১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পূর্ব বাংলার মানুষের উচ্চশিক্ষার দ্বার উম্মোচিত হতে শুরু করে। যদিও কাজটি মোটেই নির্বিঘ্ন ছিল না বরং নানাবিধ বাধা-প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়। মূলত, সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ঢাবি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শাসকগোষ্ঠীর আদর্শিক দেউলিয়াত্ব, উপর্যুপরি ব্যর্থতা ও ক্ষমতাকেন্দ্রীক নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীত গৌরব হারাতে শুরু করে। বস্তুত, ঔপনিবেশিক শাসনামলে স্বাধীন জাতিসত্ত্বার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং এক সময় তা বাস্তবতাও পায়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সে অতীত গৌরব রক্ষা করা সম্ভব হয়নি বরং নানাবিধ কারণেই এ বিশ্ববিদ্যালয়টি অতীত গৌরব ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। যদিও আগস্ট বিপ্লবের পর সে নেতিবাচক ধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
ঔপনিবেশিক শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বস্তুত, বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। সে সময় পূর্ববঙ্গ শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি সহ সকল ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে এ অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হলেও মহল বিশেষের তা পছন্দ হয়নি। ফলে নানা অজুহাতে বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত তারা সফলতাও লাভ করে। যা পূর্ববঙ্গের মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো। ফলে পূর্ব বাংলার সংক্ষুব্ধ মুসলমানদের কিছুটা শান্ত করার জন্যই ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়।
মূলত, ১৯০৫ সালে ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’ ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। যা বঙ্গভঙ্গ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের প্রভাবশালীরা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে। এদিকে মুসলমান নেতারা নতুন প্রদেশ হওয়াতে শিক্ষাসহ নানা সুবিধা পাবেন এমন আশায় উজ্জীবিত ছিলেন। কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়।
মহল বিশেষের প্রবল আপত্তি ও আন্দোলনের মুখেই ১৯১১ সালে কোম্পানী সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে। এরপর পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের ক্ষোভ প্রশমনে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জোরালো দাবি ওঠে। এতেও বঙ্গভঙ্গ বিরোধীরা বাধ সাধেন। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন? শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান ঘটিয়েছিলেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে এবং মুসলমানরা শিক্ষা-দিক্ষায় অগ্রসর হবে-এ আশঙ্কায় পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবীদের বৃহত একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন বলে জানা যায়।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতার অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘শ্রেণিস্বার্থে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন লর্ড কার্জনের ওপর অতি ক্ষুব্ধ। কার্জনের উচ্চশিক্ষাসংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কলকাতার হিন্দু সমাজে। তাতে রবীন্দ্রনাথও অংশগ্রহণ করেন’।
এ প্রসঙ্গে গবেষক তৌহিদুল হকের বক্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য। তার ভাষায়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তিন শ্রেণির মানুষ বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে তৃতীয় কাতারে রাখতে চাই। কারণ তারা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণের কিছু হিন্দু সমাজ। তাঁদের সাথে বিশেষ করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাথে রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার বৈঠক, আলোচনা হয়েছে.....’।
কোলকাতার এলিট শ্রেণি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবশ্যকতা রয়েছে সেটা বোঝাতে এবং প্রতিষ্ঠার ব্যাপার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু ১৯১৫ সালে তার মৃত্যু হলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এ উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য। সে ধারাবাহিকতায় ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন আগে ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৗধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সহ মুসলিম নেতৃবৃন্দ।
২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করেন ব্যারিস্টার আর নাথানের নেতৃত্বে ডি আর কুলচার, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, আনন্দচন্দ্র রায়, জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ এ টি আচির্বল্ড, ঢাকা মাদরাসার তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ আর জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি ডব্লিউ পিক এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সতীশচন্দ্র আচার্য। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির রিপোর্ট এবং সে বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাশ করে ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’।
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত করা হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬শ একর জমির উপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের ভবনসমূহের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড় উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। যেসব প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন তারা হলেন, মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ সি টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এ এফ রাহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ও ভারত বিভাজনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামক পৃথক দু’টি জাতিস্বত্ত্বার উম্মেষ ঘটে। ফলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা উজ্জীবিত হয়। তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫ টি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। ১৯৪৭-৭১ সময়ের মধ্যে ৫টি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও ৪টি ইন্সিটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সোনালী অধ্যায়ের অংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয় বরং জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিকালেও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রী সহ অনেকেই শহীদ হয়েছেন। যা স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও বেগবান ও শানিত করেছিল।
অনেক চড়ায়-উৎরাই ও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। কিন্তু সে অতীত গৌরব নানা কারণেই রক্ষিত হয়নি। অতীতে এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাংকিং-এ উল্লেখযোগ্য অবস্থানে থাকলেও সে অবস্থার বড় ধরনের অবনোমন ঘটেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিষয়টিকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ব্যাংখ্যা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ-পঠনের মান, গবেষণা, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানক্রম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের তেমন একটা সাফল্য ছিল না। গবেষণায় কম বরাদ্দ ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনা সংখ্যা কম, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা কম থাকা ও ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ না করার কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বাজেটের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ গবেষণার ব্যয় করা হয়েছে সে সময়। ফলে কাঙ্খিত মানের ভালো গবেষণা হয়নি। শিক্ষকদের মধ্যেও গবেষণায় আগ্রহ আশঙ্কাজনক হ্রাস পেয়েছিলো। আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনাও ছিলো খুবই কম। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। মূলত, বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থান অর্জনে গবেষণা ও প্রকাশনা বাড়ানোর আবশ্যকতা থাকলেও বিগত সরকারের আমলেই তা বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে এসেছে।
উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়াও আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও অপরাজনীতিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানের অবনোমনে কম দায়ি নয়। ঢাবির শিক্ষার মান যে ক্রমেই নিম্নমুখী হয়েছে তা এক গবেষণার ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ের জন্য বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘কুয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস’ (কিউএস)। শিক্ষা-গবেষণার মান ও পরিবেশ বিবেচনায় প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক র্যাংকিং প্রকাশ করে আসছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থাটি। কিউএস র্যাংকিংয়ের নিকট অতীতের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিগত দশকে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ২শ ধাপ অবনমন ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ‘টপ ইউনিভার্সিটিস ডটকম’ সূত্রে জানা যায়, কিউএসের ২০১২ সালের জরিপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল ৬০১তম। ২০২০ সালে এসে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৮০১তম। অর্থাৎ আট বছরের ব্যবধানে কিউএস র্যাংকিংয়ে ২০০ ধাপ পেছাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যা আমাদের দেশের শিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
২০১২ সালের পর ২০১৩ সালে কোনো জরিপ প্রকাশ করেনি কিউএস। ২০১৪ সালে হঠাৎ করে ১০০ ধাপ অবনমন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান হয় ৭০১তম। এরপর ২০১৭ সাল পর্যন্ত র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অপরিবর্তিত ছিল। ২০১৮ সালে গিয়ে কিছুটা অবনমন হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দাঁড়ায় ৭০১-৭৫০ তম। এরপর ২০১৯ সালে এসে বড় অবনমন হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দাঁড়ায় ৮০১-১০০০তম। ২০২০ সালেও বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে একই অবস্থানে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে আগস্ট বিপ্লবের পর সে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। ফলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) বিশ্বসেরা ৬০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উঠে এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এবারের র্যাঙ্কিংয়ে ঢাবির অবস্থান ৫৮৪তম। তবে দ্বিতীয় হওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে নেই কোনো উন্নতি কিংবা অবনতি। গতবারের মতো প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান ৭৫০ এর পরে (৭৬১-৭৭০তম)। আর গতবারের মতো বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটি তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। এবার তাদের অবস্থান ৯৫১-১০০০তম, যা গতবার ছিল ৯০১-৯৫০তম।
বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান কিউএস চলতি বছরের ১৯ জুন তাদের ওয়েবসাইটে এ র্যাঙ্কিংয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। ২০২৬ সালের ‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিংস ২০২৬: টপ গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিজ’ শীর্ষক এ র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ১ হাজার ৫০১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের মোট ১৫টি সরকারি ও বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। র্যাংকিং-এ টানা ১৩তম বছরের মতো প্রথম স্থানে রয়েছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে যথাক্রমে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে পঞ্চম স্থানে। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশনের সঙ্গে যৌথভাবে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং প্রকাশ করলেও ২০১০ সালে আলাদা হয়ে যায় কিউএস। এরপর থেকে আলাদাভাবে র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে আসছে তারা। কিউএসের প্রকাশিত সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য র্যাঙ্কিংগুলোর একটি মনে করা হয়। এ র্যাঙ্কিংয়ে এখন ৯টি সূচকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মান নিরূপণ করা হয়। প্রতিটি সূচকে ১০০ করে স্কোর থাকে। সব সূচকের যোগফলের গড়ের ভিত্তিতে সামগ্রিক স্কোর নির্ধারিত হয়। কিউএস র্যাঙ্কিংয়ের সূচকগুলো হলো গবেষণা ও আবিষ্কার, শিখন অভিজ্ঞতা, কর্মসংস্থান, বৈশ্বিক সম্পৃক্ততা, স্থায়িত্ব, ইন্টারন্যাশনাল ফি, স্কলারশিপ, ইংলিংশ টেস্ট এবং একাডেমিক টেস্ট।
পরিসংখ্যান মতে, ২০২৬ সালের জন্য সদ্যপ্রকাশিত র্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক স্কোর ২৮ দশমিক ৭০। এর মধ্যে গবেষণা ও আবিষ্কার সূচকে একাডেমিক খ্যাতিতে ৩০.৫০ ও শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতিতে ৬ দশমিক ৯০, শিখন অভিজ্ঞতার সূচকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে ১০ দশমিক ৫০, কর্মসংস্থান সূচকে কর্মসংস্থানের ফলাফলে ৯৭, চাকরির বাজারে সুনামে ৫১ দশমিক ৩০, বৈশ্বিক সম্পৃক্ততা সূচকে আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ২ দশমিক ২০, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্কে ৫৭.৮০, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতে ১ দশমিক ৪০ এবং আন্তর্জাতিক ছাত্র বৈচিত্র্য ১ দশমিক ৩০ স্কোর করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া স্থায়িত্ব সূচকে ৫৪.২০ স্কোর রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
মূলত, গত জুলাই-এ ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) সম্প্রতি নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল অংশীজনকে অবহিত করার লক্ষ্যে এ উদ্যোগগুলোর হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের নেয়া ইতিবাচক উদ্যোগুলো হলো- ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারকে অটোমেশন করার লক্ষ্যে প্রাথমিক আলোচনা করা হয়েছে। ২. আবাসিক হলসমূহের বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থার বিষয়ে প্রকৌশল দফতরের একটি দল সার্বিক পর্যালোচনা সম্পন্ন করেছে। এপ্রেক্ষিতে হলসমূহের অবকাঠামোগত সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে। ৩. মেডিকেল সেন্টারের সেবার মান উন্নত করার লক্ষ্যে সেবাদানকারী চিকিৎসাকর্মী নিয়োগের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সেন্টারের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও বাগানমালী নিয়োগের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তির হালনাগাদ তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে (www.du.ac.bd) দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৫. সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ‘জুলাই বিপ্লব কর্নার’ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ৬. জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকে উপজীব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি একাডেমিক সম্মেলন/কমর্শালা আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ৭. ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসার বিষয় তত্ত্বাবধান করার লক্ষ্যে উপাচার্যের নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ (চার) সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৮. আবাসিক হলসমূহে খাবারের মান উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ৯. আবাসিক হলসমূহে গণরুম প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। ১০. আবাসিক হলসমূহে মেধার ভিত্তিতে আসন বণ্টন অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় অনেক আশা-আকাক্সক্ষা ও আন্দোলনের ফসল হলেও আমাদের জাতীয় ব্যর্থতার কারণেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড অতীত গৌরব হারিয়েছে। বিশেষ করে বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত করা হয়েছিলো। ফলে সে শিক্ষার মানের বড় ধরনের অবনোমন ঘটেছে। মূলত, আদর্শহীন শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো স্বকীয়তা, অতীত ঐতিহ্য ও গৌরব হারিয়ে বসেছে। অবক্ষয় ও মূল্যবোধহীনতার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিলো শিক্ষক সমাজেরও ওপরও। স্বৈরাচারি আমলে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ ও সুযোগসন্ধানী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও নামতে হয়েছে। একই সাথে একশ্রেণির শিক্ষার্থীদের টেন্ডারবাজি, কমিশনবাণিজ্য, প্রশাসনে আধিপত্য বিস্তার, আবাসিক হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ নানা ধরনের কলঙ্কিত ঘটনার অভিযোগও ছিলো বেশ জোরালো।
অনেক আশা-আকাক্সক্ষা ও আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দেশের আদর্শহীন ও ক্ষমতাকেন্দ্রীক অপরাজনীতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছিলো। তবে আগস্ট বিপ্লবের পর সে অবস্থার বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিশ্ব রেংকিং-এ। এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের নতুন প্রশাসনকে স্বৈরাচারি আমলের অশুভ বৃত্ত থেকে অবশ্যই বেড়িয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোন সুযোগ নেই বরং সৃষ্ট ইতিবাচক ধারাকে আরো বহুদূর এগিয়ে নিতে হবে। একই সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষার্থী সহ শিক্ষকদের বেশি বেশি গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য দিতে হবে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ। এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কক্ষপথে ফিরিয়ে আনতে জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েবে।