রিদওয়ান বিন ওয়ালি উল্লাহ
বিংশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান বিশ্লেষক হচ্ছেন মাওলানা মওদূদী (রহ)। ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের শর্তাবলির আলোচনা করতে গিয়ে তিনি মৌলিক একটি বিষয়কে বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, ‘আমাদের জাতির সমগ্র প্রভাবশালী অংশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজে বিকৃতি ও ভাঙন সৃষ্টিতে মুখর এবং বর্তমান যুগে সমাজ জীবন পরিগঠন ও ভাঙ্গার বৃহত্তম শক্তি হচ্ছে সরকার।’ অর্থাৎ আমাদের দেশে টেকসই সংস্কার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায় সমাজের প্রভাবশালী অংশ। তারা নিজেদের রাষ্ট্র চিন্তক, সমাজ বিশ্লেষক ও জনদরদী হিসেবে উপস্থাপন করে আর বলে, ইসলামের সাথে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন সম্পর্ক নেই। একটা শ্রেণি আছে শুধুই নামধারী মুসলমান। একটা শ্রেণি জুমআ ও ঈদের নামাজকেই ইসলাম মনে করে। আবার কেউ ইসলাম বলতে বোঝে শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জানাজা, বিয়ে, দুআ, দান-খয়রাত ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ বলে মহানবীর (সা:) সময়ের রাষ্ট্র ব্যবস্থা এ যুগে অপ্রাসঙ্গিক। তাই কৌশলে একটি শ্লোগান মানুষকে গলধকরণে তারা সচেষ্ট। তাহলো- ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা’ ইসলামে নেই। কিংবা ইসলামি পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা অসম্ভব। আসুন এ বয়ান প্রতিষ্ঠার পক্ষ শক্তির সুবিধা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনে আসি।
১. অযোগ্যদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে সুবিধা: সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্রে কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতি, আইন-কানুন ইসলামী নীতিতেই চলার কথা। অথচ বাংলাদেশে তা অবর্তমান। এর একটা বড় কারণ হলো- অযোগ্যদের ক্ষমতা দখল। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিত্তশালী নাগরিক ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। ফলে তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কার্যকর করতেও অক্ষম। তাই নিজেদের অযোগ্যতা ঢেকে নেতৃত্বে বসার জন্য তারা মুখরোচক বয়ানের আশ্রয় নিয়েছে যে, ইসলামে রাজনীতি নেই, রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেই কিংবা মহানবীর (সা:)-এর রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখন প্রাসঙ্গিক নয় ইত্যাদি।
২. শঠতার প্রশ্রয় ও সত্যকে দাবিয়ে রাখা: সভ্যতার বিকাশ ও বিশ্বায়নের এ সময়েও সমাজের প্রভাবশালী অংশ শঠতাকে প্রশ্রয় দিয়ে সত্যকে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত। পার্থিব স্বার্থোদ্বারে পারঙ্গম হলেও ইসলামে শাসন ব্যবস্থার সৌন্দর্য উদঘাটনে তারা বড্ড উদাসীন বরং ইসলামী জ্ঞান চর্চার সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়ার বন্দোবস্ত করতে তারা সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। স্কুল কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামিক স্টাডিজ চর্চাকে একরকম নিষিদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অনেক উচ্চমাধ্যমিক কলেজে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করে পাঠদান বন্ধ করে দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ধারার বাইরে ইসলামি জ্ঞান চর্চায় প্রতিষ্ঠিত পাঠাগার কোথাও বন্ধ করে দিয়েছে, কোথাও পুড়িয়ে দিয়েছে, কোথাও জঙ্গি বই বলে পরিচালকদেরকে জেলে পাঠিয়েছে, কখনো গুম-খুন-হত্যার মহড়া চালিয়েছে। গত ১৬ বছরে ইসলামিক স্টাডিজ পড়ুয়াদের সমাজের অথর্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
৩. ক্ষমতা বা নেতৃত্ব হারানোর শঙ্কা মুক্ত থাকা: ইসলামি অর্থব্যবস্থা কার্যকর করণের ফলে উমর ইবনে আব্দুল আজীজ (রহ) এর সময় যাকাত নেয়ার লোকও ছিলোনা। আবার বাংলাদেশেও ইসলামি ব্যাংক সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সুদ মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সফলতা প্রমাণ করে দেখিয়েছে বারবার। তাহলে ইসলামী অর্থব্যবস্থার এতো চমৎকার উদাহরণ থাকার পরেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিতে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণ কী? পর্যবেক্ষণে দেখা যায়- সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলে ধীরেধীরে অর্থের সুষম বন্টন হবে। শীর্ষস্থানীয় নাগরিকদের অন্যায়ভাবে সম্পদের পাহাড় বানানোর সুযোগ কমে যাবে। সামজ ও রাষ্ট্রে মানুষের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকবেনা। ফলে তাদের প্রতি মানুষের তোষামোদী করার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে। সম্পদশালী হলেও অনৈতিক হওয়ার ফলে তাদের বর্জন করে মানুষ ইসলামী অর্থব্যবস্থার সুফলের দিকে ঝুঁকবে। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
৪. দুর্নীতির রাস্তা খোলা রাখার জন্য : ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নৈতিকতায় কোনো ছাড় নেই। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে সামাজিক-অর্থনৈতিক কোনো ধরনের অনিয়মকে ছাড় দেয়া হয়না। ফলে যারা ব্যক্তি আদর্শের রাজনীতি করে তারা চাইলেও অনৈতিকভাবে অর্থের পাহাড় তৈরি করতে পারবেনা। তাই অনৈতিকতার ধ্বজাধারীরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামকে দেখতে চায়না।
৫. সামাজিক অপরাধকে জিইয়ে রাখার জন্য : আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা মোড়লদের শালিসনীতির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ- কেউ অপরাধ করলে এলাকার প্রভাবশালী মোড়ল কিংবা মেম্বার কিংবা চেয়ারম্যানের কাছে শালিসের জন্য যায়। অনেক ক্ষেত্রে শালিসদার অনৈতিকভাবে অপরাধী পক্ষ থেকে অর্থ নিয়ে ভিক্টিম পক্ষকে হারিয়ে দেয়। এমনো হয়, উভয় পক্ষ থেকেই টাকা নিয়ে নিজের সুবিধা মতো রায় দেয়। বিশেষত গত ১৬ বছর তো ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতির রাজত্ব ছিল সর্বত্র। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এসবের স্থান নেই।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৬ হাজার ৫৫৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অর্থাৎ- বছরে গড়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৩১১টি। এ খুনগুলোর মধ্যে ৫টি খুনের বিচার যদি ইসলামী নিয়মে হতো তাহলে হয়তো বছরে ১১টি খুনও হতো না। ইসলামী আইনের এ সুফল দেখলে মানুষ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকবে। তাই অনৈতিক রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে ইসলামের শাশ্বত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক তা চায় না।
মূলত ৬৩২ থেকে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে খোলাফায়ে রাশেদার যুগ বলা হয়। তৎকালীন ইসলামী বিচারব্যবস্থায় বিচারপ্রাপ্তির জন্য খলিফাকেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। খলিফা আলী (রা.) বর্ম হারিয়ে যাওয়ার পর তা এক ইহুদির কাছে দেখতে পেয়ে বিচারকের দারস্থ হন। বিচারক তাঁকে সাক্ষী পেশ করতে বললে তিনি তাঁর পুত্র ও দাসকে সাক্ষী হিসেবে পেশ করেন। কিন্তু বিচারক বললেন, পুত্রের সাক্ষী পিতার পক্ষে এবং কৃতদাসের সাক্ষী মনিবের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ফলে বর্মটি অভিযুক্ত ব্যক্তিরই রয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সে ইহুদি এ বলে ইসলাম গ্রহণ করে, যে ধর্মে এমন সুবিচার রয়েছে, তা মিথ্যা ধর্ম হতে পারে না।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে মানুষের মধ্যে ফাসাদের পরিমাণ খুবই নগণ্য ছিল। আবু ওয়ালে শাকিক ইবনে সালমা বলেন, ‘আমি কুফার বিচারক সালমান ইবনে রাবিআর কাছে চল্লিশ দিন গিয়েছি। কিন্তু তাঁর কাছে কোনো অভিযোগকারী বা অপরাধীকে দেখিনি।’ প্রসঙ্গত, সালমান ইবনে রাবিআ ছিলেন ইসলামী শাসনামলে কুফার প্রথম বিচারক (তারিখে তাবারি : ৩/৪২৬; উসদুল গাবাহ : ২/২২৭)।
৬. পোশাকি সংস্কৃতিতে স্বেচ্ছাচারিতা টিকিয়ে রাখতে : সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে শালীন পোশাকের সংস্কৃতি থাকাটাই স্বাভাবিক। বান্দা তার স্রষ্টার নির্দেশ মেনেই চলার কথা। আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রেখো, সৃষ্টি যার বিধানও (চলবে) তার (সূরা আল আরাফ: ৫৪)’। কিন্তু প্রভাবশালী শ্রেণি ও অনৈতিক মিডিয়া মালিকরা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে অশালীন পোশাক, বিজ্ঞাপন কিংবা সিনেমার প্রচলনকে প্রমোট করে সমাজের যুবসমাজকে চারিত্রিকভাবে অধপতিত করে রাখতে চায়। যেনো যুব সমাজ কুপ্রবৃত্তিতে বুঁদ হয়ে থাকে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস না পায়। মূলত অশালীন পোশাকের প্রচলন রেখে অনৈতিকতা সমাজে টিকিয়ে রাখতে পারলে অনৈতিক রাজনীতিবিদরা নিজেদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত পোক্ত করতে পারে।
পর্দা ব্যবস্থা কার্যকর করলে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হয়। আবার ধর্ষণের অপরাধের শাস্তি ইসলামী নীতিতে কার্যকর করলে দ্রুতই ধর্ষণ কমে যাবে। তথাপি পর্দা ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়না কিংবা ধর্ষণের অপরাধের শাস্তি ইসলামী রীতিতে কার্যকর করা হয় না। কারণ হলো- তখন নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে মানুষ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে যাবে এবং অনৈতিক রাজনীতির অবসান ঘটবে। তাই অনৈতিক রাজনীতিবীদরা ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায়না।
৭. সুদ-ঘুষ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা ও অবৈধ নির্বাচন : সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা টিকে থাকলে অনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গুটি কয়েক মোড়লের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয় এবং অধিকাংশ নাগরিক দলিত শ্রেণিতে পরিণত হয়। ফলে মোড়লদের পক্ষে জনগণকে শাসনের নামে শোষণের রাস্তা খোলাসা হয়। আবার ঘুষ প্রথা প্রচলিত থাকলে এলিট মোড়লদের সম্পদের পাহাড় গড়তে সুবিধা হয়। যেহেতু জনগণ অর্থনৈতিক কারণে এদেরকে ভোট দিবেনা সেহেতু অন্যায়ভাবে অর্থের পাহাড় বানিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদেরকে টাকায় কিনে ও ভোটারদেরকে টাকা দিয়ে ভোট কিনে অবৈধভাবে নির্বাচনে জিতে আসা সহজ হয়। ইসলামি অর্থব্যবস্থা কার্যকর থাকলে ও নৈতিক প্রশাসক পদে পদে পদায়ন হলে অনৈতিক এলিটদের পক্ষে ভোটে জিতে আসা অসম্ভব হয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা ‘ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থা আছে’ এটা অস্বীকার করে কিংবা গোপন রাখতে চায়।
৮. আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা ও প্রভু রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিস্তারে সুবিধা : বিশ্বে প্রভু রাষ্ট্রগুলোর কোনোটিতেই ইসলামী শাসন ব্যবস্থা নেই বরং ইসলামী আদর্শ বিরোধী রাষ্ট্র বর্তমান। বিশ্বব্যাপী অন্যায়ভাবে যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে ব্যস্ত। তাই তারা ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক কারণে তুলনামূলক অনুন্নত ও ছোট রাষ্ট্রগুলোকে করায়ত্ত করে রাখতে নানা সুযোগ সুবিধা ও টাকার বিনিময়ে অনৈতিক রাজনীতিবিদদের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। অনৈতিক রাজনীতিবিদরা টাকার লালসায় স্বাধীনতার বেশে গোলামীতেই স্বাচ্ছন্দ খুঁজে ফিরে। এককথায় বললে, এটি অযোগ্য ও অনৈতিক শাসকদের স্বার্থ চরিতার্থ ও স্বেচ্ছাচারিতা চর্চার একটি ইসলামোফোবিক বয়ান।
লেখক : শিক্ষক, শহিদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ।