খালিদ হাসান বিন শহীদ

আল্লাহ তাআলা বছরের যে কটি মাসকে বিশেষ মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন মুহাররম তার অন্যতম। হাদিসের ভাষায় মুহাররমকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাছাড়া ফজিলত বিবেচনায় মুসলিমদের জন্য মাসটি অতি গুরুত্বপূর্ণও বটে। মুহাররম মাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মুহাররমের দশ তারিখ। হাদিসে আশুরার দিনের অনেক ফজিলত বিবৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামপূর্ব আরবের জাহেলি সমাজে এবং আহলে কিতাব-ইহুদি-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা। আশুরা দিবসকে কেন্দ্র করে রচিত ও সংকলিত হয়েছে ইতিহাসের নানা তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনাপ্রবাহ। নবী-রাসুলদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আশুরার মর্যাদাবাহী ঘটনা-উপাখ্যান-বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থগুলোয় খুঁজে পাওয়া যায়। বুখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিস থেকে এ দিনে সংঘটিত দুটি ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়; যার একটি হলোÑ ফেরাউনের নির্যাতনের কবল থেকে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মুক্তি। অন্যটি হলোÑ ফেরাউনের মৃত্যু। যখন আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট সাগরের অলৌকিক সড়ক দিয়ে মুসা (আ.) ও তাঁর সাথীরা নিরাপদে চলে যাচ্ছিলেন, তখন ফেরাউনও তার সৈন্যদল নিয়ে সে সড়ক দিয়ে তাদের ধাওয়া করছিল। কিন্তু পথিমধ্যে সে অলৌকিক সড়ক শূন্যে মিলে পানিতে একাকার হয়ে ফেরাউনের মৃত্যু হয়। এছাড়া কারবালার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিও আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। রচিত হয়েছে শোকাভিভূত এক নতুন অধ্যায়।

পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেনÑ ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২টি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা তাওবা : ৩৬) প্রিয়নবী (সা.) বলেনÑ ‘বারো মাসে এক বছর; এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিকÑ যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারি : ৪৬৬২) হাদিসে এ মাসকে শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেনÑ ‘(রমযানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মুহাররম বলে থাক।’ (নাসাঈ : ৪২১৬) হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেনÑ ‘রমযানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা।’ (মুসলিম : ১১৬৩) এ হাদিস থেকে মুহাররমের ব্যাপারে দুটি কথা পাওয়া যায় : এক. মুহাররম মাস আল্লাহর মাস; যা বিশেষ সম্মানিত ও মহিমান্বিত। দুই. এর সম্মান রক্ষা এবং এ থেকে যথাযথ উপকৃত হওয়ার একটি মাধ্যম হচ্ছে, এ মাসে রোজা রাখার প্রতি যত্নবান হওয়া।

যেভাবে এলো আশুরার রোজা : যখন রাসুলে কারিম (সা.) হিজরত করে মদিনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন; তখন লক্ষ করলেন মদিনার ইহুদীরাও এ দিনে রোজা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদযাপন করছে। নবীজি তাদের জিজ্ঞাসা করলেনÑ ‘এটি কী? তারা বলল, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা (আ.) রোজা পালন করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-কে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। অতঃপর তিনি নিজে রোজা রেখেছেন এবং অন্যদেরও রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বুখারি : ১৮৬৫) আরেক হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ (বুখারি : ২১৮) অন্য হাদিসে নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসলিম : ৩৬৭) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আশুরার রোজা রাখছিলেন এবং অন্যদেরকে রোজা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবিগণ বললেনÑ ইয়া রাসুলাল্লাহ! এ দিনকে তো ইহুদি-নাসারারা (একদিন রোজা রেখে) সম্মান করে? তখন নবীজি বললেনÑ ‘তাহলে আগামী বছর আমরা নয় তারিখেও রোযা রাখব- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আগামী বছর আসার পূর্বেই নবীজির ইন্তিকাল হয়ে যায়।’ (মুসলিম : ১১৩৪) আশুরার রোজা সম্পর্কে অণ্য এক হাদিসে এসেছেÑ ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখো।’ (মুসনাদে আহমদ :২৪১) উল্লেখিত হাদিস দুটির আলোকে আশুরার রোজা রাখার মুস্তাহাব পদ্ধতি হচ্ছেÑ মুহাররম মাসের নয় এবং দশ তারিখ অথবা দশ এবং এগারো তারিখ। যেহেতু ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে এক দিন রোজা রাখতো। তাই আল্লাহর রাসুল (সা.) মুসলমানদের নির্দেশ দেন আশুরার দিনটির আগে বা পরে আরও এক দিন মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখতেÑ যেন মুসলমানদের আমল ইহুদিদের আমলের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে না যায়।

কিছু দুর্বল বর্ণনা : মহান আল্লাহ এ দিনে প্রথম মানব আদম (আ.) কে সৃষ্টি করেন এবং জান্নাতে স্থান দেন। পরবর্তীতে এ দিনেই আদম-হাওয়া (আ.) কে দুনিয়ায় পাঠানো হয়। একইসাথে এ দিনেই তাঁরা আল্লাহর ক্ষমা লাভ করেন। মহান আল্লাহ পাক এ মুহররমের ১০ তারিখে সৃষ্টির সূচনা করেন। এ দিনে হযরত নূহ (আ.) এবং তাঁর সাথীরা বন্যা-প্লাবন থেকে মুক্তি পান। আশুরার দিন শুক্রবার ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। এ দিনই রাসুল (সা.)-এর পবিত্র ওজুদ (সৃষ্টি) মুবারক হয় এবং ইছমত, সম্মান ও খুছুছিয়ত এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়। উপর্যুক্ত এইসব ঘটনাবলি ছাড়াও আরো অসংখ্য কাহিনি আমাদের সমাজে চালু আছে। যেগুলোর সনদ দুর্বল হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসগণের বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে তা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

আশুরা সম্পর্কে ভুল ধারণা : ইসলাম সম্পর্কে বিশদ না জানার কারণে এবং জানার চেষ্টা না করার কারণেও উপমহাদেশে আশুরাসহ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে অসংখ্য ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। যা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না। এসব ধারণা সমূহ হলো: এ মাসে বিয়েশাদি না করা। নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা। কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা। গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা। পান না খাওয়া, নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক পরিধান না করা, সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা। সব ধরনের আনন্দ উৎসব পরিহার করা ইত্যাদি।

আশুরায় কিছু গর্হিত রেওয়াজ : আফসোসের বিষয় হচ্ছে, নেকির এ সময়কে ঘিরে সমাজে রয়েছে বিভিন্ন গলত রসম-রেওয়াজ এবং নানা রকমের বিদআতী কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে দশ মুহাররমে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ মাতমের যে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির অবতারণা করা হয় তা তো খুবই গর্হিত একটি সংস্কৃতি। ইসলামের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম মাতম ও শোক প্রকাশের এমন আয়োজনকে হারাম সাব্যস্ত করেছে। এরচে জঘন্য হল, এ দিনে ‘তাযিয়া’র নামে শিরক-বিদআতের আয়োজন করা। পরিতাপের বিষয়, শিয়াদের এমন আয়োজনগুলোতে ঢালাওভাবে অনেক মুসলমান অংশগ্রহণ করে থাকে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ফরয বিধানের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থাকার পাশাপাশি নফল বিধানাবলির ক্ষেত্রেও মনোযোগী হওয়ার তাওফীক দান করুন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।