জাফর আহমাদ

আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: মু’মিন ব্যক্তি সরল ও ভদ্র প্রকৃতির হয়ে থাকে কিন্তু পাপীষ্ঠ ব্যক্তি ধোঁকাবাজ ও নির্লজ্জ হয়। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৭৯০, কিতাবুল আদাব, বাব বা পরিচ্ছদ: লোকজনের সঙ্গে উত্তমরূপে বসবাস করা, বুখারী ও তিরমিযি)

একজন মু’মিন যে কালিমা পাঠ করে ঈমান আনেন সেটিকে কালিমা তাইয়্যেবা বা পবিত্র কথা বলে অবিহিত করা হয়। সুতরাং কোন মু’মিন সহজ সরল ও ভদ্র প্রকৃতিরই হওয়ার কথা। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তুমি কী দেখছো না আল্লাহ কালিমা তাইয়্যেবার উপমা দিয়েছেন কোন জিনিষের সাহায্যে ? এর উপমা হচ্ছে যেমন একটি ভালো জাতের গাছ, যার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে পৌঁছে গেছে। প্রতি মহুর্তে নিজের রবের হুকুমে সে ফলদান করে। এ উপমা আল্লাহ তা’আলা এ জন্য দেন যাতে লোকেরা এর সাহায্যে শিক্ষা লাভ করতে পারে। অন্যদিকে অসৎ বাক্যের উপমা হচ্ছে, একটি মন্দ গাছ, যাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপড়ে দূরে নিক্ষেপ করা হয়,যার কোন স্থায়িত্ব নেই।” (সুরা ইবরাহিম : ২৪-২৫)

পৃথিবীর সর্বোত্তম কথা হলো কালিমাতুত তাইয়্যেবা তথা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু” অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই”। এটি এমন একটি বাক্য যার মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাত তাদের জীবনের ভিত রচনা করেন। যিনি কালিমা তাইয়্যেবার ভিত্তিত্বে নিজের জীবন ব্যবস্থাকে গড়ে তুলেন, তার চিন্তা-ধারায় পরিচ্ছন্নতা, স্বভাবে প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, চরিত্রে পবিত্রতা, আচরণে মাধুর্য, ব্যবহারে নম্রতা, লেনদেনে সততা, কথাবার্তায় সত্যবাদিতা, ওয়াদা ও অংগীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবন যাপনে সদাচার, কথা-বার্তায় চিন্তার ছাপ, চেহেরায় পবিত্রতার ভাব ফুটে উঠবে। মোট কথা ব্যক্তির সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক একটা পরিবর্তন সুচিত হবে। যার জীবনধারার কোথাও কোন অসঙ্গতি থাকবে না। সর্বোপুরি একজন মুমিন আল-কুরআন অনুযায়ী কথা বলবে এবং আল কুরআন অনুযায়ী কথা পরিত্যাগ করবে। আল-কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন চলার পথে কিছু জিনিষকে গ্রহণ করবে আবার কিছু জিনিষকে ত্যাগ করবে। একজন মুমিনই মুত্তাকী, একজন মুত্তাকীই মুমিন। আর এ মুমিন ও মুত্তাকীর জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অমূল্য উপহার হচ্ছে আল-কুরআন। আল্লাহ তা’আলা বললেন: “আলিফ-লাম-মিম। (এই নাও) সেই কিতাব (আল-কুরআন) তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, এটি মুত্তাকী লোকদের পথ দেখাবে।” (সুরা বাকারা-১-২) আল কুরআন তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মুমিন লোকদের ভালো-মন্দের পার্থক্য নিরূপণের জন্য এবং অন্ধকারে নিশ্চিন্তে পথ চলার শক্তি ও আলো যোগাবে। কুরআন বলবে কোনটি জান্নাতের পথ, আর কোনটি জাহান্নামের পথ। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ”আর এ কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী।” (সুরা-বাকারা-১৮৫)

তাই কোন মুমিন এমন কথা বলা উচিত নয়, যা একটি মারাত্মক বোমার চেয়েও ক্ষতিকর। একটি বোমা নির্দিষ্ট কিছু লোকের জান-মালের ক্ষতি করে থাকে। কিন্তু একটি খারাপ কথা সমাজ ভাঙ্গনের কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে থাকে। সমাজকে বিভিষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখী করে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধের স্থান দখল করে নেয় হিংসা-হানাহানি, বিদ্বেষ আর অহংবোধ। আর এর ফলে মানুষ চরম দুঃখ-দূর্দশার সম্মুখীন হয়। অথচ একজন মুমিন কখনো অন্য একজন মু’মিনকে কষ্ট দিতে পারে না। সে কথাটি যদি আবার সঠিক না হয়, কিংবা সেটি লক্ষ লক্ষ মানুষের মনোকষ্টের কারণ হয়, তাহলে ব্যাপারটি আরো মারাত্মক। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: “মু’মিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি মেহেরবাণী করা হবে।” (সুরা হুজরাত : ১০) “মানুষ খারাপ কথা বলে বেড়াক, তা আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না। তবে কারো জুলুম করা হলে তার কথা স্বতন্ত্র। আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।” (সুরা নিসা : ১৪৮)

হযরত আবু হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন : “প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জত হারাম।” (মুসলিম ও তিরমিযি) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) বলেন, নবী (সা:) বলেছেন: “এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে সহযোগীতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোন ব্যক্তির জন্য তার কোন মুসলমান ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করার মত অপকর্ম আর নেই।” (মুসনাদে আহমাদ) রাসুল (সা:) বলেছেন : “মুসলিম সে, যার মুখ ও হাত থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।” (সহিহ বুখারী)

এছাড়াও কুরআনের বহু আয়াত ও হাদীসে মন্দ কথা উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে যারা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান রাখেন, মন্দ কথা থেকে বিরত থাকা তাদের ঈমানী দায়িত্ব। কারণ কালিমা তাইয়েরা পৃথিবীর সর্বোত্তম কথা। এ কালিমাটি যিনি মনে প্রানে বিশ্বাস করেন, তার চরিত্রে একদিকে ভালো কথা, ভালো চিন্তা ও আচরণ, অন্য দিকে মন্দ কথা, মন্দ চিন্তা বা আচরণ একই সাথে সমান্তরাল বিরাজ করতে পারে না। মু’মিন সবসময় হাসিমুখে থাকবেন। মনে রাখতে হবে, হাসিমুখ আল্লাহর এক বিশেষ দান। হাসিমুখে কথা বলা রাসুলসহ (সা:) সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের সুন্নাহ। হাসির দ্বারা পৃথিবীকে জয় করা যায়। হাসি-খুশি লোকের মস্তিস্ক সাধারণত ঠাণ্ডা থাকে। তারা সদায় ইতিবাচক চিন্তা লালন করেন। আল্লাহর নবী (সা:) তাঁর মিশন পরিপূর্ণতা লাভ করার পেছনে দাওয়াত ও তাবলীগের অবদান যতটুকু তার চেয়েও বেশী তাঁর চারত্রিক মাধুর্যতার অবদান। মুচকি হাসি তাঁর চরিত্র মাধুর্যকে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছিল। হাসিমাখা লোককে আল্লাহ ভালবাসেন। পৃথিবীর মানুষেরা ভালবাসে। সার্বিকভাবে তিনি মানুষের ভালবাসার পাত্রে পরিণত হন। বাংলা পাঁচের মতো মুখকে মানুষ ভালবাসে না। মানুষ সাধারণত তাকে এড়িয়ে চলে। কেউ তার দ্বারে কাছে ভীড়তে চায় না। বাংলা পাঁচ বা রাশভারী লোক কখনো বন্ধু বৎসল হয় না, সদালাপী হয় না। সে সহজভাবে কাউকে গ্রহণ করতে পারে না। মানুষ প্রাণখুলে কথা বলার জন্য এ ধরণের মানুষ পছন্দ করে না।

সার্বক্ষণিক হাসিমুখ বা হাসিখুশি ভঙ্গি মানুষের অসাধারণ একটি গুণ এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। রাসুলুল্লাহ (সা:) এই গুণের অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে তিনি মুচকি হাসতেন। আরবীতে এটিকে ‘তাবাসসুম’ বলা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) এর চেয়ে অধিক মুচকি হাস্যকারী ব্যক্তি কাউকে দেখিনি।” (শামায়েলে তিরমিযি:১৬৮, বাবু মা জায়া ফি দাহকি রাসুলিল্লাহ (সা:), হাদীসটি সহীহ, আহমাদ:১৭৭৫০, শারহুস সুন্নাহ:৩৩৫০) উল্লেখিত রাবী একই ধরনের আরেকটি হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা:) সবসময় মুচকি হাসতেন। (শামায়েলে তিরমিযি : ১৬৯) জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসুলুল্লাহ (সা:) তাঁ গৃহে প্রবেশ করতে কোনদিন আমাকে বাধা প্রদান করেননি এবং যখনই আমাকে দেখেছেন, মুচকি হাসি দিয়েছেন।” (বুখারী : ৩৮২২, কিতাবু ফাযায়িলি সাহাবী, বাবু যিকরু জারীর.. .., ইফা : ৩৫৪৬) সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের মুখে মুছকি হাসি থাকতো।

পাপিষ্ঠ বা পাপাচারীর কিছু বৈশিষ্ট্য সুরা কলমের ১০-১৩ পর্যন্ত পাওয়া যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তুমি অবদমিত হয়ো না তার দ্বারা যে কথায় কথায় শফত করে, যে মর্যাদাহীন। যে গীবত করে, চোগলখোরী করে বেড়ায়, কল্যাণের কাজে বাধা দেয়, জুলুম ও বাড়াবড়িতে সীমালংঘন করে, চরম পাপিষ্ঠ ঝগড়াটে ও হিংস্র এবং সর্বোপুরি বজ্জাত।” (সুরা কলম : ১০-১৩) আয়াতে (মাহিনিন) শব্দটি নগণ্য, তুচ্ছ এবং নীচু লোকদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। কথায় কথায় শপথকারী ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সে কথায় কথায় কসম খায় কারণ সে নিজেই বুঝে যে লোকজন তাকে মিথ্যাবাদী মনে করে। কসম না খাওয়া পর্যন্ত লোকেরা তাকে বিশ্বাস করবে না। তাই সে নিজের বিবেকের কাছে হীন এবং সমাজের কাছেও তার কোন মর্যাদা নেই। খায়ের বা কলাণের কাজে সে বাধা দেয়। খায়ের সম্পদ ও যাবতীয় ভাল কাজকেও বলা হয়। পাপিষ্ঠরা সম্পদ দ্বারা কল্যাণের কাজকে বাধাগ্রস্থ করে মানে সে অত্যন্ত বখীল এবং কৃপণ। কাউকে কানাকড়ি দেয়ার মত উদারতা এবং মন মানসও তার নেই। সাধারণ অর্থে তারা প্রতিটি কল্যাণের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করে। ইসলাম যেহেতু কল্যাণমূলক জীবন ব্যবস্থা তাই তারা ইসলাম থেকে মানুষকে দুরে সরিয়ে রাখতে অত্যন্ত তৎপর। এরা যানীম অর্থাৎ অন্যায় ও দুস্কৃতি কারণে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে।

লেখক : ব্যাংকার।