হালিমা আক্তার হানী
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকার পরিবর্তন সম্ভব হলেও একটি বিষয়ের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না-তা হলো ভারতীয় সিরিয়াল। শেখ হাসিনার মতো একজন স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্য দিয়ে সরিয়ে দেওয়া গেলেও ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচারিত এসব সিরিয়াল বন্ধ করা যায়নি। এ বাস্তবতা আমাদের এক গভীর সংকেত দেয়: এদেশে রাজনৈতিক শক্তির চেয়েও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ক্ষমতা অনেক বেশি। বিষয়টি নিছক বিনোদন নয়; এটি এক নীরব, পরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ-যার লক্ষ্য আমাদের পরিবার, সমাজ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভেঙে ফেলা।
ভারতীয় সিরিয়ালগুলো এমনভাবে নির্মিত হয় যেখানে বাস্তবতা নয়, বরং অতি-নাটকীয়তা, চক্রান্ত, দ্বন্দ্ব, অহংকার, প্রতিশোধ, লোভ ও অসত্যকে কেন্দ্র করে গল্প তৈরি করা হয়। এসব সিরিয়ালের মূল দর্শক নারী সমাজ, যারা দিনের পর দিন এসব গল্প দেখে নিজেদের জীবনকে পরিমাপ করতে থাকেন সে কল্পনার আদলে। তারা ভাবতে শুরু করেন-“আমি কেন পারছি না?”, “আমার সংসার কেন এমন নয়?”, “আমি কেন নিজের মতো স্বাধীন হতে পারছি না?” এভাবেই ধীরে ধীরে তারা নিজের বাস্তব সংসার, স্বামী, পরিবার ও সমাজকে অবমূল্যায়ন করতে শুরু করেন।
সিরিয়ালে নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তারা একাই সবকিছু করতে সক্ষম। সংসার ছাড়াই তারা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, স্বামীর প্রয়োজন নেই, সন্তান লালন-পালন তার একার দায়িত্বে সম্ভব এবং আত্মনির্ভরশীলতাই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাস্তবে কর্মজীবন কঠিন, সম্মান অর্জন কঠিন, স্বামীর সহযোগিতা ছাড়া একটি পরিবার টিকিয়ে রাখা কঠিন- এগুলো সিরিয়াল কখনো দেখায় না। এতে তৈরি হয় এক ধরনের মানসিক বিভ্রান্তির ফলে নারীরা বাস্তবজীবনকে ভ্রান্তভাবে দেখতে শুরু করেন।
একটি অপ্রিয় সত্য হলো, ভারতীয় সিরিয়াল থেকে নারীরা কেবল কল্পনা নয়, কূটচাল ও ষড়যন্ত্রের শিক্ষাও নিচ্ছেন। সিরিয়ালে দেখা শাশুড়ি-বউয়ের চক্রান্ত, ননদের কূটনীতি এবং পারিবারিক বিশ্বাসঘাতকতার গল্পগুলো তারা অবচেতনভাবেই নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে শুরু করেন। একটি ছোট্ট ঘটনা থেকেই শুরু হয় সন্দেহ, বাড়ে দোষারোপ এবং এক সময় পৌঁছায় সম্পর্কোচ্ছেদের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে। দেশে বর্তমানে বাড়তে থাকা বিবাহবিচ্ছেদের হার, পারিবারিক কলহ ও সন্তানদের মানসিক বিপর্যয়ের পেছনে এ সিরিয়ালের প্রভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
সিরিয়ালগুলোর আরেকটি মারাত্মক দিক হলো, এগুলো ইসলামি পারিবারিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। ইসলাম নারী ও পুরুষের জন্য স্বতন্ত্র দায়িত্ব ও মর্যাদা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সিরিয়ালে নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন পুরুষের সব কাজ নারীও করতেই হবে এবং পুরুষ যদি কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে, নারী কেন পারবে না-এ প্রশ্নটিকে তুলে ধরে তারা ধর্মীয় ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ করে। ফলে মেয়েরা অন্ধভাবে নারী স্বাধীনতার নামে এমন কিছু চিন্তা ও আচরণ গ্রহণ করে যা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে অনুচিত এবং ঈমানহানিকর।
এছাড়া, এসব সিরিয়ালে নৈতিকতাহীন সম্পর্ক, অবৈধ প্রেম, পরকীয়া, মিথ্যা, ছলচাতুরি, এমনকি ধর্মীয় আচার-আচরণকে কুসংস্কার হিসেবে দেখানো হয়। এটি স্পষ্টত একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে তার বিশ্বাস থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের মেয়েরা, যাঁরা টেলিভিশনের পর্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব সিরিয়ালে ডুবে থাকেন, তারা না বুঝেই মানসিক ও নৈতিক পরিবর্তনের শিকার হয়ে পড়ছেন। আমরা এমন পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানাই। ভারতীয় সিরিয়াল শুধু বিনোদন নয়, এটি একটি ধ্বংসাত্মক বিষবৃক্ষ, যার শিকড় আমাদের পরিবার, সমাজ ও ধর্মের ভিতরে প্রবেশ করেছে। আমরা এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চাই। আমরা চাই, আমাদের সমাজে এমন একটি পরিবেশ গড়ে উঠুক যেখানে সত্য, ন্যায়, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং পারিবারিক বন্ধনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, কল্পনার চোরাবালিতে হারিয়ে গিয়ে বাস্তবকে ধ্বংস করা নয়।
সরকারকে অবিলম্বে ভারতীয় চ্যানেল ও সিরিয়ালের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। এক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি এবং সম্প্রচার নীতিমালার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো সম্প্রচারের আগে কনটেন্ট যাচাই করার জন্য একটি আলাদা সেন্সর বোর্ড গঠন করা উচিত।
মসজিদ, স্কুল, কলেজ, সামাজিক সংগঠন এবং মিডিয়াগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ের ওপর গণসচেতনতা তৈরি করতে। বিশেষ করে নারী সমাজকে বুঝিয়ে বলতে হবে কিভাবে এসব সিরিয়াল তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেশীয় নাটক, শর্টফিল্ম, ওয়েব সিরিজ, ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক সিনেমা-এসবকে অর্থায়ন ও উৎসাহিত করতে হবে। দর্শকদের এমন কিছু দেওয়া দরকার যাতে তারা বিদেশি বিষাক্ত কনটেন্টের বিকল্প খুঁজে পান।
ঘর থেকেই প্রতিরোধ শুরু করতে হবে। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কোন কনটেন্ট পরিবারে প্রবেশ করবে, কোনটি নয়। একসাথে ইসলামি প্রোগ্রাম দেখা, ইসলামি বই পড়া, আলোচনা করা-এসবের মাধ্যমে পরিবারে সচেতনতা গড়ে তোলা যেতে পারে।
নারীদের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবার, সম্পর্ক, দায়িত্ব ও বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন করা উচিত। যেন তারা সিরিয়ালের কল্পনার সঙ্গে বাস্তব জীবনের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন এবং ভুল ধারণার বশবর্তী না হন।
ভারতীয় সিরিয়াল আমাদের সমাজের নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে ভেঙে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। এই নীরব আগ্রাসনকে আর নীরবে সহ্য করা যাবে না। আমাদের এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে-রাষ্ট্রীয়ভাবে, সামাজিকভাবে এবং পারিবারিকভাবে। নয়তো খুব শিগগিরই আমরা দেখব-বাহ্যিকভাবে স্বাধীন, কিন্তু চিন্তা ও সংস্কৃতির দিক থেকে পরাধীন এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা আর নিজেদের চিনবে না, বরং শুধু সিরিয়ালের চরিত্রগুলোকেই বাস্তব ভাববে।
এখনই সময়-সচেতন হওয়ার, সচেতন করার এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার।
লেখক : শিক্ষার্থী রাজশাহী কলেজ।