গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

বৃক্ষ শুধু প্রাকৃতিক শোভা বৃদ্ধি করে না, এটি জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা, ভূমিক্ষয় রোধ, অক্সিজেন সরবরাহ, বায়ু পরিশোধন এবং উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। বৃক্ষ আমাদের ফুল দেয়, ফল দেয়, ছায়া দেয়, জ্বালানি কাঠ দেয়। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় আমরা দেখছি, নগরায়ন, বনভূমি উজাড়, শিল্পায়ন এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের আবহাওয়া আগে ছিল নাতিশীতোষ্ণ ভাবাপন্ন। বিগত দিনগুলোতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে উষ্ণতা বৃদ্ধির লক্ষণ প্রতীয়মান, এখন তা আগের অবস্থায় আর নেই। এখন আমাদের আবহাওয়া চরম মৌসুমী ভাবাপন্ন। এজন্য বাতাসে বেড়েছে তীব্র তাপ প্রবাহ। বাতাসে উষ্ণতার কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধূলিকণার পরিমাণ। ধূলি-বাতাস এখন নিত্যদিনের ঘটনা। বাতাসের ভাসমান ধূলি ও সীসাকণা নিঃশ্বাস ও খাবারের মাধ্যমে সোজা চলে আসছে মানুষের শরীরের ভেতর। এতে বাড়ছে অসুস্থতা। তাপের বিরূপ প্রভাবে আমাদের শিল্প, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন কমে আসছে। মানুষের স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং কর্মসংস্থানের বিষয়টিতে বাড়ছে ঝুঁকি। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৃক্ষরোপণ কেবল একটি প্রতীকী কর্মসূচি নয়- এটি রাষ্ট্র, সমাজ এবং প্রতিটি নাগরিকের একটি যৌথ দায়বদ্ধতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবেশ ও বন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছে। যেমন- বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫, বন আইন, ১৯২৭ (সংশোধিত) এবং বন (সংশোধন) আইন, ২০০০। আইনগুলো বনজ সম্পদের সংরক্ষণ, বন উজাড় রোধ এবং বৃক্ষরোপণকে উৎসাহিত করতে বৈধ কাঠামো প্রদান করে। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এই আইনের বাস্তবায়নে নিয়োজিত। সরকারের বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ, জাতীয় পরিবেশ দিবস, এবং বনজ ও ফলদ বৃক্ষমেলা আয়োজন ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সারা দেশে বর্তমানে বনজ ও ফলদ বৃক্ষের মেলা চলছে।

সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। তবে কেবল আইন প্রণয়ন করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা। আজও আমরা দেখতে পাই, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে, নদীর তীর দখল করে গাছ উজাড় করা হচ্ছে, বনভূমি রূপান্তরিত হচ্ছে কৃষিজমি কিংবা বসতভিটায়। এমনকি সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকেও কখনো কখনো পরিবেশগত ছাড়পত্র না নিয়েই গাছপালা কেটে ফেলার নজির রয়েছে। প্রতিটি নাগরিকের উচিত বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করা। এটি কেবল একটি ভালো কাজ নয়, বরং সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ। যেহেতু গাছ আমাদের জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন দেয়, তাই একে রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য।

বৃক্ষরোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, পরিবেশ রক্ষা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের প্রধান কেন্দ্র, যেখানে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, সচেতনতা ও দেশপ্রেম গড়ে ওঠে। বৃক্ষরোপণও এমন এক কর্মকাণ্ড, যার চর্চা ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে তুললে তারা আজীবন পরিবেশ রক্ষায় সচেতন নাগরিক হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। শিক্ষক-সমাজকে শিক্ষার্থীদের মাঝে এমন অনুভব জাগ্রত করতে হবে যে-গাছ শুধু একটি উদ্ভিদ নয়, এটি জীবনদাতা। সে লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে অন্তত একটি বা একাধিক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত করা সম্ভব। এসব কর্মসূচিতে ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছের প্রতি গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। জলবায়ু সংকট ও উষ্ণায়ন মোকাবিলায় গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে গাছ লাগানোর কর্মসূচি সবচেয়ে ভালো ও কম ব্যয়বহুল উপায় বলে মনে করছেন তারা। গাছ লাগানোর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ দু’তৃতীয়াংশ কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও নদীভাঙনের মতো দুর্যোগ প্রতি বছরই দেশের একটি বড় অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিনদিন এসব দুর্যোগের মাত্রা, তীব্রতা ও সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গাছপালা দুর্যোগ প্রতিরোধে একটি ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’ হিসেবে কাজ করে। উপকূলীয় অঞ্চলে যদি ব্যাপক হারে ম্যানগ্রোভ গাছ রোপণ করা যায়, তাহলে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

আমাদের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। তবে কেবল আইন প্রণয়ন করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না, বাস্তবায়নের প্রতি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপকহারে গাছ রোপণ এবং উপকূলীয় সবুজায়নের কারণে সাম্প্রতিক দুর্যোগগুলোতে কিছুটা হলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধস রোধে বৃক্ষরোপণ অত্যন্ত কার্যকর। গাছের শিকড় মাটি আঁকড়ে ধরে, পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায় এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে। তাই জলবায়ু অভিযোজনের অংশ হিসেবে বৃক্ষরোপণকে জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল বা উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় জাতীয় বৃক্ষরোপণ প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে, যার মাধ্যমে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যেকোনো দেশে শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২.৬ শতাংশ হারে বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে। যা বিশ্ব গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। ১৯৮০ সালে যেখানে দেশের মোট ভূমির প্রায় ১৭ শতাংশ ছিল বনভূমি, সেখানে এখন তা ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এর মধ্যে বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বনভূমি সংকোচনের ফলে বিলুপ্ত হচ্ছে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এর পাশাপাশি বনজ সম্পদ থেকে নির্ভরশীল অনেক মানুষের জীবিকাও হুমকির মুখে পড়ছে। কাজেই এ হ্রাসপ্রাপ্ত বনভূমি পুনরুদ্ধার করতে হলে ব্যাপক ও পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ প্রয়োজন।

শহরগুলোতে বৃক্ষরোপণ এখন যেন শুধুই ‘পিপিআর’ (প্রকল্প প্রস্তাবনা) বাস্তবায়নের একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তাঘাট নির্মাণ কিংবা উন্নয়ন কাজের সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে বহু গাছ কেটে ফেলা হয়, এবং পরে দায়সারা ভাবে কিছু গাছ রোপণ করেই দায়িত্ব শেষ বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ শহরে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে ছায়াদানকারী ও দূষণরোধী গাছের বিকল্প নেই। শহুরে ‘ভূ-উপযোগ পরিকল্পনা’ ও ‘মাস্টার প্ল্যান’-এ সবুজায়ন বাধ্যতামূলক করা জরুরি। পার্ক, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত জায়গায় গাছ লাগানোর জন্য পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। বাড়ি নির্মাণে ছাড়পত্র দেওয়ার সময় ছাদ বা উঠানে বৃক্ষরোপণের বিষয়টি একটি শর্ত হিসেবে আরোপ করা যেতে পারে।

আজ যে গাছ আমরা রোপণ করব, তার ছায়া, ফল বা উপকার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে-এ ধারণাকে লালন করাটাই হলো মানবিক দায়িত্ববোধ। বৃক্ষ শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বায়ু পরিশোধন করে না, এটি এক ধরনের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও জীবনের প্রতীক। অতএব, আমাদের উচিত গাছকে শুধুই প্রকৃতির উপকরণ হিসেবে না দেখে, জীবনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা। গাছ লাগানো মানে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করা, ভবিষ্যতের জন্য একটি সবুজ আশ্রয় নিশ্চিত করা। ‘একজন শিক্ষার্থী, একটি গাছ’-এ নীতিকে সামনে রেখে দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বৃক্ষরোপণ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সবুজ পৃথিবী গঠনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা হোক আমাদের গর্ব, আমাদের প্রেরণা। একটি গাছ মানে একটি প্রাণ। তাই প্রতিটি গাছ লাগানো মানে ভবিষ্যতের জন্য এক একটি প্রাণ বাঁচানো।

আসুন, আমাদের শহর, গ্রাম, রাস্তা, খেলার মাঠ, বিদ্যালয়, অফিস- সব জায়গায় গাছ লাগাই। দেশ বাঁচাতে বৃক্ষরোপণকে আন্দোলনে পরিণত করি। এটাই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার। আমরা যদি সত্যিই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য একটি দেশ রেখে যেতে চাই, তবে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। তাই, আমার আহ্বান- দল, মত নির্বিশেষে, সকল শ্রেণী-পেশা ও বয়সের সবাইকে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি বা আন্দোলন কিংবা কাজে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করে এগিয়ে আসতে হবে- ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। এটাই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।

লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক।