মনসুর আহমদ
আমাদের দেশের মহিলাদের একটি অংশ সমাজে পুরুষ ও মহিলাদের প্রকৃতি বিরুদ্ধ সমান অধিকার দাবি করে আন্দোলনে নেমেছে। কিন্তু তারা একবারও ভাবছে না প্রকৃতি নারী-পুরুষের জন্য জন্মগতভাবে যে বিধান দিয়েছে তার বিরুদ্ধাচরণ করলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে। তারা পশ্চিমা জগতের আদলে চলতে চায়। কিন্তু তার পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা তারা আদৌ ভাবছে না। স্বয়ং পশ্চিমা জগত জাহান্নামের বহ্নিশিখায় কিভাবে জ¦লে ছারখার হচ্ছে তা একবার দেখে নেওয়া প্রয়োজন।
নারীর সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সতীত্ব (Chastity)। এ জন্য নারী জীবন দিতে যতটুকু ভয় না পায় তার চেয়ে অধিক ভয় পায় সতীত্ব হারানোকে। কিন্তু আজ এ অমানবিক অশ্লীল কাজটির মহোৎসব চলছে বিশ্বময়। এফবিআই ইউনিফরম রিপোর্টস ১৯৮১-তে প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকায় এক বছরে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮১, ৫৩৬টি। এফবিআই-এর মতে এ তথ্য পরিপূর্ণ নয়। বরং ধর্ষণের অপ্রকাশিত সংখ্যা হবে কমপক্ষে এর দশ গুণ।
১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিল রয়টার পরিবেশিত সংবাদ-এ প্রকাশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৯শত মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়, ১৯৯৪ সালে ২লাখ ৭ হাজার ৬১০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯৩ সালে আমেরিকায় দেড় লাখের বেশী নারী ধর্ষণের শিকার হয়। ১৯৯৪ সালের ২৫ জুলাই ইউএসআই এর পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, আমেরিকায় প্রতি সেকেণ্ডে একজন মহিলা ধর্ষিতা হয়।
ইটালীতে প্রতি ঘণ্টায় একজন মেয়ে তার সতীত্ব হারাচ্ছে। ১৯৯৫ সালে ফ্রান্সে গঠিত মেডিকেল বোর্ড ঘোষণা করেছে যে সে দেশে একজনও সতী নারী নেই। Review Bureau of Police Research and Development থেকে পাওয়া এক তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত এ দশ বছরে সেখানে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ৩৮৯৩, ৬২০৩, ৪০৫৮, ৪৫৫৮, ৪৩০০, ৫০২৩, ৫৪০১, ৫৪২৭, ৫২৯৮, ৬২০৩, ৬৩৫৬টি।
বৃটেনের অবস্থাও এমন। বিলেতের নাইনটিন নামীয় একটি ম্যাগাজিনে ১৯৮০ সালে ১০ হাজার বিলাতি মেয়ের উপর জরিপ চাালিয়ে বড়ই দুঃখের সাথে বলেছে, এ সমাজে কুমারী কনে পাওয়া অত্যন্ত দুর্লভ। ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর এএফবি এর খবরে প্রকাশ, লন্ডনের ক্যান্টবেরী কাউন্সিলের স্বাস্থ্য দফতরের মেডিকেল অফিসার ডা. জে.এ.স্কট বিবৃতি প্রদান করেছেন যে, লন্ডনে ১০% অবৈধ সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং অবৈধ জন্মহার ক্রমেই বেড়ে চলছে।
পশ্চিমা দেশের এ অভিশপ্ত অনাচার পশ্চিমা সংস্কৃতির অংগ হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এক হিসাব মতে বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় অর্ধশত মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়। পুলিশ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ধর্ষিতার সংখ্যা ২৪৭০ জন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫২৫টি, ১৯৯৭ সালে ধর্ষিতা হয়েছে ১৩৭৩ জন। ১৯৯৮ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯৬০টি, ১৯৯৯ সালে ধর্ষিতা হয় ৩৫০৪ জন। ২০০১ সালের প্রথম চার মাসে ১১১২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশের নারী ধর্ষণ পশ্চিমা জগতের চাইতে অধিকতর ভয়ানক ও বীভৎস। পালাক্রমে ধর্ষণের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতিতা নারীটিকে হত্যা করা হয়। কী অপরাধ ছিল নারীটির যাকে এমন একটি অপমানের বোঝা নিয়ে জগৎ থেকে বিদায় নিতে হল। যখন ছারখার হচ্ছে মা বোনেরা। তখনও বিশ্বের ধর্মীয় সম্প্রদায়সহ সমাজ সচেতন রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী নেতৃত্ব কিভাবে চুপ করে আছেন? পশ্চিমা জগতের অধিকাংশই ফ্রি সেক্স কান্ট্রি। একটি নির্দিষ্ট বয়স সীমার পর সেখানে নর-নারীর স্বেচ্ছাচারী মিলনে কোন বাধা নেই। এরপরও সেখানে দেদারছে ধর্ষণ চলছেই। কিন্তু কেন? অনিয়ন্ত্রিত মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি অস্বাভাবিক আচরণের মধ্য দিয়ে আনন্দ অনুভব করা। ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক নীতির বন্ধনমুক্ত ঐ সমাজ তাই যেন স্বাভাবিক পথ পরিত্যাগ করে ধর্ষণের পথ বেছে নিয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, একটি দেশ আক্রমণ করে বিজয়ী সৈনিকেরা নারী ধর্ষণে লিপ্ত হয় দেশের নারী পুরুষদের নৈতিক সাহসকে চুরমার করে দেবার জন্য। বসনিয়া ইরাকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সৈন্যদের বীভৎস ঘৃণ্য পাশবিক আচরণ তার প্রমাণ, কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা কেন বিকৃতগোষ্ঠী দ্বারা পথেঘাটে ধর্ষিতা হচ্ছে এ থেকে বাঁচার উপায় কী?
নারীর অশালীন চাল-চলন ও পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা, ঢলাঢলি পাশ্চাত্যে সহজে যে বিপদের আশংকা দেখা দিয়েছে সে আশংকাটি মুসলিম বিশ্বের জন্যও ঘনীভূত হয়ে আসছে। কিন্তু এ বিপদ থেকে মুক্তি অর্জন মুসলিম বিশ্বের জন্য কোন কঠিন কাজ নয়। কারণ পাশ্চাত্য সভ্যতার জড়বাদি দর্শন নারীদের জীবিকা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদানে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু মুসলিম সমাজ এমন আপদ থেকে অনেকটা মুক্ত। ইসলামের দর্শন নারীর মানমর্যাদা ও সম্মানের শ্রেষ্ঠতম রক্ষক। এ দর্শন নারীকে স্ত্রী ও মা হিসেবে তার সামাজিক দায়িত্ব একাগ্রভাবে পালন করার সুযোগ প্রদান করে। এ কারণে মুসলিম দেশের জন্য সমাজ-সভ্যতা সংস্কৃতির মৌলিক দর্শনকে পাল্টাবার খুব একটা যেমন প্রয়োজন হবে না, তেমনি এসব দেশের রাষ্ট্র পরিচালনাকারীগণ পশ্চিমা দর্শন প্রভাব মুক্ত হলে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও ধর্ষণের হাত থেকে নারী জাতিকে মুক্তি প্রদান মোটেই কঠিন কাজ হবে না। সৌদি আরব ইরানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ- এ সংক্রামক ব্যাধি থেকে যেমন মুক্ত, তেমনি আমাদের দেশকে এ অশ্লীলতার মহামারি থেকে মুক্ত রাখতে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষার পরিবেশকে একটু শালীনতার আওতাভুক্ত করতে পারলে এ ধ্বংসাত্মক ব্যাধি থেকে জাতিকে মুক্তি প্রদান খুব সহজে সম্ভব। আমাদের দেশের নরনারী ইসলামী অনুশাসনে বিশ্বাসী। তাই সমাজপতি ও রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের আন্তরিকতা সহকারে প্রচেষ্টা চালানোর মধ্যেই এমন ধ্বংসাত্মক মহামারি থেকে জাতিকে বাঁচানোর প্রকৃষ্ট উপায় নিহিত। আমাদের দেশের গল্পে, গানে, সিনেমা, টেলিভিশনে যতটুকু নোংরামী বিদ্যমান তা দূর করা খুব কঠিন কাজ নয়। এসব মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই ধর্ষণের প্রচণ্ডতা লোপ পাবে।
এ অভিশাপ থেকে মানবতাকে মুক্তি দিতে ধর্ষকদের ইসলামী বিধান মতে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে। আমাদের দেশে ধর্ষিতাদের বেশি শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। ধর্ষিতাদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণার মানসিকতা ধর্ষকদের আরও উৎসাহিত করে। তাই ধর্ষিতাদের প্রতি সুনজর প্রদানের সাথে সাথে সমাজে ধর্ষকদের প্রতি গভীর ঘৃণা পয়দা করা প্রয়োজন।
এমন মনোভাব পোষণ ও আচরণ করা ইসলামের বিধান। তিরমিযি আবু সাইদ বর্ণনা করেছেন, একজন নারী অন্ধকারে মানাতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়েছিল। পথিমধ্যে এক ব্যক্তি তাকে ধরে ফেলে এবং জোরপূর্বক তার সতীত্ব নষ্ট করে। মেয়ে লোকটির চিৎকারে চারদিকে লোকজন একত্রিত হয়। ধর্ষক ধরা পড়ল। রাসূল (সা.) এর ধর্ষককে রজম করলেন আর মেয়ে লোকটিকে রেহাই দিলেন। বোখারী শরীফে বর্ণিত হযরত ওমর (রা.) খেলাফতকালে এক ব্যক্তি এক মহিলার সাথে জবরদস্তি যেনা করল। হযরত ওমর (রা.) যেনাকারী ব্যক্তিটিকে দোররা মেরে শাস্তি দিলেন; আর মেয়েটিকে ছেড়ে দিলেন। এসব দলিলের ভিত্তিতে ঐকমত্য হয়েছে যে, এমন ধরনের যেনার শিকার মহিলাদের শাস্তি দেয়া যাবে না। এমনকি সুস্পষ্ট সাক্ষ্য ও আলামত ব্যতীত মহিলাদের উপর যেনার সন্দেহ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। নারীদের প্রতি ইসলাম কোমল আচরণ ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টি পোষণ করে। তাদের নারীত্ব ও সতীত্ব রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাই সমাজকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে নারীদেরকে ঘৃণা, অমানবিক ও লালসার শিকার থেকে বাঁচাতে ইসলামী জীবনবোধ, পরকাল দর্শনভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর বিধানকে যথাযথ প্রতিষ্ঠিত করাই মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ। লেখক : প্রাবন্ধিক।