আসিফ আরসালান
রাখে আল্লাহ মারে কে? সারা বাংলাদেশে মুসলমানদের এটি একটি গভীর বিশ্বাস। এ বিশ্বাসটি সত্য হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বাতিলের রায়ে। গত ২৭ মে মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় থেকে এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেন। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গঠিত তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এটিএম আজহারুল ইসলামকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন জনাব আজহার। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ৪ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০২০ সালের ১৯ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের রিভিউ চেয়ে আবেদন করেন জনাব আজহার। কিন্তু এ রিভিউ দীর্ঘদিন ধরে পেন্ডিং ছিলো। অবশেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ জনাব আজহারকে আপিলের অনুমতি দান করেন। সে আপিলের রায় বেরিয়েছে ২৭ মে এবং জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
আমি প্রথমেই বলেছি যে, রাখে আল্লাহ মারে কে? আজহারুল ইসলামের রিভিউ পিটিশন যদি ৫ বছর পেন্ডিং না থাকতো, যদি অন্যান্য জামায়াত নেতার মতো আজহারুল ইসলামের রিভিউ পিটিশনের তাৎক্ষণিক শুনানি হতো তাহলে আজহারুল ইসলামও আমীরে জামায়াত মাওলানা নিজামীসহ অন্যদের পথে অনন্তপারে চলে যেতেন। আসলে রাব্বুল আলামিন আজহারুল ইসলামের মৃত্যু ঐভাবে চাননি বলেই যে কোনো কারণেই হোক তাঁর রিভিউ পিটিশন ৫ বছর পেন্ডিং ছিলো। যদি ২০১৯ সালের রিভিউ পিটিশনের শুনানি সময়মতো হতো তাহলে আজহারুল ইসলামকে আমাদের মাঝে আর ফিরে পেতাম না।
এসব কথা এজন্যই বলছি যে, মাওলানা নিজামী থেকে শুরু করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ জামায়াত নেতাদের বিচার-টিচার তো ছিলো নেহায়েৎ লোক দেখানো ব্যাপার। শেখ হাসিনা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে কাদেরকে তিনি হত্যা করবেন এবং কাদেরকে তিনি বাঁচিয়ে রাখবেন (যদিও হায়াৎ, মউত, রেজেক, দৌলত সব আল্লাহর হাতে)।
জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে বড় অপরাধ (?) ছিলো ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে না যেয়ে বিএনপির সাথে যাওয়া। জামায়াত যদি সেদিন আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন করতো তাহলে যুদ্ধাপরাধ বলুন আর মানবতাবিরোধী অপরাধ বলুন, এসব কোনো মামলা হতো না, কোনো ট্রাইব্যুনাল হতো না। মাওলানা নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, মীর কাশেম আলী, আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী প্রমুখ নামজাদা ইসলামী স্কলার ও নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরে গুলি করে হত্যা করা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু তাদেরকে তো মেরে ফেলতেই হবে। কারণ শেখ হাসিনার জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করতেই হবে। তাই বিচারের নামে এক বিরাট প্রহসন করে এসব নেতাকে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার বানানো হয়।
ট্রাইব্যুনাল গঠনে ছিলো বিরাট গলদ। বিচার প্রক্রিয়ায় ছিলো আরো বড় গলদ। এগুলো সবই জানতেন শেখ হাসিনা এবং তার বাম ও ডান হাতেরা। তবুও তারা এ ভয়ঙ্কর কিলিং মিশন থেকে সরে আসেনি। ওরা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ারও ধার ধারেনি। কারণ ওদের পেছনে ছিলো নরেন্দ্র মোদির পাঁড় হিন্দুত্ববাদী সরকারের অন্ধ সমর্থন।
॥ দুই ॥
ভারত চেয়েছিলো, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে শেষ করতে। এব্যাপারে কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। তাই দেখা যায় কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং গোয়েন্দা রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ২৫ শতাংশ সদস্যই নাকি জামায়াত এবং শিবিরের। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী ভারতের মতো এতবড় একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এমন বানোয়াট এবং গাঁজাখুরী কথা বলেন তখন নিশ্চয়ই তার পেছনে একটি বদ মতলব থাকে। তখন বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকা এবং ভারতের অন্তত একটি বিষয়ে ছিলো দারুণ মিল। আর সেটা হলো ইসলামোফোবিয়া ।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়। কোনোরূপ তদন্ত ছাড়াই আমেরিকা সাথে সাথেই ঘোষণা করে যে এটি চরমপন্থী ইসলামী সংগঠন আল কায়েদার কাজ। পরবর্তীকালে একাধিক গবেষণাপত্র এবং একাধিক ডকুমেন্টারি ছবিতে দেখা যায় যে, চরমপন্থী ইসলামীরা ৯/১১ এর জন্য দায়ী নয়। দায়ী হলো ইসরাঈল।
আর বাংলাদেশের জামায়াতকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে বিএনপি পরাস্ত করে ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে। এ পরাজয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে শেখ হাসিনাও বাংলাদেশে শুরু করেন ইসলামোফোবিয়ার রাজনীতি। কাশ্মীরে মুসলমানদেরকে দমন করা এবং বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে নির্র্মূল করায় আওয়ামী লীগ এবং ভারতের ছিলো অভিন্ন স্বার্থ। সুতরাং শুরু হয় প্রধান ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর নির্মূল প্রক্রিয়া। সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে বেগবান করা হয় জামায়াতের বিরুদ্ধে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিষাক্ত প্রচারণা। এই প্রচারণায় নেতৃত্ব দেন পরলোকগত জাহানারা ইমাম, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোলাম রব্বানী, বাংলাদেশে ‘র’-এর একজন বড় এজেন্ট শাহরিয়ার কবির এবং মুন্তাসির মামুন নামক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন ঘোর জামায়াত বিরোধী অধ্যাপক। পরবর্তী কাহিনী আপনারা সকলেই জানেন।
শেখ হাসিনার তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) যে ছিলো ত্রুটিপূর্ণ আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য যে ছিলো জামায়াত নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা সেসব কথা অতীতে অনেক বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণসহ অসংখ্যবার উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার বিচার ছিলো ঐ প্রবাদ বাক্যটির মতো, ‘বিচার মানি, তবে তাল গাছটি আমার’। দেশের উচ্চ আদালত এক সময় শেখ হাসিনাকে এ বলে ভর্ৎসনা করেছেন যে, তিনি একজন রং হেডেড ব্যক্তি। হাইকোর্ট সেদিন ঠিকই ধরেছিলো যে, শেখ হাসিনা একজন সাইকোপ্যাথ। ‘গাঁয়ের বধূ’ শিরোনামে হেমন্ত মুখার্জির একটি গান আছে। ঐ গানে একটি লাইন হলো, ‘ডাকিনি যোগীনী /এলো শত নাগিনী’। শেখ হাসিনার রক্ত পিপাসা ঐ ডাকিনী যোগীনীদের মতোই।
॥ তিন ॥
এটিএম আজহারুল ইসলামের খালাসের রায় দেওয়ার সময় প্রধান বিচারপতি রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির ফুল বেঞ্চ যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সেগুলি মিথ্যার মায়াজাল ছিন্ন করে সত্যকে উদ্ভাসিত করেছে। তারা ৪টি অবজারভেশন দিয়েছেন। এক, শেখ হাসিনার আমলে উপমহাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি ও রীতিনীতি পাল্টে দেওয়া হয়েছিলো। দুই, সাক্ষ্য-প্রমাণ এ্যাসেসমেন্ট ছাড়াই আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছিলো। তিন, তার প্রতি নজিরবিহীনভাবে বিচারের নামে অবিচার করা হয়েছিলো। চতুর্থ অবজারভেশনটি আরও মারাত্মক। বলা হয়েছে, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যেসব তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিলো আগের আপিল বিভাগ সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আসিফ নজরুল বলেন, অতীতে দেখেছি, এদেশে বিচারের নামে কী ধরনের অবিচার করা হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো।
॥ চার ॥
শুধুমাত্র জামায়াত নয়, সেদিন বিএনপিও এ তথাকথিত বিচারের তীব্র সমালোচনা করেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য মরহুম এম কে আনোয়ার বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচার সুষ্ঠু হচ্ছে না। এম কে আনোয়ার বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সত্যিকার অর্থে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করছে না। তারা বিচারের নামে প্রহসন করছে। আমরা সব সময় বলে আসছি, বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। তবে সে বিচার হতে হবে স্বচ্ছ। উল্লেখ্য, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন। অপর বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী জয়পুর হাটের আব্দুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাদণ্ড ভোগ করাকালীন তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। এম কে আনোয়ার বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আটক ১৯৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য, যারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিলো, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ছেড়ে দিয়েছিলো। কেনো তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান সরকারকে বলতে হবে।
॥ পাঁচ ॥
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে শেখ হাসিনা যে একটি বিরাট তামাশা করেছিলেন সেসম্পর্কে অসংখ্য তথ্য আমার কাছে রয়েছে। মরহুম ব্যরিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, বর্তমান আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, আজহারুল ইসলামের আইনজীবী শিশির মনির প্রমুখের কাছে তো অবশ্যই অনেক ডকুমেন্ট থাকবে। তবে আজ যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, ইতোপূর্বে অধ্যাপক গোলাম আজম ও আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ক্ষেত্রে যে কত বড় মিস ক্যারেজ অব জাস্টিস হয়েছিলো সেটিও এখন প্রমাণ করা দরকার। প্রমাণ করা দরকার যে, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ ৫ জন জামায়াতের শীর্ষ নেতাকে পরিকল্পিতভাবে বিচারের নামে হত্যা করা হয়েছে। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম যে ইউরোপ থেকে পাঠিয়ে দেওয়া ডেথ সেন্টেন্স পাঠ করেছেন সে স্কাইপে অডিও ক্লিপ আবার জনসমক্ষে প্রচার করা দরকার। এসব করলে যারা শহীদ হয়েছেন তারা হয়তো ফিরে আসবেন না ঠিকই। কিন্তু তাদের পরিবার এবং দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী শেখ হাসিনার মতো রক্ত পিপাসু দানবের দেওয়া ইলজাম থেকে তো মুক্ত হবে।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, আমরা মনে করি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অতীতের অনেক রায় সম্পর্কে এ রায়ে অনেক পর্যবেক্ষণ থাকবে। আমরা মনে করি সরকারের উচিত হবে-পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পরে একটা রিভিউ বোর্ড গঠন করে অতীতের রায়গুলোকে পুনর্বিবেচনা করা, যেন মুত্যু পরবর্তীতে হলেও যাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে, তাদের পরিবার, তাদের দল এবং এদেশের মানুষ যেন ন্যায়বিচার পেতে পারে।
Email:[email protected]