আর্শিনা ফেরদৌস

আমাদের জাতীয় অর্থনীতি এখন খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনের ইতিহাসে এমন এক সোনালী অধ্যায় ছিল, যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিলো খুবই স্বস্তিদায়ক। ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিলো বেশ ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে ২০২১ সালে করোনাকালীন প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ বাড়ায় রিজার্ভ একসময় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলো। এ অর্জন ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এমতাবস্থায় বিশ্ব মিডিয়া বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উদাহরণ দিতে শুরু করে। যা ছিলো বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির জন্য রীতিমত ইতিবাচক দিক এবং বেশ সম্মানের।

তবে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হতে থাকে জাতীয় অর্থনীতি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের আধিপত্য বাড়ায় আমদানি খরচ রীতিমত বেড়ে যায়। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহেও কিছুটা ভাটির টান লক্ষ্য করা যায়। ব্যবসায়ীরা রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয়ে বেশি ব্যয় করতে থাকেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। ২০২৩ সালের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দাঁড়ায় আনুমানিক ৩১ বিলিয়নের ঘরে। এ সময় থেকেই তদানীন্তন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একাধিক নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পদক্ষেপগুলো হচ্ছে, বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ, এলসি খোলার ওপর কড়াকড়ি, হুন্ডির বিরুদ্ধে অভিযান ও ব্যাংকিং খাতে রেমিট্যান্স উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

মূলত, একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হলো সে অর্থ যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মুদ্রায় সংরক্ষণ করে রাখে। আর ডলার, ইউরো, ইয়েন বা গোল্ডেই রিজার্ভ রাখা হয়। এ অর্থ দিয়ে দেশ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি, বৈদেশিক ঋণের সুদ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ নেয়া সম্ভব হয়।

বস্তুত, রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বলয়ের মতো কাজ করে। আর যে দেশের রিজার্ভ যত সমৃদ্ধ ও সে দেশের জাতীয় অর্থনীতিও ততই মজবুত। সঙ্গত কারণেই রিজার্ভ যখন কমে যায়, তখন টাকার মান পড়ে যায়, ডলার সংকট তৈরি হয়, আমদানি ব্যয় বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সব সময়ই সমৃদ্ধ রাখা উচিত। আর এ জন্য চাই সরকারের স্বপ্ল মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। কারণ, জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ না হলে সে জাতি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সামনের দিকে এগুতে পারবে না; জাতিও আত্মনির্ভশীল হয়ে ওঠে না।

বস্তুত, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু। তাই বিগত সরকারের আমলে রিজার্ভের নিম্মমুখীতা ঠেকানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পদক্ষেপগুলো হচ্ছে, দু’ধরনের রিজার্ভ হিসাব (এৎড়ংং ্ টংধনষব জবংবৎাবং) চালু, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (ওগঋ) পরামর্শ গ্রহণ, বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ, স্মার্ট এলসি ও ডিজিটাল রেমিট্যান্স হাব তৈরির উদ্যোগ। এসব পদক্ষেপকে অর্থনীতিবিদরা ইতিবাচক হিসাবেই মনে করছে। তবে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জও নেহায়েত কম ছিলো না। আর চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, আমদানি নির্ভরতা, নন-রপ্তানি খাতে বৈদেশিক ব্যয় ও রাজস্ব ঘাটতি। তাই এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

তবে এক্ষেত্রে আমাদের হতাশ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ক্ষীণ হলেও আশার আলোও রয়েছে এক্ষেত্রে। কারণ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সতর্ক পদক্ষেপে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি এখনো গতি হারায়নি। যা আমাদের জন্য বেশ আশাব্যঞ্জক। মূলত, রপ্তানি খাত বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টর এখনও দেশের ডলার আয়ের মূল উৎস। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য সরকার ৫ বিলিয়ন ডলার হালনাগাদ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল (ঊপড়হড়সরপ তড়হবং), বিদেশি বিনিয়োগে ছাড়, চীনা ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সহায়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া সৌদি আরব ও কাতারের সঙ্গে জ্বালানি বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন সরাসরি টের পাচ্ছেন ডলার সংকটের প্রভাব। ফার্মাসিতে ওষুধের দাম, বাজারে পণ্যের মূল্য, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, পরিবহন ব্যয়সব কিছু বেড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাঁরা জানতে চান, আমাদের অর্থনীতির অবস্থা কেন এমন হলো? তাদের কষ্টের প্রবাসী টাকা কেন হুন্ডিতে হারিয়ে যায় বা সরকারের ডলার আয় কোথায় যায়? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে সংকট শুধু অর্থনীতির নয়, বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ফাটল ধরবে। যা কারো জন্যই কাম্য নয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কৌশলগতভাবে রিজার্ভ ফের বাড়ানো সম্ভব যদি সরকার রপ্তানিকে বৈচিত্রময় করে, হুন্ডির উপর কঠোর নজরদারী ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সরকারি ব্যয় কমানো সহ তথ্য-উপাত্তের স্বচ্ছতা এবং সকল ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়।

শেষ কথা হচ্ছে, দেশের রিজার্ভ মানে কেবল ডলার নয়, এটি দেশের মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়। একটি দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ তার আস্থা, সম্ভাবনা ও সুশাসনের প্রতীক। বাংলাদেশের মতো ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিন হাজারো প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠান, ব্যবসায়ী পণ্য রপ্তানি করেন এবং শিল্প উদ্যোক্তারা আন্তর্জাতিক চুক্তিতে অংশ নেন। তাদের শ্রম, ঘাম, বুদ্ধিমত্তার সঠিক ব্যবহারই রিজার্ভ বাড়ানোর মূল চাবিকাঠি। আমরা যদি পরিকল্পনা, সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখি তাহলে দেশের রিজার্ভ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হবে। আমরা আশা করবো জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কবি।