মমতাজ উদ্দিন আহমদ

ধরুন, আপনার বসতবাড়ির পাশে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত ঘোরাঘুরি করছে। তারা লুটপাট ও সন্ত্রাস সৃষ্টিতে অভ্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে আপনি কি কেবল দরজায় খিল এঁটে বসে থাকবেন, নাকি আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেবেন? সম্ভবত দ্বিতীয়টিই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ কেবল নিষ্ক্রিয় থেকে বিপদ এড়ানো যায় না। ঠিক তেমনই, একটি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও আত্মরক্ষার প্রস্তুতি অপরিহার্য। যখন কোনো দেশ বা জনপদের আশেপাশে আগ্রাসী শক্তির আনাগোনা দেখা যায়, তখন প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেওয়া সময়ের দাবি। কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি অথবা মৌখিক নিন্দার ওপর নির্ভর করে একটি জাতি টিকে থাকতে পারে না।

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। সূরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “তাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত হও; শক্ত করে ধরো ঘোড়ার লাগামকে, এবং তা দিয়ে সন্তস্ত্র করো তোমাদের শত্রু ও আল্লাহর শত্রুদের”।

এ আয়াতের তাৎপর্য হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রস্তুতির মাত্রা এতটাই পর্যাপ্ত হতে হবে, যাতে শত্রু তা দেখে ভয় পায়। যে সামরিক প্রস্তুতি শত্রুর মনে ভীতির সঞ্চার করে না, বুঝতে হবে, প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে মানা হয়নি মহান আল্লাহ তায়ালার উপরিউক্ত হুকুম। তখন তা এক প্রকার অবাধ্যতা হিসেবে গণ্য হয়।

মানবজীবনে শুধু অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থানই যথেষ্ট নয়, বরং যারা খুনি ও জালেম, তাদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করাও সমানভাবে জরুরি। ইতিহাসে দেখা গেছে, কেবল সমালোচনার ভয়ে কোনো অত্যাচারী তার নিপীড়ন বন্ধ করেনি, কোনো খুনিও তার অপরাধ থেকে সরে আসেনি। কারণ, যারা অন্যের উপর জুলুম করে, তারা সাধারণত সমালোচনার ধার ধারে না; তারা কেবল শক্তির ভাষাই বোঝে। ফিলিস্তিনের গাজায় দীর্ঘ সময় ধরে ইসরাইলী বাহিনীর একটানা ধ্বংসযজ্ঞ এর একটি মর্মান্তিক উদাহরণ। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলেও তাদের নৃশংসতা বিন্দুমাত্র কমেনি। এর প্রধান কারণ হলো ভুক্তভোগীদের দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা। প্রতিরোধের সক্ষমতা না থাকার কারণেই বহু জাতিগোষ্ঠী ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে।

এমন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই, যেকোনো সম্ভাব্য আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সাধ্যমত সামরিক ও কৌশলগত প্রস্তুতি নেওয়া অপরিহার্য। একটি সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেবল একটি দেশের সার্বভৌমত্বই রক্ষা করে না, বরং এটি সম্ভাব্য শত্রুদেরও হামলা করা থেকে বিরত রাখে। দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেবল রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় এবং কিছু সুযোগসন্ধানীর লালন-পালন করে মাত্র।

এমতাবস্থায় আমাদের জন্য এ শিক্ষা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিলে, একটি শক্তিশালী এবং আধুনিক প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা সময়ের অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা। এক্ষেত্রে যেকোনো প্রকার অবহেলা বা শৈথিল্য আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সামরিক প্রস্তুতির মান এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে, যাতে কোনো বহিরাগত শক্তি আমাদের দিকে কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করারও সাহস না পায়।

আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, কেবল একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীই একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নতি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, তবে একটি দুর্বল সামরিক শক্তি সমৃদ্ধ অর্থনীতিকেও বিপন্ন করতে পারে। তাই, অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি একটি শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা অর্জন করাও সমানভাবে জরুরি।

পরিশেষে বলা যায়, দেশের প্রতিটি নাগরিকের উচিত দেশরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকা এবং এ প্রস্তুতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। মনে রাখতে হবে, জাতীয় নিরাপত্তা কোনো আপসের বিষয় নয়। একটি সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনাই একটি জাতির দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে।

লেখক: সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।