‘স্কুলে ভেঙে পড়ল বিমান, নিহত ২২’ মঙ্গলবারের পত্রিকায় এটাই প্রধান শিরোনাম। পুরো আটটি কলামও যেন শিরোনামটি ধারণ করতে পারেনি। ঘটনাটি এতটাই ভয়াবহ ও মর্মান্তিক যে, রাষ্ট্রীয় শোকদিবস ঘোষণা করেছে সরকার। অন্যদিনগুলোর মতো মঙ্গলবারও শিশু-কিশোররা এসেছিল রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। নিয়ম মাফিক লেখাপড়া চলছিল, চলছিল কলকাকলিও। শিক্ষার্থীদের কেউ ক্লাস করছিল, কেউ বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাইরে অপেক্ষা করছিলেন অভিভাবকরা। চেনা এমন পরিবেশটা সোমবার দুপুরেও লক্ষ্য করা গেছে মাইলস্টোন প্রাঙ্গণে। কিন্তু হঠাৎ শোনাগেল বিকট এক শব্দ। মুহূর্তেই আগুন, ধোঁয়া, চিৎকারÑসবকিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। এমন বীভৎস পরিস্থিতির জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। পরে জানা যায়, বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান স্কুল চত্বরের একটি দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত চীনের তৈরি যুদ্ধবিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে স্কুল ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বেলা ১টা ৬ মিনিটে রাজধানীর কুর্মিটোলা বিমান বাহিনীর এ কে খোন্দকার ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর বিমানটি স্কুল ভবনের ওপর এসে বিধ্বস্ত হয়। বেলা ১টা ১৮ মিনিটে বিমান বিধ্বস্তের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই আগুন ধরে যায় স্কুল ভবনে। তখন দগ্ধ শিশুদের আর্তনাদ, মা-বাবা ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে ওই মর্মান্তিক ঘটনায় অন্তত ৩১ জন নিহত এবং অন্তত ১৭১ জন আহত হওয়ার কথা জানা গেছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্কুল ছুটির সময় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। তখন কেউ ক্লাসে ছিল, কারও কোচিং চলছিল। যে ভবনটিতে বিমান আছড়ে পড়ে, সেটির পাশে ছিল শিশুদের খেলার দোলনা। কেউ কেউ তখন দোলনায় ছিল। এসব কারণে হতাহতদের বেশিরভাগই শিশু। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার পরপরই শুরু হয় উদ্ধার কাজ। ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, আনসার, স্কাউটসহ স্বেচ্ছাসেবীরা। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান অনেকেই। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো: তৌকির ইসলামও বেঁচে নেই। হতাহতদের উদ্ধার করে নেওয়া হয় বিভিন্ন হাসপাতালে। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন হতাহতদের স্বাজনরা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের অধিকাংশই দগ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাছাড়া নিহতদের মধ্যে অনেকের চেহারা এমনভাবে ঝলসে গেছে যে তাদের চেহারা চেনা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যাদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা যাবে না, তাদের মৃতদেহ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে পরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডিতে পুরো জাতি স্তব্ধ।
যে কোনো দুর্ঘটনার পরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়, জাগে নানা প্রশ্নও। যেমন এখনকার প্রশ্ন, জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমানের মহড়া কেন? অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশের জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণের জন্য ফ্লাইট পরিচালনা করা হয় না। প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে লোকালয়ের বাইরে, যাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি না হয়। উল্লেখ্য, ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে প্রশিক্ষণ বিমান ও শিডিউল বিমানের ফ্লাইট এক সঙ্গে পরিচালনা করা হচ্ছে, যা আর কোথাও নেই বলে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। প্রশিক্ষণ বিমানের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মাইলস্টোন স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি চীনের তৈরি। আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমানটির মডেল ছিল এফটি-৭ বিজিআই। এটি বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বিমান বাহিনী ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ দু’জন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, যে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি দিয়ে প্রশিক্ষণের পর পাইলটদের মূল যুদ্ধবিমান চালাতে দেওয়া হয়। জনমনে প্রশ্ন, বাংলাদেশ কোন মানের বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করে, যাতে পাইলটকে প্রাণ হারাতে হয়? এমন দুর্ঘটনা তো আরো ঘটেছে। সামরিক সরঞ্জাম সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট গ্লোবাল সিকিউরিটি ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, এফটি-৭ বিজিআই মডেলের বিমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন। এটি স্বল্পখরচে নির্মিত, এক ইঞ্জিনচালিত ও দু আসন বিশিষ্ট একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। মূল সংস্করণ এফ-৭ এর জন্য পাইলটদের প্রস্তুত করতে এফটি-৭ বিজিআইয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ এসব যুদ্ধবিমান কবে ক্রয় করেছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়নি। তবে বিমান বহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, এফটি-৭ বিজিআই সংস্করণটি বাংলাদেশ ২০১৩ সালে চীন থেকে কিনেছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন ক্যাপ্টেন বলেন, একটি যুদ্ধবিমানের কার্যকাল থাকে ১০-১২ বছর। আবার দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে বিমানে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায়, ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এফটি-৭ যুদ্ধবিমানের উৎপাদন বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। সব মিলিয়ে উপলব্ধি করা যায়, যে বিমান দিয়ে বাংলাদেশের পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তা মোটেও সঙ্গত নয়। এসব বিমান তো বাংলাদেশ ক্রয় করেছে সেই ২০১৩ সালে, এখন তো ২০২৫ সাল। এতদিনেও কি প্রশিক্ষণের জন্য উন্নত বিমান ক্রয়ে সামর্থ্য বাংলাদেশ বিমানবাহিনী অর্জন করেনি? নাকি দুর্নীতির পাপ তাদের অনেকের মেধা-মনন, দেশপ্রেম সবকিছু গ্রাস করে নিয়েছে? ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুর্নীতিবাজ সরকার শুধু বিমানবাহিনী নয়, দেশর সব সেক্টরেই দুর্নীতির প্রসার ঘটিয়ে গেছে। তার মন্দ ফল এখন পুরো জাতি ভোগ করছে। যার মর্মান্তিক এক উদাহরণ মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডি।
মাইলস্টোন স্কুলের মর্মান্তিক ঘটনায় পুরো জাতি যখন শোকে স্তব্ধ তখন মাইলস্টোন স্কুল এলাকা এবং সচিবালয়ে লক্ষ্য করা যা ফ্যাসিবাদী তা-ব। সরকার যখন পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন সহযোগিতার বদলে একটি মহল শুরু করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মন্দ আচরণ। ছাত্রদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার পরও দুই উপদেষ্টাকে প্রায় ৯ ঘণ্টা আটক করে রাখা হয় মাইলস্টোন স্কুলে। এছাড়া নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রবেশ করে তা-ব চালিয়েছে কয়েকশ’ উচ্ছৃঙ্খল বিক্ষোভকারী। এদের পেছনে সক্রিয় ছিল নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। সচিবালয়ের ভেতরের গাড়ি ভাংচুর ও কর্মকর্তাদের নাজেহাল করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে তারা। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন সচিবালয়ের আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অংশ নিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আন্দোলনে অংশ নিতে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তার বক্তব্যের একটি অডিওও প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া মাইলস্টোন স্কুলের ছাত্রদের দাবি-দাওয়া দুই উপদেষ্টা মেনে নেওয়ার পর ছাত্ররা যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল, তখন সেখানে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে যুব লীগের সন্ত্রাসী রিয়াদ। সে ফেনীর রাজাপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সম্পাদক। ছাত্র-জনতা তাকে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. সারোার গণমাধ্যমকে জানান, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে উসকানি দিচ্ছে। ছাত্রলীগ ক্যাডাররা উত্তরায় উপস্থিত রয়েছে। তিনি নিজে উত্তরায় উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। জাতির শোকবিহ্বল এ পরিস্থিতিতেও ফ্যাসিবাদী শক্তি লাশ গুমের গুজব ছড়ালো। ওরা কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত নয়, ওরা সংশোধন হবার নয়। বরং ওরা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র করে চলেছে। আর মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে আমরা লক্ষ্য করলাম ফ্যাসিবাদের বিষাক্ত আঁচড়।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ফ্যাসিবাদের দেশী-বিদেশী দোসরদের অপতৎপরতা সম্পর্কে অবগত আছে। এজন্যই হয়তো দেশের প্রধান চার রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে সোমবার এক বৈঠকে মিলিত হলেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের দৃঢ় অবস্থানের কথা ব্যক্ত করলেন অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলের নেতারাও এই লক্ষ্যে সরকারের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। তবে আমরা মনে করি, লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সঙ্গত ভিত্তি থাকা প্রয়োজন এবং প্রয়োজন যথার্থ পদক্ষেপ। আমরা জানি, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি একদিনে ঘটেনি। সংকটের মূল উৎপাটনে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ তদন্ত। কেন জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমানের মহড়া? কেন ত্রুটিপূর্ণ ও পুরনো ধাঁচের বিমান দিয়ে পাইলটদের জীবন হুমকির মুখে ফেলা? কাদের দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এতটা পিছিয়ে পড়লো? এসব প্রশ্নের জবাব প্রয়োজন। মাইলস্টোনের ঘটনায় শিশুসহ যারা নিহত ও আহত হয়েছেন তাদের সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ প্রয়োজন। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়, জাতি তা পর্যবেক্ষণ করবে। কোনো চাতুর্য বা গাফলতি জাতি মেনে নেবে না। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায় অন্যায় ও বঞ্চনার সমুচিত জবাব দেবে ছাত্র-জনতা।
পরিশেষে স্মরণ করতে হয় মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরীকে। মানবতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এই শিক্ষক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বাঁচিয়ে গেছেন সন্তানতুল্য ছোট শিশুগুলোকে। মায়ের মমতা ও শিক্ষকের দায়িত্বশীলতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন তিনি। মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় সবাই যখন প্রাণে বাঁচার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে শিশু শিক্ষার্থীদের আগুনের ভেতর থেকে বের করায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তার প্রচেষ্টায় অন্তত ২০টি শিশু উদ্ধার পেলেও তিনি প্রায় শতভাগ দগ্ধ হয়ে যান। মুমুর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও জীবন রক্ষা হয়নি। দুনিয়া ছেড়ে তিনি চলে যান। আশা করি মহান আল্লাহ তাঁর কাজের উত্তম প্রতিদান দেবেন। তবে আমরা মনে করি, যে জাতির মধ্যে মাহেরিন চৌধুরীর মতো মহীয়ান মানুষের অবস্থান ছিলো, সে জাতির বিজয় অবশ্যম্ভাবি। ফ্যাসিবাদ কিংবা আগ্রাসী কোনো শক্তির কাছে এ জাতি মাথানত করবে না।