বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ। এ দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, আইন ও জীবনাচারের প্রতিটি স্তরে ইসলাম ও শরীয়াহর ছাপ গভীরভাবে প্রোথিত। অনেক সময়ই আমরা এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি না। এর কারণও আছে। কার্যত শরীয়াহ আমাদের জীবনের এতটাই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে যে, আমরা তা আলাদা করে চিনতে পারি না। এরপরও দু:খজনকভাবে, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চিন্তাধারা, গণমাধ্যম ও এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী সমাজে এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে-শরীয়াহ মানেই মধ্যযুগীয়, নির্মম, অসহিষ্ণু এক আইনব্যবস্থা, যা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণার সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শরীয়াহ সম্বন্ধে এ ধারণা কেবল ভুল নয়, বরং এটি ইসলামোফোবিয়ার দেশীয় একটি সংস্করণ। “শরীয়াহফোবিয়া” বলতে এমন কিছু অপতৎপরতা বোঝায়-যার মূল লক্ষ্য ইসলামি জীবনব্যবস্থা ও ইসলামী শরীয়াতকে ভয়ঙ্কর হিসেবে উপস্থাপন করা, যাতে মানুষ ধর্ম থেকে দূরে সরে যায়।
শরীয়াহ শব্দটি আরবি “শারা’আ” থেকে এসেছে, যার অর্থ “পথ নির্ধারণ করা, রাস্তা খুলে দেয়া” বা “জীবনের দিশা।” অর্থাৎ এটি এমন একটি জীবনপথ, যা মানুষকে ন্যায়, পবিত্রতা ও ভারসাম্যের দিকে পরিচালিত করে। কুরআনের ভাষায় : “তারপর আমি আপনাকে শরীয়াহ’র একটি পথের ওপর স্থাপন করেছি; সুতরাং আপনি তার অনুসরণ করুন।” (সূরা আল-জাসিয়া, ৪৫ : ১৮) অর্থাৎ শরীয়াহ শুধু আইন নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ৯০ শতাংশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশের একজন মুসলমানের জীবনের প্রতিটি ধাপেÑজন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত-শরীয়াহ নীরবে, স্বাভাবিকভাবে উপস্থিত। বিশেষ করে একটি নবজাতকের জন্মের পর আজান দেওয়া, নামকরণ, আকিকা, উত্তরাধিকার বণ্টন, বিবাহ ও তালাকের নিয়ম, জানাজা ও দাফনের পদ্ধতিÑসবই শরীয়াহর আলোকে পরিচালিত হয়। কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার কবরস্থানের দিকনির্দেশনা থেকে শুরু করে জানাজার দোয়া পর্যন্ত শরীয়াহই পথ দেখায়। এমনকি সামাজিক জীবনে সততা, ব্যবসায়িক লেনদেন, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব, আত্মীয়তার বন্ধনÑসবকিছুতেই শরীয়াহর শিক্ষার প্রতিফলন ঘটে। একজন সাধারণ মুসলমান সকালে নামাজ পড়ে অফিসে যায়, পথে সততা বজায় রাখে, অন্যের হক আদায় করে-এই জীবনাচারই আসলে শরীয়াহনিষ্ঠ জীবন। কিন্তু আমরা এটিকে শরীয়াহ বলি না, কারণ এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক অংশ হয়ে গেছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, “শরীয়াহর সারমর্ম হলো ন্যায়, দয়া, কল্যাণ ও প্রজ্ঞা। যেখানেই এই চারটি গুণ বিদ্যমান, সেখানেই শরীয়াহ রয়েছে।” ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের এ সংজ্ঞাটি শরীয়াহর সবচেয়ে গভীর সংজ্ঞাÑ যেখানে বোঝা যায় যে, শাস্তি নয়, বরং মানবকল্যাণই শরীয়াতের মুখ্য। ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের (ইসলামিক জুরিস্টদের) একটি বড় অংশ মনে করেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের অনেক অংশই ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পারিবারিক আইন (Muslim Family Laws Ordinance) মূলত শরীয়াহভিত্তিক। বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ও অভিভাবকত্বের মতো বিষয়ে শরীয়াহই আইনি ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। একইভাবে, ফৌজদারি আইনের Penal Code) অনেক ধারা ন্যায়, সুবিচার ও অপরাধ দমন বিষয়ে ইসলামী নীতির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ নয়। ব্যাংকিং খাতে শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের প্রসার এবং সুদমুক্ত আর্থিক ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, যা শরীয়াহর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরই একটি প্রয়োগ। বাংলাদেশের সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
“The state religion of the Republic is Islam, but other religions may be practiced in peace and harmony.”
এটি কোনো আনুষ্ঠানিক ‘ঘোষণামাত্র’ নয়; বরং রাষ্ট্রের নীতি ও নৈতিক ভিত্তিকে নির্দেশ করে। ধারা ৮(১) অনুযায়ী, রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিসমূহের মধ্যে আছে “h igh ideals of absolute trust and faith in the Almighty Allah”-যা নৈতিক দিক থেকে ইসলামী শরীয়াহর মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রখ্যাত আইনবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিকরা বহুবার বলেছেনÑ“বাংলাদেশের সংবিধান ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং রাষ্ট্রের অনেক নীতিই শরীয়াহর নৈতিক ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।” সুতরাং যারা মনে করেন শরীয়াহ মানে কেবল ‘হাত কাটা’, ‘পাথর ছোড়া’ বা ‘জিজিয়া’Ñতাদের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও একপেশে। এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি রেফারেন্স দেয়া জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: ফরিদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“The Constitution of Bangladesh recognizes Islam as the State religion, and many of its fundamental policy principles ustice, equality, moral governance
are congruent with the ethical objectives of the Shariah (Maqasid al-Shariah).”(তথ্যসূত্র : Islamic Law and the Constitution of Bangladesh, Dhaka University Law Journal, Vol. 22, 2011.)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আশরাফুল আলম এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধে লিখেছেন,
“Contrary to popular perception, there is no major contradiction between the moral foundations of the Shariah and the constitutional provisions of Bangladesh. Rather,
both emphasize justice, human dignity, and moral restraint.”
(তথ্যসূত্র: Bangladesh Constitution and Shariah: A Comparative Perspective, 2017)
বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা যিনি এর আগেও একাধিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তার The Political
Economy of Bangladesh (Cambridge University Press, 2021) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-“The moral and ethical underpinnings of Islamic law continue to influence the country’s legal culture, family laws, and social values, even within a largely secular legal framework”
বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ২০১০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি সেমিনারে বক্তব্য প্রদানকালে বলেন,
“Our legal system may be secular in structure, but not in spirit. The moral essence of law in Bangladesh is not far from Islamic jurisprudence”
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামিক জুরিস্ট এবং মালয়েশিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. হাশিম কামালি তার Principles of Islamic Jurisprudence (Cambridge Islamic Texts, 1999) গ্রন্থে লিখেছেন
“Most Muslim-majority countries today, including Bangladesh, have civil laws whose ethical orientation is not in conflict with the Shariah, though they may not be Shariah- based in form”
অনেকে মনে করেন পশ্চিম থেকে আমদানি করা পরিভাষা আইনের শাসন তথা “জঁষব ড়ভ খধ”ি আর শরীয়াহ একে অপরের পরিপন্থী। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যায়, পশ্চিমা আইনের মূল মূল্যবোধÑন্যায়, সমতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবমর্যাদা-এসব ধারণার উৎস তৈরি হয়েছে ইসলামী সভ্যতা থেকেই। ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনেক আগে ইমাম জাফর আস সাদিক, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক বিন আনাস, ইমাম শাফেয়ি, এবং ইমাম আহমাদ বিন হান্বল (রহ.) ন্যায় ও সুবিচারের যে দর্শন উপস্থাপন করেছিলেন, সেটিই পরবর্তীতে ইউরোপীয় ন্যায়বিচারের তাত্ত্বিক ভিত্তিকে প্রভাবিত করেছে। harvard Law Review (Vol. 124, 2011-এর এক গবেষণায় বলা হয়-“Islamic jurisprudence, especially the hanafi tradition, contributed significantly to the early discourse on natural law and equality before law in Europe” অর্থাৎ শরীয়াহ ও আধুনিক আইনের মধ্যে মূল সংঘর্ষ নয়; বরং এটি এক প্রকার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। এরপরও শরীয়াহ আইন নিয়ে যেভাবে আমাদের দেশে জুজুর ভয় দেখানো হয় তা নিতান্তই অমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এখানে অপপ্রচারকারীরা যে বিষয়টি নিয়ে বেশি সক্রিয়তা প্রদর্শন করেন তাহলো শরীয়াতের শাস্তিমূলক আইন। অথচ বাস্তবতা হলো, শরীয়াহর একটি ক্ষুদ্র অংশ হলো শাস্তিমূলক আইন যার উদাহরণ হিসেবে হুদুদ, কিসাস, জিজিয়ার কথা বলা যায়। কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যম ও কিছু স্বঘোষিত প্রগতিশীল মহল কৌশলে শরীয়াহর এই ক্ষুদ্র অংশটিকেই পুরো ইসলামী আইন হিসেবে তুলে ধরছে। তারা দেখাতে চায়Ñশরীয়াহ মানেই রক্তপাত, হাত কাটা বা প্রকাশ্য শাস্তি অথবা পাথর নিক্ষেপ করা। অথচ শরীয়াহর ৯৫ শতাংশই ন্যায়, করুণা, নৈতিকতা, শিক্ষা, পারিবারিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজকল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত যা তারা কৌশলে এড়িয়ে যান।
আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ হলেন রাসূল (সা.) আর তিনি নিজেই শরীয়াহ প্রয়োগে ধৈর্য, শিক্ষা ও সামাজিক প্রস্তুতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। মক্কা যুগে ১৩ বছর ধরে তিনি মানুষের হৃদয় ও মনকে ইসলামী মূল্যবোধে গড়ে তুলেছিলেন। এরপর মদীনায় গিয়ে তিনি ধাপে ধাপে শরীয়াহর পূর্ণাঙ্গ রূপ বাস্তবায়ন করেন। অর্থাৎ শরীয়াহ কোনো দিনই শুধু শাস্তির আইন ছিল না; এটি ছিল মানুষ গঠনের, সমাজ সংস্কারের ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক মানবিক পদ্ধতি। অথচ এ শরীয়াতের এ মানবিক রূপটি আলোচনায় না এনে শরীয়াহ সম্বন্ধে অহেতুক একটি ভয়ংকর ভাবমূর্তি গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে আর সবচেয়ে দু:খজনক বিষয় হলো এ কাজটি হচ্ছে নামধারী কিছু মুসলিমদের মাধ্যমেই। প্রকৃতপক্ষে, অজ্ঞতা-তা ইসলামের ব্যাপারে হোক, বা সামাজিক কোনো বাস্তবতা সম্পর্কে তা নিন্দনীয়। মনে রাখা দরকার যে, অজ্ঞতার কারণেই গন্ডির ভেতর ও বাহির- উভয় মহলেই ভুল বোঝাবুঝির জন্ম হতে পারে।
যেভাবে পশ্চিমা সমাজে ইসলামোফোবিয়া সৃষ্টি করা হয়েছে; মুসলমানদের প্রতি অযথা ভয়, ঘৃণা ও সন্দেহ তৈরি করা হয়েছে; বাংলাদেশের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে তেমনটা সম্ভব হবে না বিধায় কাছাকাছি একটি কৌশলে শরীয়াহফোবিয়া তৈরি করার চেষ্টা চলছে। উদ্দেশ্য একটাই: যেন মানুষ শরীয়াহর নাম শুনলেই ভয় পায়, ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে যায়, এবং পশ্চিমা আইন ও সংস্কৃতিকেই মানবিক “সভ্যতা” হিসেবে গন্য করে। এ কারণে দেখা যায যে, কোনো ইসলামি দলের নেতা-নেত্রী টেলিভিশন বা গণমাধ্যমে এলেই এক শ্রেণির সাংবাদিক প্রশ্ন করেন-“আপনারা ক্ষমতায় গেলে কি শরীয়াহ আইন চালু করবেন?”-এ প্রশ্নের ভেতরেই যেন লুকিয়ে থাকে ভয় দেখানোর কৌশল।
প্রকৃতপক্ষে শরীয়াহকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই; বরং শরীয়াহই ন্যায়বিচার, মানবিকতা, সততা ও শান্তির পথ। এটি এমন এক জীবনব্যবস্থা, যেখানে শাসক ও প্রজার জন্য একই নীতি, ধনী ও গরিবের জন্য সমান বিচার, নারী ও পুরুষের মর্যাদা নিশ্চিত হয়ে যায়। আজকের সমাজে দুর্নীতি, অনাচার, মাদক, যৌন অপরাধ, নারী নির্যাতন, চুরি, ঘুষ-সবকিছুর প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে মানুষ ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ শরীয়াহর মূল উদ্দেশ্যই হলো মাকাসিদ আল-শরীয়াহ-অর্থাৎ ধর্ম, জীবন, বুদ্ধি, বংশ ও সম্পদের সংরক্ষণ। এ পাঁচটি মৌলিক লক্ষ্য অর্জিত হলে সমাজে স্বাভাবিকভাবেই ন্যায়, শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে আসবে।
অতএব, সময় এসেছে আমরা সে ভুল ধারণা ভাঙতে শিখি। শরীয়াহকে ভয় নয়, বোঝা দরকার; বিতর্ক নয়, প্রয়োগের সঠিক প্রক্রিয়া শেখা দরকার। কারণ শরীয়াহ মানে শাস্তি নয়Ñবরং শৃঙ্খলা, ন্যায়, মানবতা ও আল্লাহর নির্দেশিত শান্তিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। আর এটি জোর করে বা হুট করে চাপিয়ে দেয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে শরীয়াহ বাস্তবায়নে রাসূল সা. এর কর্মপন্থা নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন- যাতে জনমনে শরীয়াহ নিয়ে অহেতুক আতঙ্ক হ্রাস পায়।