জসিম উদ্দিন মনছুরি
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দীর্ঘদিন আলোচনার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের প্রস্তাবনা প্রস্তুত করে কমিশনের সভাপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পেশ করেছেন। এর আগে ১৭ অক্টোবর ২০২৫ সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে ২৫টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে। দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দল জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি প্রদানের জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। অন্যদিকে বিএনপি জুলাই সনদকে পরবর্তী সংসদে কার্যকর করার জন্য বলে আসছিল। অবশেষে সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড.আলী রিয়াজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৭ অক্টোবর ২০২৫ ঐতিহাসিক জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রাষ্ট্রচিন্তকগণ। জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তিনটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্ডাম এবং গণভোটের মাধ্যমে।
যদিও রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। কিন্তু গণভোট কখন হবে তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সাথে গণভোট করার জন্য বিএনপি’র পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়। জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে নভেম্বরের মধ্যে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য গণভোট আয়োজনের জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আসছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে সমমনা দলগুলোর নির্বাচনের আগে নভেম্বরের মধ্যে গণভোট সম্পন্ন করতে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সাথে গণভোট হওয়াকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। গণমাধ্যম জরিপে দেখা গেছে নির্বাচনের আগে গণভোট এবং জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য পক্ষে ভোট পড়েছে প্রায় ৬১ লক্ষ প্লাস। অন্যদিকে না এর পক্ষে ভোট পড়েছে ১৭ লক্ষ প্লাস। জুলাই সনদ ও গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মূলত দু’ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে সমমনা দলগুলো কঠোর অবস্থানে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী সংসদ নির্বাচন ও নভেম্বরে গণভোটের আয়োজনের। বিএনপির দাবি নির্বাচনের আগে গণভোট করার কোন সুযোগ নেই। জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই সাথে সম্পন্ন করা যেতে পারে এবং পরবর্তী সংসদে জুলাই সনদের স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আস্থা-গণভোট, ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের সামরিক শাসনের গণভোট, এবং সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সাংবিধানিক গণভোট। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে। স্বৈরাচার পতনের পর জনগণ প্রচলিত রীতি থেকে বেরিয়ে এসে সরকার গঠনের জন্য মত দিচ্ছেন। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ জনগণের প্রত্যাশা ও দাবি হচ্ছে বিগত স্বৈরাচারী শাসকের মতো বাংলাদেশে যেন আর কোন স্বৈরাচারীর উদ্ভব না ঘটে। জনগণ স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পায়, ব্যাপক দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা, সশস্ত্র বাহিনীর হত্যা-গুমের মতো মারাত্মক অপরাধের শাস্তি হয়। সে ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আলাপ আলোচনার পর জুলাই সনদের প্রস্তাবনা প্রণয়ন এবং জুলাই সনদে স্বাক্ষর সম্পন্ন করেছেন। এবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পালা। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি এবং গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের যথার্থতা নিরূপণের জন্য অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও ইতোমধ্যে বিএনপি জুলাই সনদের এবং গণভোটের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যেন গণভোট অনুষ্ঠিত না হয়। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো চায় নির্বাচনের আগে নভেম্বরের মধ্যে গণভোটের আয়োজন। জনগণ যদি গণভোটে জুলাই সনদ ও সংস্কারকে হ্যাঁ বলে তাহলে জুলাই সনদের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন এবং সংস্কারগুলো কার্যকর করতে অধ্যাদেশ জারি করা। কিংবা পরবর্তী সংসদে পাস করার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।
পিআর পদ্ধতি নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি ছিল ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা। তাহলে সরকার স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ পাবে না। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে থাকবে এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার শক্তিশালী হবে। পিআর পদ্ধতি নিয়ে চলমান বিরোধের নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। নির্বাচন কি পদ্ধতিতে হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে ফেলেছে। জামায়াতে ইসলামীর তথ্য মতে, তারা প্রায় ৩০০ আসনেই চূড়ান্ত করেছে। অন্যদিকে বিএনপিও প্রতিটি বিভাগে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
জনগণ প্রচলিত রীতি ও পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। যার প্রমাণ মিলেছে তরুণদের ভোটের মাধ্যমে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ থাকায় ছাত্রলীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও বিএনপির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। নারীদের ভোট নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আগে ছাত্রশিবিরকে নারীরা তেমন একটা পছন্দ করত না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ছাত্রশিবিরের ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, ছাত্রদের উন্নয়নে ব্যাপক প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা এবং তাদের উদার রাজনীতি ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করে নিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে তাদের এ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনের মাঠে বিএনপি’র চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। তাদের একক প্রার্থী হওয়ায় প্রার্থীর পক্ষে দলীয় সমর্থক ও কর্মীরা জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি’র অন্তদ্বর্ন্দ্বের কারণে এখনো তারা চূড়ান্তভাবে প্রার্থী দিতে পারেনি।
তাছাড়া গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি’র ও ছাত্রদলের ব্যাপক লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও হত্যাকাণ্ডের কারণে তাদের থেকে জনগণ বিমুখ হচ্ছে। যদিও বিএনপি নেতাদের দাবি ডাকসু থেকে রাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তকদের মতে ডাকসুকে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করা হয়। ডাকসুতে যারা বিজয়ী হন তারাই পরবর্তীতে সরকার গঠন করতে পারেন। তরুণদের মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগায় তারা পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ জামায়াতে ইসলামীকে বেছে নিচ্ছে বলে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে। জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।গ্রাম-গঞ্জ ও শহর থেকে শুরু করে সবখানে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা নির্বাচনী মাঠ গরম করে রেখেছেন। জরিপে দেখা গেছে তরুণ ভোটাররা এবং শহর এলাকার ভোটাররা জামায়াতে ইসলামীর প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। প্রবীণ এবং সাধারণ মানুষ বিএনপি’র প্রতি এখনো সমর্থন রাখলেও নির্বাচনী হাওয়া মুহূর্তে ঘুরে যাচ্ছে।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যদি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে যদি জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হয়; গণভোটের বিরোধিতা করা বিএনপির জন্য এটা হবে সবচাইতে বড় পরাজয়। ইতোপূর্বে ছাত্রদের নির্বাচনে তারা পরাজিত হয়ে তাদের নড়বড়ে অবস্থা শুরু হয়েছে। এমতবস্থায় যদি আগামী নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, গণভোটে যদি তাদেরকে জনগণ বর্জন করে তাহলে দেশের রাজনীতি ভিন্নদিকে মোড় নিচ্ছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। ইতোপূর্বে প্রায় আন্তর্জাতিক বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কূটনীতিবিদরা জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। আমেরিকা, ফ্রান্স, চীন, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। ভারত একমাত্র রাষ্ট্র যারা তাদের তাবেদার হিসেবে আওয়ামী লীগকে অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর ভারত এখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজেদের তাবেদার সরকার গঠনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও ইসকনের মতো জঙ্গি সংগঠন দিয়ে বাংলাদেশকে স্থিতিশীল করার জন্য তারা সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ অধিকতর সচেতন হওয়ায় ভারতের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। এবার দেখার বিষয় গণভোট ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আগে হয় নাকি সংসদ নির্বাচনের সময় হয়। জনগণ চায় যেন তেন নির্বাচনের মত নির্বাচন দিয়ে ভারতের তাবেদার কোন সরকারকে বসানো না হয়। আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভকারী দল হবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার এবং জনগণের সরকার। যে সরকারের কাছে জনগণ সাম্য ও মানবাধিকার ফিরে পাবে। সরকার হবে না জনগণের বিরোধী এবং স্বেচ্ছাচারী। অর্থপাচার, হত্যা, গুম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি থেকে দেশের জনগণ মুক্তি পেতে চায়। ব্যাপক সংস্কারের পক্ষে জনগণের সমর্থন রয়েছে।
এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত জনমত জরিপ যাচাই ও জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য এবং জুলাই সনদকে এর ভিত্তিতে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট সম্পন্ন করা। জনগণের দাবি ও প্রত্যাশা আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠিত হোক। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের নিজেদের পছন্দ নিজেরা খুঁজে নিক। জনগণের প্রত্যাশা ১৫০০ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান যেন বিফলে না যায়। সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে রচিত জুলাই সনদ যেন অমূল্য দলিল হিসেবে জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। জুলাই সনদের ধারাগুলো নিয়ে জনগণ ঐক্যবদ্ধ এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণ অধীর আগ্রহে রয়েছেন। সুতরাং জনগণের দাবি ও প্রত্যাশা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন। জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য গণভোট অবশ্যই প্রয়োজন। তা যেন হয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আগে এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন সম্পন্ন হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক।