণতা (তাকওয়া) অর্জনের মাস। আল্লাহ ইরশাদ করেন,‘ হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মোত্তাকী হতে পার।’ (সূরা আল-বাকারা-১৮৩)

৯. রমযানে সিয়াম পালনের পুরস্কার জান্নাত। রাসূল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে রাইয়্যান নামের একটি দরজা রয়েছে । বিচার দিবসে সিয়াম পালনকারীরা এ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের সাথে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে, ‘সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন সিয়াম পালনকারীরা সাড়া দেবে এবং তারা ব্যতীত অন্য কোন বান্দাহই এ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যখন সমস্ত সিয়াম পালনকারী প্রবেশ শেষ করবে তখন দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে; এবং অন্য কেউ আর প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বোখারী-১৮৯৬)

১০. রমযান মাসের সিয়াম পালন করা বছরের অন্য দশ মাসের সিয়াম পালনের সমান। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এ মাস সিয়াম পালন করল এবং শওয়ালের ছয়টি সিয়াম পালন করল, সে যেন সারা বছর সিয়াম পালন করল। (মুসলিম- ১১৬৪)

১১. ইমামের পেছনে এমাসে কিয়ামুল লাইল -এর কিছুটা সময় সালাত আদায়ের মর্যাদা গোটা রাতভর সালাত আদায়ের মর্যাদার সমান। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যেই ব্যক্তি রমযানে ইমামের পেছনে তাঁর সালাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে রয়, তাঁর জন্য সারারাত জেগে থেকে সালাত আদায়ের সওয়াব লিখিত হয়।’ (তিরমিযী-৮০৬)

১২. রমযানে ওমরাহ পালন হজ¦ সম্পন্ন করার সমান। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই রমযানে ওমরাহ পালন হজে¦র সমান।’ (মুসলিম- ১২৫৬)

১৩. ইফতার বিতরণে দ্বিগুণ সওয়াব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সওম আদায়কারীকে ইফতারী বিতরণ করবে, সে সওম পালনকারীর সমান সওয়াব লাভ করবে; তাকে সওম আদায়কারীকে দেওয়া সওয়াবের পরিমানের চেয়ে কম দেওয়া হবে না।’ (সুনান আত- তিরমিযী-৮০৭ ; সুনান ইবনে -মাজাহ-১৭৪৬)

১৪. রমযান উত্তম অভ্যাস গঠনের সব চেয়ে উপযুক্ত সময়। সেহরীর জন্য শেষ রাতে জাগা, তাহজ্জুদ আদায়ের জন্য শেষ রাতে জাগা, ফজরে মসজিদে যাওয়া এবং মানুষের প্রতি দয়ালু হওয়াসহ উত্তম অভ্যাস গঠনের জন্য রমযান একটি বিশেষ সুযোগ। এ মাসে অনেকে ধূমপান পরিত্যাগ, মিথ্যা কথা বলা এবং পিছনে কুৎসা গাওয়া (গীবত) থেকে বিরত থাকার সংকল্প গ্রহণ করে থাকে। তাই এ মাসটি সৎ চরিত্র ও অভ্যাস গঠন এবং মন্দ কাজ ও অভ্যাস পরিত্যাগের জন্য উপযুক্ত সময়।

১৫. এই রমযান মাসটি উদারতার স্বভাব সৃষ্টির জন্য সব চেয়ে উত্তম মাস, যা অন্য সব মাসে করা সম্ভব নয়। আল্লাহর রাসূল অন্য সব মাসের চেয়ে এ মাসে অনেক বেশি দয়াদ্র হৃদয়ের হতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল (সা.) সমস্ত মানুষের জন্য দয়ালু ছিলেন, তবে রমযান মাসে অন্য সব মাসের চেয়ে অত্যাধিক দয়ালু হতেন যখন জিবরাইল (আঃ) তাঁর সাথে দেখা করতেন . . .প্রবল বায়ু প্রবাহের চেয়ে অধিক জোরে তার দয়া ছড়িয়ে পড়ত। ( বোখারী-৩২২০)

তাই আমরা যদি বদান্য হতে চায়, তা হলে রমযানকে এ জন্য বেছে নেয়া উচিত, অধিকন্তু এটাই সুন্নাত।

১৬. সিদ্দিকীন ও শুহাদাদের দলভুক্ত হতে রমযান সবচেয়ে উত্তম সময়। একদিন এক লোক রাসূলের কাছে এসে বলল, ‘ হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ব্যতিত কাউকে উপাসনার যোগ্য মনে করি না (দ্বিতীয় উপাস্য নেই), আমি সাক্ষ্য দেই যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, আমি পাঁচ বার সালাত আদায় করি, যাকাত প্রদান করি, রমযানে সিয়াম পালন করি এবং এ মাসের রাতে আমি সালাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাই। বলুন আমি কোন দলের? রাসূল উত্তরে বললেন, ‘তুমি সিদ্দিকীন ও শুহাদাদের অন্তর্ভুক্ত।’ (ইবনে হিব্বান-৩৪৩৮)

আল্লাহ আমাদেরকে তাঁদের দলের অন্তর্ভুক্ত করুন।

রমযান হলো ধ্যানের, ঈমান বৃদ্ধি এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার মাস। এ সব সত্য অনুধাবন করে তা জীবনের সকল কর্মে বাস্তবায়িত করে আমরা এ মাসটিকে অর্থবহ করে তুলতে পারি।