সাইবার বুলিং একটি ইংরেজি শব্দ। ‘সাইবার’ (cyber) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘অনলাইন জগৎ’ আর বুলিং (bullying) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কাউকে অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করা বা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা। সাইবার বুলিং বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছেÑ ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাউকে গালমন্দ করা, হয়রানি করা, ভয় দেখানো, কারও অনুমতি ছাড়া তার বিব্রতকর বা অবমাননাকর ছবি প্রকাশ করা, কিংবা কারও বক্তব্য নিয়ে কটূক্তি করা ইত্যাদি। এগুলো সবই সাইবার অপরাধ বা সাইবার বুলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। কম-বেশি সব বয়সি মানুষ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। তবে কিশোর-কিশোরী ও নারীরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। বিশেষত আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠানোর মাধ্যমে এ অপরাধটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (যেমন ফেসবুক) ছবি আপলোড করার পর তা সফটওয়্যারের সাহায্যে বিকৃত করে অশ্লীল ছবিতে পরিণত করা হয়, যেন নারী সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। এক পরিসংখানে দেখা গেছে- ৩০ বছরের নিচের নারীরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রে সাইবার বুলিং এর মাধ্যমে অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটছে। সাইবার বুলিং একজন মানুষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয় এবং কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কামাল পাশা’ কবিতার একটি লাইনÑ বিশ্ব মিছিল দেখবো আমি আপন মুঠায় হাতে করে। কবি হয়তো আজকের এ প্রযুক্তির যুগ কল্পনাও করতে পারেননি। আজ ঘরে ঘরে মুঠোফোন, ফলে গ্রাম-শহর সবখানেই ইন্টারন্টে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতা। এক ক্লিকেই পুরো পৃথিবী হাতের মুঠায়। অথাৎ সব খবর জানা যায়। এটা যেমন আনন্দের, তেমনি এর ভয়াবহ দিকটাও আমাদের ভাবিয়ে তুলে, সেটি হলো সাইবার বুলিং। নতুন এ বিপদ ক্যান্সারের মত দ্রুত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। শিশু, কিশোর, কিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্ক কেউই বাদ নেই। ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব বা অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার, গুজব ও অপমানজনক কর্মকান্ড চলছে। ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে একে অপরের সম্মানহানি, ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়া-সবই এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এতে ভুক্তভোগীরা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে, তাদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও বিষণ্নতা বিরাজ করছে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও শিক্ষক শেহরীন আমিন ভুঁইয়া মোনামি এর ছবি বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের প্রতিও যদি এমন নোংরা আচরণ করা হয় তাহলে গ্রামের সাধারণ নারীরা কীভাবে নিরাপদ থাকবেন তা সহজেউ অনুমেয়। তাই আইনের যথাযথ প্রয়োগ এখন সময়ে দাবি। মোনামির দায়ের করা মামলায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত শাহবাগ থানাকে অভিযোগটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন এবং আগামী ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন- এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, অভিভাবকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। সন্তানরা অনলাইনে কী করছে, কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে-তা জানা জরুরি। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ডিজিটাল সচেতনতা শিক্ষা চালু করতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহারে দায়িত্বশীল হতে শেখে।

১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাইবার বুলিংয়ের সূচনা হয়। প্রথমে ইন্টারনেট ব্যবহৃত হতো ইমেইল ও চ্যাট, তখনই কিছু মানুষ অনলাইনে অপমানজনক বা হুমকিমূলক বার্তা পাঠাতে শুরু করে যা পরবর্তীতে ‘Cyberbullying’ নামে পরিচিত হয়। ২০০৩ সালে কানাডীয় শিক্ষাবিদ বিল বেলসি (Bill Belsey) প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি বলেÑ ‘Cyberbullying is the use of information and communication technologies to support deliberate, repeated, and hostile behavior by an individual or group that is intended to harm others’ ২০০৪ সালে ফেসবুক, মাইস্পেস, অর্কুট প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়ার আগমনের পর সাইবার বুলিং ব্যাপক আকার ধারণ করে। ২০১০ সালের পর স্মার্টফোন, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের প্রসারে এটি বিশ্বব্যাপী সামাজিক সংকটে পরিণত হয়। বাংলাদেশে ২০০৮-২০১০ সালের দিকে ফেসবুক জনপ্রিয় হতে শুরু করলে সাইবার বুলিংও শুরু হয়। ভুয়া আইডি, গুজব ছড়ানো, ব্যক্তিগত ছবি ফাঁস সবই ছিল এর প্রাথমিক ধাপ। বর্তমানে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নারী শিল্পী, সাংবাদিক, খেলোয়াড়-অনেকেই প্রতিদিন অনলাইনে অশালীন মন্তব্য ও কটূক্তির শিকার হচ্ছেন। কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে তাকে হেয় করে ট্রল করা হয় যা সরাসরি অনলাইন হয়রানি বা Cyber Harassmen।

অনেক সময় স্কুল-কলেজপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের টিকটক বা রিলস ভিডিওর মাধ্যমে উপহাস করা হয়। এমনকি ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করতেও বাধ্য করা হয়। সম্প্রতি এক তরুণী স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য আমার কাছে আসে- সে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছিল। মেয়েটি জানায়, ক্লাস নাইনে পড়ার সময় জম্মদিনের কেক কিনতে গিয়ে এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে সে ছেলে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে। রাজি না হলে ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। শেষে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয়, কিন্তু বিয়ের পর নির্যাতনের শিকার হয়ে মেয়েটি ডিভোর্স দেয়। এমন অসংখ্য ঘটনা আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটছে। তাই এখনই সময়-সাইবার বুলিং বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সরকার ২০১৩ সালে আইসিটি আইন ও ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু সাইবার বুলিং কমেনি। সম্প্রতি ৯ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুমোদিত হয় যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ বাতিল করে।

এ আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে অন্য কোনো ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইলিং বা যৌন হয়রানি, বা রিভেঞ্জ পর্ন, বা ডিজিটাল শিশু যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত উপাদান (চাইল্ড সেকসুয়াল অ্যাবিউজ ম্যাটেরিয়াল) বা সেক্সটর্শন করিবার অভিপ্রায়ে সৃষ্ট বা প্রাপ্ত বা সংরক্ষিত কোনো তথ্য, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থিও চিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত, এডিটকৃত, কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্মিত অথবা এডিটকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এরূপ কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা প্রেরণ প্রকাশ বা প্রচার করার হুমকি প্রদান করেন, যাহা ক্ষতিকর বা ভীতি প্রদর্শক তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হাইলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। (৩) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ, কোনো নারী বা অনূর্ধ্ব ১৮ (আঠারো) বৎসরের কোনো শিশুর বিরুদ্ধে সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

এ ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, ব্ল্যাকমেইলিং অর্থ এমন হুমকি বা ভীতি প্রদর্শনকে বুঝাইবে, যাহার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে তাহার গোপনীয় তথ্য প্রকাশের বা ক্ষতি করিবার ভয় দেখাইয়া বেআইনি সুবিধা, সেবা বা চাহিত কোনো কার্য সম্পাদনে বাধ্য করে। সুতরাং আমরা মনে করি কেউ যদি অনলাইনে হয়রানির শিকার হন সাথে সাথে প্রমাণসহ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ করতে পারেন। সম্ভব হলে প্রমাণ হিসেবে স্ক্রিনশট ও লিংক সংরক্ষণ করে তা উপস্থাপন করা যেতে পারে। তবে কেবল আইন করলেই সাইবার বুলিং বন্ধ হবে না। প্রয়োজন পরিবারের দায়িত্বশীলতা, সামাজিক সচেতনতা ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয় করা, যেন প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলতে না পারে।