বাংলাদেশে রেল সবচেয়ে আরামদায়ক গণপরিবহন হিসেবে যাত্রীদের কাছে আজও প্রিয়। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ স্বপ্ল খরচে, আরামে এবং নিরাপদে ভ্রমণের আশায় রেলপথ বেছে নেন। কিন্তু বাস্তবচিত্র হলো- একটার পর একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা এই আস্থার ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছে। নিরাপদ ভ্রমণের বদলে যাত্রীদের মনে জন্ম নিচ্ছে শঙ্কা ও আতঙ্কা। রেল যখন আস্থা ও আরামের প্রতীক হওয়ার কথা তখন সেটি আজ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। অব্যবস্থাপনা ও ত্রুটির কারণে যাত্রীরা রেল ভ্রমণে বিমুখ হচ্ছে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রেল ভ্রমণে কীভাবে যাত্রীদেরক আকৃষ্ট করা যায় সেজন্য সেবার মান বাড়ানোর চেষ্টা করছে। উন্নত দেশগুলোতে রেল ব্যবস্থায় রয়েছে অটোমেটেড সিগন্যালিং, ট্রেন কন্ট্রোলিং সিস্টেম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অথচ আমাদের দেশে এখনো অনেক জায়গায় ম্যানুয়াল সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু আছে, যা যে কোন সময় বড় বিপদ ঢেকে আনতে পারে। রেল শুধু একটি পরিবহন নয়, বরং জাতির সম্পদ। অথচ প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় এই সম্পদ ঝুঁকির মুখে। সারাদেশের সব জায়গায় রেলে সিগন্যাল কেমন তা আমরা জানি না। রাজধানীর কাওরান বাজার, মগবাজার ওয়্যারলেস, মালিবাগ ও খিলগাঁও রেলগেট দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য ট্রেন চলাচল করে। কিন্তু অবস্থা এমন যে, প্রায়ই এসব জায়গায় প্রাইভেটকার, বাস ও অটোরিকশা রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। রেল আসার সময় তড়িঘড়ি করে তারা সরতে চায়। যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। সুতরাং এখনই সাবধান হওয়া দরকার।

আমরা প্রতিনিয়ত খবরের শিরোনামে পড়িÑ ‘রেল দুর্ঘটনায় নিহত ২০’ ‘লাইনচ্যুত ট্রেন, হতাহতের আশঙ্কা’ গেঁটম্যান না থাকায় বাস-ট্রেন সংঘর্ষ’। কিন্ত এসব খবর আর আমাদের বিচলিত করে না। কারও গায়ে লাগে না। কারণ আমরা মৃত্যুর পরিসংখ্যান গোনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অথচ প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে আছে অসংখ্য মানুষের অশ্রু, বেদনা ও মানবিক ট্র্যাজেডি। একটি দুর্ঘটনা মানে কেবল একজন মানুষের মৃত্যু নয়, বরং একটি পরিবারের ভাঙন। একজন বাবা হারান তার সন্তানকে, একজন মা হারান তার স্নেহধন্য সন্তান কিংবা স্বামীকে, ভাই হারায় বোনকে। একটি জীবন শেষ শেষ হয়ে গেলে অসংখ্য মানুষের জীবনে নেমে আসে চিরস্থায়ী অন্ধকার। স্বাভাবিক মৃত্যুই যেখানে হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে , সেখানে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু কতটা ভয়াবহ কষ্টের, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।

কারণ যার যায় সে বুঝে বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা! প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। কখনো সড়কে,কখনো রেলে, কখনো নদীতে, কখনো আগুনে কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। সড়কের সাথে পাল্লা দিয়ে রেল দুর্ঘটনাও বাড়ছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু বেশিরভাগ তদন্ত রিপোটের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। ফলে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটে চলছে।

রেলপথ দেশের সম্পদ। অথচ সেটাই হয়ে উঠেছে মৃত্যুর ফাঁদ। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু প্রতিকার হচ্ছে না। রেল দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে নানা জটিল কারণ। এর মধ্যে অপর্যাপ্ত ও পুরোনো অবকাঠামো, সিগন্যাল ব্যবস্থার ক্রুটি, ট্র্যাকের দুর্বলতা, ট্রেন চালক বা সিগন্যাল অপারেটেরের ভুল সিদ্ধান্ত, যান্ত্রিক ক্রটি, মানবিক গাফিলতি, গেঁটম্যান বা গেটবিহীন রেলক্রসিং, চালকের গাফিলতি, ট্রেনের অতিরিক্ত গতি ও ওভারলোডিং, দুর্বল অবকাঠামো ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতির অভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অনেক জায়গায় এখনো রেলক্রসিংয়ে গেট বা গেটম্যান নেই। ফলে বাস, অটোরিকশা, এমনকি পথচারীরাও জীবন হাতে নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন। রেললাইন সময়মতো সংস্কার না হওয়ার ফলে ছোট ফাটল বা বাঁক তৈরি হয়। দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। অথচ এ সমস্যাগুলো সমাধান করা হলে অনেক প্রাণ রক্ষা পেত। সময় এসেছে বদলে দেওয়ার। না হলে আরেকটি ট্রেন আসবে, আরেকটা দুর্ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হবে। আমরা আমরা শুধু গণনা করবো- আর কতজন গেল। শান্তির সময়ে সন্তান বাবাকে কবরে শুইয়ে দেয় আর যুদ্ধের সময়ে বাবারা কলিজার টুকরা সন্তানকে কবর দেয়। যার নমুনা তো আমরা ফিলিস্তিনে দেখছি। আমাদের দেশে যুদ্ধ নেই। অথচ যুদ্ধ ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি মানুষ রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ কিছু রেল দুর্ঘটনা এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে, নিচে তা তুলে ধরা হলো:

১৯৮৯ সালে টঙ্গীর মাজুখান এলাকায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭০ জন যাত্রী নিহত এবং ৪০০ যাত্রী আহত হয়েছিল। এটি ছিল দেশের স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা। ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি রাতে হিলি রেলস্টেশনে গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী একটি লোকাল ট্রেনের সঙ্গে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক যাত্রী নিহত ও দু’শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালের মার্চে ঈশ্বরদীতে সেতু ভেঙে ট্রেন নিচে পড়লে ৬০ জন যাত্রী প্রাণ হারায়। ১৯৮৫ সালের ১৩ জানুয়ারি পার্বতীপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনের কোচে আগুন লাগলে ২৭ জন যাত্রী নিহত হন। ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ ভেড়ামারায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়লে ২৫ জন যাত্রী নিহত ও ৪৫ জন আহত হন। ২০১০ সালে নরসিংদীতে চট্টগ্রামগামী মহানগর গোধূলি ও ঢাকাগামী মেইল চট্টলা ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে চালকসহ ১২ জন নিহত হন। ২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মীরসরাই একটি মিনি ট্রাক রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় উল্টে যায়। এতে প্রায় ৪৪ জন নিহত হয়েছিল। নিহতদের অধিকাংশই স্কুলশিক্ষার্থী ছিল। এ দুর্ঘটনার মুল কারণ রেলক্রসিংয়ে গেট বা গেঁটম্যান ছিল না। ২০১৯ সালের ২৩ জুন বরমচাল, কুলাউড়া, মৌলভীবাজারে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন সেতু পার হওয়ার ট্রেনের কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে খালে পড়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত এবং ১০০ জন আহত হয়েছিল। ১০১৯ সালের ১২ নভেম্বর মন্দবাগ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে উদয়ন এক্সপ্রেস ও তৃর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত এবং ১০০ জন আহত হয়েছিল। এসব ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলোর পরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটি হলেও তার সুপারিশগুলো বেশিরভাগ সময় বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটলেই দায়ীদের শাস্তির দেয়, প্রয়োজনে উ”চপর্যায়ের পদত্যাগও ঘটে। যেমনÑ দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি ফেরি দুঘটনায় প্রায় ৩০০ জন মারা যাওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। অথচ আমাদের দেশে শত শত প্রাণহানির পরও দায়িত্বশীল কেউ পদত্যাগ করেননি বা জবাবদিহিতার নজির স্থাপন করেননি।

রেল দুর্ঘটনা বন্ধে একটি কার্যকর পরিকল্পনার প্রয়োজন। এজন্য পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন দ্রুত সংস্কার ও প্রতিস্থাপন করতে হবে। সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও স্লিপারগুলোর মান উন্নয়ন, জিপিএস ট্র্যাকিং, সেন্সর সিস্টেম, অটোমেটেড সিগন্যালিং এবং সেন্ট্রাল ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম (CTC) চালু করা জরুরি। গেটবিহীন রেলক্রসিং বন্ধ কওে প্রতিটি ক্রসিংয়ে গেট, গেঁটম্যান ও সিগন্যাল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ট্রেনচালক ও কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, যাত্রীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, দুর্ঘটনার পর তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে শুধু সরকারের নয়, সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব রয়েছে। আমরা অনেকেই রেললাইনে বসে আড্ডা দিই বা শর্টকাট পথ হিসেবে রেললাইন ব্যবহার করি। এসব অভ্যাস পরিত্যাগ না করলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে. একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। রেল দুর্ঘটনা বন্ধ করা কোনো অসম্ভব কাজ নয়। দরকার শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক কার্যকারিতা এবং নাগরিক সচেতনতা। প্রতিটি দুর্ঘটনা কেবল একটি সংখ্যা নয়Ñ একটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার গল্প, অশ্রুভেজা আর্তনাদ এবং এক অনন্ত শূন্যতা। সময়ে এসেছে আমাদের রেল ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনার। এখনই পদক্ষেপ না নিলে রেল আর যাত্রার বাহন নয়, মৃত্যুফাঁদ হয়েই থেকে যাবে। লেখক : প্রাবন্ধিক