॥ মুহাম্মদ আবুল হুসাইন ॥
আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সা.) প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা পোষণ করা ইমানের অংশ। এ বিষয়ে বুখারি ও মুসলিম শরিফে হযরত আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সে ব্যক্তিই ইমানের প্রকৃত স্বাদ লাভ করেছে, যে আন্তরিকভাবে আল্লাহকে রব; ইসলামকে দীন ও মুহাম্মদ (সা.)-কে রাসুল হিসেবে গ্রহণ করে সন্তু’ হয়েছে। পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ বলেছেন- ‘বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করেন। বস্তুত আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (আলে ইমরান : ৩১) আল্লাহকে ভালোবাসার স্বরূপ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন- ‘বল, ‘আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ-সবই বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আন-আম, আয়াত ১৬২) এর অর্থ হলো, জীবনের প্রতিটি কাজ শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে রাজি খুশি করার জন্য এবং তার ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে।
পরিপূর্ণ বা সত্যিকার ইমানদারের পরিচয় জানাতে গিয়ে আল্লাহর রাসুল বলেছেনÑ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যই কাউকে ভালোবাসলো, আল্লাহর জন্যই কাউকে ভালোবাসা থেকে বিরত থাকলো, আল্লাহর জন্য কাউকে কিছু দান করলো এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে কিছু দান করা থেকে বিরত থাকলো; সে তার ইমানকে পরিপূর্ণ করে নিলো।’ (বুখারি: আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত।) আর আল্লাহর প্রতি এই ভালোবাসার নিদর্শন হল - মুমিন অবশ্যই আল্লাহর হুকুম মেনে চলার ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুলের অনুসরণকে প্রাধান্য দিবেন, তিনি যেভাবে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতেন সেভাবে মেনে চলবেন, আল্লাহর রাসুল যেভাবে আল্লাহকে ভালবাসতেন সেভাবে ভালোবাসবেন এবং সর্বক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করবেন।
কেউ যদি আল্লাহর রাসুলকে এবং তাঁর কাজকে ভালো না বাসে এবং তাঁকে অনুসরণ না করে তাহলে সে প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদের কাছে তোমাদের বাবা, সন্তান ও অন্য সকল মানুষের চেয়ে প্রিয় না হব, ততক্ষণ তোমরা মুমিন হতে পারবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম, হযরত আনাস থেকে বর্ণিত)
রাসুল (সা.)কে ভালোবাসার তাৎপর্য : রাসুল (সা.)কে ভালোবাসার মানে হলো তাঁর নীতি ও আদর্শকে ভালোবাসা, তাঁর মিশনকে ভালোবাসা, তাঁর দাওয়াত ও সংগ্রামকে ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন: ‘প্রিয় বৎস, তুমি যদি এভাবে জীবন যাপন করতে পার যে, তোমার মনে কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও অশুভ কামনা নেই, তাহলে তাই কর। এটাই আমার সুন্নাত বা নীতি। (অর্থাৎ আমি কারো প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা বা অশুভ কামনা পোষণ করি না। ) আর যে ব্যক্তি আমার নীতিকে ভালোবাসে, নিঃসন্দেহে সে আমাকে ভালোবাসে। আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। (মুসলিম)
আমরা যদি নিজেদের আশেকে রাসুল দাবি করি তাহলে আমাদের অবশ্যই রাসুলের জীবনাদর্শকে ভালোবাসতে হবে। একবার এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বললো, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি আপনাকে ভালোবাসি। তখন তিনি বললেন, তুমি যে কথাটা বললে, তা নিয়ে আরও একটু চিন্তা-ভাবনা কর। এরপরও সে তিনবার বললো যে, আল্লাহর কসম, আমি আপনাকে ভালোবাসি। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে দারিদ্র্যের মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হও। কেননা যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, তার কাছে অভাব ও ক্ষুধা স্রোতের পানির চেয়েও দ্রুতবেগে আসে। (হাদিসটি তিরমিযি শরিফে সংকলিত, হযরত আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণিত।)
একটি জাহেলী সমাজে অবস্থান করে রাসুলের আদর্শকে ধারণ এবং সে আদর্শের আলোকে নিজের, পরিবারের এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠন করা চারটি খানি কথা নয়। এ এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া। এর জন্য অনেক বাধা প্রতিবন্ধকতা, অনেক পরীক্ষা, অনেক ত্যাগ কোরবানির সম্মুখীন হতে হবে এবং ইমানের পথে অটল থেকে এগিয়ে যেতে হবে। তার জন্য অনেক হিম্মত প্রয়োজন।
রাসুলকে (সা.) ভালোবাসা ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে গ্রহণ করার অর্থ হলো, তিনি যে পথে চলেছেন, সে পথের যাবতীয় চিহ্ন ও রূপরেখা সঠিকভাবে জেনে ও মেনে সেই পথে চলতে হবে। হালাল হারাম মেনে চলতে হবে। অবৈধ পথে অর্থ আয় ও লোভ লালসা থেকে বিরত থাকতে হবে। ফলে অভাব ও ক্ষুধার মুখোমুখি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আর অর্থনৈতিক আঘাতটাই যে সবচেয়ে দুঃসহ আঘাত, তা সবাই জানে। এ আঘাতের মোকাবিলা কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা ও আল্লাহর ভালোবাসার অস্ত্র দিয়েই করা সম্ভব। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীকে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন। মেশকাতে সংকলিত এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার ইচ্ছা ও কামনা বাসনা আমার আনীত বিধানের (তথা কোরআনের) অনুসারী না হয়।’ অপর একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসুলকে ভালোবাসে অথবা আল্লাহ ও রাসুলের ভালোবাসা পেয়ে আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করতে চায়, তার উচিত যখন কথা বলবে সত্য বলবে, যখন তার কাছে আমানত রাখা হবে তখন আমানত হিসাবে রক্ষিত জিনিস অক্ষতভাবে মালিককে ফিরিয়ে দেবে এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। (মেশকাত) সুতরাং মুখে মুখে শুধু নিজেকে আল্লাহর রাসুলের আশেক দাবি করাই মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং আল্লাহর রাসুল যে কাজ করার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন সেই কাজকে জানতে হবে বুঝতে হবে। আল্লাহর রাসুলকে ভালোবাসতে হলে রাসুলের কাজকে, তাঁর আদর্শকে ভালোবাসতে হবে।
রাসুলের কাজ কী ছিল : আল্লাহর রাসুল কী কাজ করে গেছেন; তাঁকে কী কাজের জন্য পাঠানো হয়েছিল সে সম্পর্কে মহান রব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘তিনিই তাঁর রাসুলকে হিদায়াত ও সত্যদীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দীনের ওপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।’ সূরা সফ, আয়াত ৯
আল্লাহর রাসুল এসেছিলেন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দিনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। যেমন এসেছিলেন পূর্ববর্তী নবী রাসুলগণও। এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে আল্লাহ বলেছেন- ‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সে বিধি-ব্যবস্থাই দিয়েছেন যার হুকুম তিনি দিয়েছিলেন নূহকে। আর সে (বিধি ব্যবস্থাই) তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে দিলাম যার হুকুম দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ‘ঈসাকে। তা এই যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠিত কর, আর তাতে বিভক্তি সৃষ্টি করো না। ব্যাপারটি মুশরিকদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার দিকে তুমি তাদের আহ্বান জানাচ্ছ। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন তাঁর পথে বেছে নেন, আর তিনি তাঁর পথে পরিচালিত করেন তাকে, যে তাঁর অভিমুখী হয়।’ - সূরা আস শূরা, আায়াত ১৩। সুতরাং দিন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নতুন কোন আবিষ্কার নয় বরং এ দায়িত্ব এ আন্দোলন ছিল নবী রাসুলদের আন্দোলন। সুতরাং নবীর উত্তরসূরি যারা আমরা আছি আমাদের নবীদের এই মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
মুসলিম উম্মার দায়িত্ব : ‘আর এভাবেই আমি তোমাদের মধ্যপন্থি উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর সাক্ষী হও এবং রাসুল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর।’ (বাকারা: ১৪৩)
সুতরাং কথা স্পষ্ট। আল্লাহ মুসলমানদের একটি মাধ্যমপন্থি জাতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ মুসলমানরা চরমপন্থি হবে না আবার আদর্শ বিমুখ হবে না, চরিত্রহীন হবে না। হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হবে না। বরং তাদের বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের মডেল বা আদর্শ হতে হবে আর এ আদর্শ হওয়ার ক্ষেত্রে মুসলমানদের সামনে তাদের মডেল হবেন আল্লাহর রাসুল। অর্থাৎ বিশ্বাসীদের আদর্শ বা মডেল হবেন আল্লাহর রাসুল আর বিশ্বাসীরা হবে মানবজাতির সামনে ইসলামের মডেল বা সত্যের স্বাক্ষ্য। আর ইসলামের আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য মুসলমানদের প্রথমে নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের নমুনা পেশ করতে হবে। আর এ জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হবে মক্কার মুরশরিকদের মতো বর্তমানকালের মুশরিকরা, যারা বিভিন্নভাবে শিরকের মধ্যে নিমজ্জিত। সুতরাং শিরক, বেদাত ও বিভেদের ফেতনা থেকে মুক্ত হয়ে মুসলমানদের আল্লাহর পথে সীসাঢালা প্রাচীরের মতোই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করতে হবে, আন্দোলন করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক।