DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

গণতন্ত্রের উত্থান-পতন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পথপরিক্রমা এক দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তাক্ত ইতিহাসের অংশ। পৃথিবীতে এতো অধিক মূল্য দিয়ে কোন জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, ইতিহাসে তেমন নজির খুব একটা দেখা যায় না।

Printed Edition
Default Image - DS

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পথপরিক্রমা এক দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তাক্ত ইতিহাসের অংশ। পৃথিবীতে এতো অধিক মূল্য দিয়ে কোন জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, ইতিহাসে তেমন নজির খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা পরবর্তীতে আমাদের গণতন্ত্রের পথচলা খুব একটা নির্বিঘ্ন হয়নি বরং নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়েই চলতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ভারত বিভাজিত হয়ে বিশ্ব মানচিত্রে পাকিস্তান নামের নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলেও অবিভক্ত পাকিস্তানেও গণতন্ত্রের পথচলা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না বরং স্বৈরাচারি ও সামরিক শক্তির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে পাকিস্তানের গণতন্ত্র বারবারই হোঁচট খেয়েছে। ফলে পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখা সম্ভব হয়নি।

মূলত, পাক শাসকগোষ্ঠীর গণতন্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধার কারণেই এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। কিন্তু দেশে উদার গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে দেশ স্বাধীন করা হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারও স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা নির্বিঘ্ন করতে পারেনি বরং তারা নিজেরাই গণতন্ত্র টুঁটি চেপে হত্যা করেছে। আবার তা করা হয়েছে গণতন্ত্র রক্ষার নামেই। যা আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।

মূলত, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনিস্টার রীতির গণতন্ত্রের সাথে যুক্ত। অবশ্য বাংলাদেশ ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। আর ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশ নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করে। কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রের পথচলা মোটেই নির্বিঘ্ন হয়নি বরং যারা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের অধিকারের কথা বলে জাতিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারাই গণতন্ত্র হত্যা করে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করে। যা ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা। তবে ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। জনমনে খানিকটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসে। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা জবরদখলের পর আমাদের গণতন্ত্রকে নতুন করে বৃত্তাবদ্ধ করা হয়। এরপর শুরু হয় গণতন্ত্রে ফেরার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ১৯৯০ সালে তা পূর্ণতা পায় এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে আবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হয়। তবে দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। গণআন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় আমরা ধরে রাখতে পারিনি।

এবার শুরু হয় দেশের গণতন্ত্র হত্যার আন্দোলন এবং ২০০৬ সালে এসে পূর্ণতা পায়। রাজপথে চলে লগি-বৈঠার তাণ্ডব। রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর পৈশাচিক ও দানবীয় নৃত্য চালানো হয়। ফলে একটি সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকারের পতন ঘটে এবং গঠিত হয় এক অসাংবিধানিক জরুরি সরকার। এ সরকারই দেশে নতুন করে গণতন্ত্র হত্যার দৃশ্যপট তৈরি করে এবং ২০০৮ সালে সাজানো ও পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা হয়। আর তখন থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যার পথ সুগম হয় এবং পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সে ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। বিরাজনীতিকরণের অংশ হিসাবে সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রাজনৈতিক নেতাদের নির্মূল করতে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠে।

২০১৩ সালে দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীকে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। তখন থেকেই দলটিকে রাজপথে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়নি বরং লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হাজার হাজার মামলা দিয়ে তাদেরকে কারারুদ্ধ করে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়। এখানেই শেষ নয় বরং কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে দলটির শীর্ষনেতাদের একের পর এক হত্যা করে পুরো দেশকেই বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ভাগ্যেও জোটে একই ধরনের পরিণতি।

এরপর আসে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচন ছিলো একতরফা। ফলে ১৫৪ আসলে সরকারদলীয় প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে বিনা ভোটেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যা বিশ্বের তাবৎ গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক নতুন বিস্ময়। মূলত, কথিত দশম সংসদ নির্বাচন কোনভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল না বরং তা ছিলো ক্ষমতাসীনদের চরদখলের মহড়া। সে নির্বাচনে ঢাকার ২৯ টি কেন্দ্রে কোন ভোটার উপস্থিতি লক্ষ্য করা না গেলেও বশংবদ নির্বাচন কমিশন প্রায় ৪০% ভোটার উপস্থিতি দেখায়। কথিত এ নির্বাচনে স্বীকৃত সকল বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে এবং এর ফলে বর্তমান আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচনটির ব্যাপক সমালোচনা করলেও সে নির্বাচনকে ভিত্তি ধরেই সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করতে কোন সমস্যা হয়নি। দেশ ও জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আওয়ামী-ফ্যাসিবাদী চরিত্র।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। কিন্তু এ নির্বাচনে ভোট কারচুপি এবং অন্যায্যতার অভিযোগ ওঠে ব্যাপকভাবে। এমনকি এ নির্বাচনকে নৈশকালীন নির্বাচন হিসাবেও আখ্যা দেওয়া হয়। কারণ, প্রশাসনের লোকেরাই ভোটের আগের দিন রাতেই সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে বাক্স ভর্তি করে ফেলে। কথিত এ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হলেও এ সংসদের মেয়াদ পূর্তিতে কোন সমস্যা হয়নি। এরপর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনেও অতীতের ভোট চুরির মহড়া প্রদর্শন করা হয়। বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে গণহারে সিল মারা হয় এবং এক সাজানো-পাতানো ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী বাকশালীদের ক্ষমতার মেয়াদ ৫ বছরের জন্য বাড়িয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এ যাত্রায় আওয়ামী বাকশালীদের শেষ রক্ষা হয়নি বরং ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার যুগপৎ বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হারাতে হয় এবং দলীয় নেতাসহ সকল মন্ত্রী-এমপি পালিয়ে যান অথবা গা ঢাকা দেন। এমনকি জাতীয় মসজিদের খতিবসহ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যানরাও পালাতে বাধ্য হন। যা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন।

গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও আমাদের পথচলা মোটেই নির্বিঘ্ন হয়নি বরং নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্যে দিয়েই চলতে হয়েছে। আর এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অবৈধ ক্ষমতালিপ্সা ও বিভাজনের অপরাজনীতিই ছিল মুখ্য। এদের সাথে যুক্ত ছিলো জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি। দেশে বারবার গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হলেও তা কোনভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি বরং গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বৈরি শক্তি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বারবারই গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে দেশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে বানানো হয়েছে দলদাস কমিশনে। কিন্তু এতোকিছুর পরও আমাদের দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ থেমে থাকে নি বরং গত ৫ আগস্ট সংগ্রামী ছাত্র-জনতা নতুন এক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন আশাবাদের।

মূলত, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথচলা কখনোই স্থিতিশীল, নির্বিঘ্ন ও ইতিবাচক ছিলো না বরং নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়েই পথ চলতে হয়েছে। যা সাম্প্রতিক বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক সূচকে বারবারই ওঠে এসেছে। সে ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ২০২৪ সালের বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করেছে। যা বেশ হতাশাব্যঞ্জক বলেই মনে করা হচ্ছে। সূচকে আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশের অবনতি ঘটেছে ২৫ ধাপ। যা ছিল আওয়ামী-বাকশালী ব্যর্থতার অন্যতম দলিল। সম্প্রতি বিশ্বের ১৬৫টি দেশ ও দু’টি অঞ্চলের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ইআইইউ এ সূচক প্রকাশ করা হয়েছে। যা আওয়ামী আমলের দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইনটেলিজেন্স ইউনিটের এ সূচক পাঁচটি মানদণ্ড নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুদলীয় ব্যবস্থা, সরকারের কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বের ১৬৫ দেশ ও দু’টি অঞ্চলের গণতন্ত্র পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ১০ স্কোরের ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়। এবারের সূচকে ২৫ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। ২০২৪ সালে বিশ্বের আর কোনও দেশ গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের মতো এত পেছায়নি। মানদণ্ড বিবেচনা করে পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, মিশ্র শাসনব্যবস্থা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা-এ চার শ্রেণিতে সূচক তৈরি করা হয়েছে। ইকোনমিস্টের মতে, কোনও দেশের গড় স্কোর ৮ এর বেশি হলে পূর্ণ গণতন্ত্র, ৬ থেকে ৮ হলে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, ৪ থেকে ৬ হলে মিশ্র গণতন্ত্র এবং ৪ এর নিচে হলে সেই দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা জারি রয়েছে। ২০২৩ সালে ইআইইউয়ের সূচকে ৫ দশমিক ৮৭ স্কোর নিয়ে ৭৫তম স্থানে ছিল বাংলাদেশ। ২০২২, ২০২১ ও ২০২০ সালে এ সূচকে ৫ দশমিক ৯৯ স্কোর নিয়ে মিশ্র শাসনব্যবস্থার দেশের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। একই সূচকে ২০১৯ সালে ৮৮তম স্থানে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৫৭। ইআইইউ বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্কোর ৪ দশমিক ৪৪। এ সূচকে বাংলাদেশ মিশ্র শাসনব্যবস্থার দেশের তকমা পেয়েছে।

ব্রিটিশ এ সাময়িকী ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করে। ওই বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬ দশমিক ১১। ২০০৭ সালে ৫ দশমিক ৫২, ২০০৮ সালে ৫ দশমিক ৮৭, তারপরের তিন বছর বাংলাদেশের স্কোর একই ছিল; ৫ দশমিক ৮৬। ২০০৬ সালে প্রকাশিত প্রথম গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায়। ওই বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬ দশমিক ১১। এরপরের বছর গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে বাংলাদেশ মিশ্র শাসনব্যবস্থার দেশের তালিকায় ঢুকে যায়। তখন থেকেই ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের বিচারে মিশ্র শাসনব্যবস্থার দেশ হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ। ইআইইউ মিশ্র শাসনব্যবস্থার সংজ্ঞায় বলেছে, যেসব দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়, সেসব দেশকে মিশ্র শাসনব্যবস্থার বলা হয়।

এ শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের ওপর সরকারের চাপ, বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, সাংবাদিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি ও হয়রানি করা হয়। এছাড়া দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, দুর্বল আইনের শাসন, দুর্বল নাগরিক সমাজ এই শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। ইআইইউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের গণতন্ত্র সূচকে বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অবনতি ঘটেছে বাংলাদেশের। দেশটির স্কোর ১ দশমিক ৪৪ পয়েন্ট কমে ৪ দশমিক ৪৪-এ দাঁড়িয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়ারও সূচকে উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে। ২০২৪ সালে সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রের ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে এই দুই দেশ।

বাংলাদেশের বিষয়ে ইআইইউ বলছে, পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০২৪ সালে যেকোনো দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্কোর পরিবর্তনের রেকর্ড হয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ ১৬৭টি দেশের মধ্যে ২৫ ধাপ পিছিয়ে যৌথভাবে ১০০তম স্থানে নেমে গেছে। বাংলাদেশের সমান স্কোর নিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিনও ১০০তম অবস্থানে রয়েছে। ইআইইউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনে কারচুপি সত্ত্বেও তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন বাংলাদেশে পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুব-নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ তরুণ প্রজন্মের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে; যারা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ক্রমবর্ধমান হারে হতাশ হয়ে পড়ছে। এ সূচকে ৯ দশমিক ৮১ স্কোর নিয়ে গত বারের মতো সবার ওপরে আছে নরওয়ে। নিউজিল্যান্ড ২০২৩ সালের মতো এবারও সূচকের দ্বিতীয় স্থানে আছে। সুইডেন আছে তৃতীয় স্থানে। এরপরই চতুর্থ অবস্থানে আছে আইসল্যান্ড।

অন্যদিকে এবারের এ তালিকায় গত বছরের মতো একেবারে তলানিতে জায়গা করে নিয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। স্বৈরশাসকের অধীনে থাকা মিয়ানমার ১৬৬তম স্থানে আছে। এছাড়া বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন কোরীয় দ্বীপের উত্তর কোরিয়া আছে ১৬৫তম স্থানে। ২০২৩ সালে এ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৭ দশমিক ৪১ স্কোর নিয়ে শীর্ষে ছিল ভারত। দেশটির অবস্থান আগের বছরের মতো ২০২৪ সালেও ৪১তম স্থানে উঠে এসেছে। ১৬৫ দেশের এ তালিকায় পাকিস্তান আছে ১২৪তম স্থানে। গত বছরের তুলনায় এ সূচকে ১৪ ধাপ অবনতি ঘটেছে পাকিস্তানের। এরপর রয়েছে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ৬৭তম, ভুটান ৭৯তম ও নেপাল ৯৬তম।

আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক সূচকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রোর ওঠা-নামা করলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমই বলতে হবে। কারণ, সাম্প্রতিক সূচকে আমাদের গণতন্ত্রের ২৫ ধাপ অবনমন ঘটেছে। এমনিতেই আমাদের অতীত রেকর্ড বা সূচক কোনভাবেই ইতিবাচক ছিল না। এরপর বছরান্তে সূচকে ২৫ ধাপ অবনমন আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার ভঙ্গুর পরিস্থিতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মূলত, দেশে গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জিত হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো দেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য কোনভাবেই আন্তরিকতা দেখায় নি বরং ক্ষেত্রবিশেষে তারাই গণতন্ত্রের বড় ধরনের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পতিত আওয়ামী লীগ ছিল এ বিষয়ে অধিক করিৎকর্মা। যা এখন আর কারো কাছে অপ্রকাশ্য নেই।

তবে আগস্ট বিপ্লবের পর আমাদের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখনো শঙ্কাটা পুরোপুরি কেটে যায়নি। কারণ, পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তাদের প্রতিভূরা এখনো নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এমতাবস্থায় দেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও মজবুত ভিত্তি দিতে হলে ক্ষুদ্র মতপার্থক্য ভুলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। অন্যথায় দেশ ও জাতি অতীতের অশুভ বৃত্তে আটকা পড়বে।