নারীর প্রতি সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যা থেকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আমার প্রিয় বাংলাদেশও মুক্ত নয়। একজন নারী ঘরে-বাইরে, যাত্রাপথে-কর্মক্ষেত্রে কোথাও নিরাপদ নয়। নারীর ওপর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নিপীড়ন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোনো নারীকে শারীরিকভাবে আঘাত করলেই আমরা মনে করি সহিংসতা। আসলে বিষয়টি এমন নয়! নারীর প্রতি সহিংসতার পরিধি অনেক বড়। এটা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক হতে পারে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশের ৭০ ভাগ নারী তাঁদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হন। ২০২৪ সালে প্রায় ৪৯ শতাংশ নারীর ওপর এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় স্বামীর মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হন নারীরা। নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪ এ এমন তথ্যটিই উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌথভাবে এ জরিপ করেন। সম্প্রতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জরিপের এ প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়।
ইদানিং দেশের বিভিন্ন জায়গায় তুচ্ছ কারণে নারীর সাথে নিষ্ঠুর আচরণের খবর মুদ্রিত হচ্ছে। কখনো মাথার চুল কেটে, কখনো চুনকালি মেখে, কখনো গাছের সঙ্গে বেঁধে, কখনো মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নারীকে হেনস্থা করা হচ্ছে। গত ১১ জুন কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে গোশত চুরির অভিযোগে এক নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানিয়েছে। ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায় স্থানীয় শতাধিক বাসিন্দা নারীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ মাথার কাপড় সরিয়ে দিচ্ছেন। আনন্দ উল্লাস করছেন। কেউ কেউ এসব দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করছেন। পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারের ভাষ্যমতে, গত সোমবার বিকেলে প্রতিবেশীর ঘরে ঢুকে রেফ্রিজারেটর থেকে গোশত নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে ভুক্তভোগী নারীর বিরুদ্ধে। সে সময় প্রতিবেশীর স্ত্রী তাঁকে ধরে বাড়ির উঠানে পেয়ারা গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে মারধর করে গোশত কেড়ে নেন। এক পর্যায়ে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান তাঁর স্বামী। ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন রাত ৮ টার দিকে ওই নারীর বাড়িতে ভাঙচুর করে তাঁকে তুলে আবার প্রতিবেশীর বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে তাঁকে মারধর করে মাথায় চুল কেটে দেয়া হয়। অথচ বেআইনী সালিসের মাধ্যমে নারীকে শাস্তি ও জরিমানা হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নিষিদ্ধ। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী কুমারখালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। নারীর ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কাজী নজরুল ইসলাম নারী সম্পর্কে কত চমৎকার কবিতাই না লিখেছেন‘সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই। বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি, অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। নরককাণ্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান? তারে বল, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।’’ নারীর প্রতি সহিংসতা আমাদের অগ্রগতি ও সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এটা কোন সভ্য সমাজের লক্ষণ নয়। নারীর জীবনের মতোই মূল্যবান তার ইজ্জত। কিন্তু কত লম্পট যে নারীর জীবন ও ইজ্জত কেড়ে নিয়েছে তার সব ঘটনা আমরা জানি না। যে সব নিষ্ঠুর ঘটনা পত্রপত্রিকায় কিংবা মিডিয়াতে প্রকাশিত হয় সেগুলোই কেবল আমরা জানতে পারি। ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পুরো দেশ কেঁপে উঠেছিল। ১৯৮৯ সালের ৯ এপ্রিল শিল্পপতি মুনীর ও খুকুর পরকিয়ায় বলি হন স্ত্রী শারমিন রিমা। রিমাকে হত্যা করা হয়েছিল। মুনীর খুকুর এ ঘটনা ওই সময় বেশ আলোচিত হয়েছিল। ওই ঘটনা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মঞ্চনাটক, যাত্রাপালা এবং অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এখন নারীর জীবন কেড়ে নিলেও জোড়ালো প্রতিবাদ হয় না। যার জ¦লন্ত প্রমাণ তো বগুড়ার ধনুট উপজেলা। গত ১৬ মে বগুড়ার ধুনট উপজেলায় স্নাতকের (সম্মান) এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় তাঁর মা-বাবাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। আমরা এ কেমন সভ্য সমাজে বসবাস করছি। বাবা হিসেবে মেয়ের ইজ্জত রক্ষার প্রতিবাদটুকু করতে পারছি না। প্রতিবাদ করলে হামলার শিকার হতে হয়। এ ঘটনায় ধুনট উপজেলার আবুল মুনছুর আহম্মেদের ছেলে নাফিজ ফয়সাল (আকাশ) কে পুলিশ তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করেছে।
১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে‘ নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে জাতিসংঘ ঘোষণা’ গৃহীত হয়। এতে নারীর প্রতি সহিংসতার সংজ্ঞায় বলা হয় ‘ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে জেন্ডারভিত্তিক যেকোনো সহিংসতা; যার ফলে নারীর শারীরিক, যৌন অথবা মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয় বা দিতে পারে। একই সঙ্গে এসব বিষয়ে হুমকি, বলপ্রয়োগ বা বঞ্চনা।’’ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএচও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মারফত জানা যায় যে, বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি, সেসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। দেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই জীবনে কখনো না কখনো সঙ্গীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিশ্বের ১৬১ টি দেশ ও অঞ্চলে নারী নির্যাতনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবদ্দশায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বামী দ্বারা যেসব নারী সহিংসতার শিকার হন তাদের প্রায় ৬৪ শতাংশ নারী তাদের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কখনো বলেননি। কারণ পরিবারের সুনাম রক্ষা করার স্বার্থে, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে নারীরা অনেক কষ্ট মুখ বুঝে সহ্য করেন। আবার কিছু ঘটনা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নিষ্পত্তি করে ধামাচাপা দেওয়া হয়। একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের দেশে বিবাহিত নারীরা প্রায় ৭০ শতাংশ স্বামী দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছেন। এর বাইরেও অবিবাহিত নারীরা নিয়োগকর্তা কিংবা সহকর্মীদের দ্বারা, সমাজের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন। এটা বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র। এই প্রবণতা রুখতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ সনের ৮নং আইন এর ৩৫টি ধারার ভেতর ৯ নং ধারায় ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এ ধারায় ৯ (১) এ তে বলা হয়েছে- যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। তারপরও নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। নারীর প্রতি সহিংসতা অতীতেও ছিল। ভবিষ্যতেও হয়ত থাকবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নারীরা যে মাত্রায় নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গবেষণার ভিত্তিতে গত ১০ বছরে দেশে অন্তত ৫ হাজার ৬০০ শিশু ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান জাতীয় মহিলা পরিষদ, বিবিএস এবং আইন ও শালিসকেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত নারী নির্যাতনের কিছু ঘটনা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রকাশ করেছেন। আর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসেই মোট ৮৫ জন কন্যা ও ১২০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এ তথ্য মহিলা পরিষদের নারী ও কন্যা নির্যাতনবিষয়ক মাসিক প্রতিবেদন (জানুয়ারি) অনুযায়ী। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৭ জন। তার মধ্যে ১৪ জন কন্যাসহ ২০ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ১ জন কন্যাসহ ২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
নারীর অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই নারীকে সমাজের চোখে অপরাধী ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়। নারী নিরপরাধ তা তাকেই প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যায় যিনি অপরাধী তিনি নিজেকে নিরপরাধ করার জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করেন। কিন্তু এখানে উল্টোটা। যিনি নিগৃহীত হয়েছেন তাকেই আবার প্রমাণ করতে হয় তিনি নির্দোষ। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নারীরাও আমাদের মতোই মানুষ। তারা এ সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অকল্পনীয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ইতিহাস তার সাক্ষী। সমাজ থেকে ধর্ষণ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক জনসচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রয়োজন Prevention is better than Cure অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই ভালো। এটা করতে পারলে নারীর জীবন ও ইজ্জত হয়ত কিছুটা হলেও লম্পট শ্রেণীর নিষ্ঠুর নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক