আসিফ আরসালান
গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য সন্ত্রাস এবং গুণ্ডামির বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, চরমোনাইয়ের পীরের ইসলামী আন্দোলন এবং খেলাফত মজলিশের দু’অংশ হামলাকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছে। এটাই স্বাভাবিক। একটি রাজনৈতিক দল তার লক্ষ্য ও আদর্শ প্রচারের জন্য সারাদেশের জনগণের কাছে যাবে, জনগণের দুয়ারে পৌঁছবে এবং তাদের কাছে ঐ দলটির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও দর্শন প্রচার করবে এটিই তো স্বাভাবিক রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। ছাত্রদের নবগঠিত দল এনসিপিও সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে। ১ জুলাই থেকে তারা সারাদেশে পদযাত্রা করছে। তারা পথসভা করছে, জনসভা করছে এবং নিজেদের কথা বলছে। সবকিছুই করছে তারা শান্তিপূর্ণভাবে এবং পুলিশকে আগেভাগে জানিয়েই। কিন্তু তারপরেও দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণীর গণমাধ্যম এনসিপির এসব কাজকে বিশেষ করে গোপালগঞ্জ যাত্রাকে বাঁকা চোখে দেখছে। বলতে চাচ্ছে, জুলাই মাসে তাদের গোপালগঞ্জ যাওয়ার কী প্রয়োজন ছিলো। সেখানে গেলে যে গণ্ডগোল হবে সেটি কি তারা জানতো না? গোষ্ঠীটির এ ধরনের বেহুদা যুক্তিতে আমি অবাক হই না। সারাদেশের কোটি কোটি লোক এখন ভারত ও আওয়ামী বিরোধী। কিন্তু ঐ কয়েকটি গণমাধ্যম এবং তাদের ছদ্মবেশি দোসররা টিকে থাকার জন্য হঠাৎ করে গিরগিটির মতো রং পাল্টে ফেলেছে। কিন্তু ঐ যে ইংরেজিতে একটি কথা আছে, A leopard can’t change it’s spot অর্থাৎ কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না। এরাও যতোই মুখ ঢেকে রাখুক না কেনো মাঝে মাঝে হঠাৎ যখন উঁকি মারে তখন তাদেরকে ঠিকই চেনা যায়। এবারও ওদেরকে ঠিকই চেনা গেছে। আর যাবে না বা কেনো? ওরা তো জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েই মাঠে নেমেছিলো।
এনসিপি গোপালগঞ্জ গিয়েছিলো ১৬ জুলাই। আর সমস্ত কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগ ১৪ জুলাই থেকেই সারা গোপালগঞ্জ এবং টুঙ্গিপাড়াসহ প্রচার করে এবং জনগণকে উস্কে দেয় যে, এনসিপি নেতাদেরকে কোনোক্রমেই গোপালগঞ্জ ঢুকতে দেয়া হবে না। কেনো ঢুকতে দেয়া হবে না? গোপালগঞ্জ কি বাংলাদেশের বাইরে? এটা কি শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনার পৈত্রিক সম্পত্তি? গত শুক্রবার ১৮ জুলাই আমি মুদ্রিত পত্রিকা এবং সেগুলোর অনলাইন সংস্করণ দেখলাম। আমি নিয়মিত ৮টি সংবাদপত্র রাখি। তার মধ্যে দু’টি ইংরেজি। এর মধ্যে ৬টিতেই গোপালগঞ্জে আওয়ামী তাণ্ডবের নেপথ্য খবর বেরিয়েছে। সে সাথে পেছনে যাদের উস্কানি ও চক্রান্ত ছিলো এবং কী ধরনের চক্রান্ত ছিলো সেগুলোও বেরিয়ে আসছে। ৮টি পত্রিকা পড়ার পর যেসব খবর পাওয়া গেলো সেগুলোর সংক্ষিপ্ত সার আমি নীচে দিচ্ছি।
দৈনিক প্রথম আলো তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদের শিরোনাম দিয়েছে, “সংঘাতের ইঙ্গিত ছিলো স্পষ্ট/নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন”। ঐ খবরে যেসব ইনসেট দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো, “গ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এসে শহরের অলিগলিতে অবস্থান নেন। কয়েক দিন ধরে চলে হামলার প্রচারণা।” “স্থানীয় এনসিপি হামলার আশঙ্কার কথা পুলিশকে জানিয়েছিলো। হামলার ঝুঁকি নিয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি ছিলো।” “মঞ্চে হামলার সময় পুলিশও সভাস্থল ছেড়ে যায়। গোপালগঞ্জের বাইরে থেকে লোক এসেছিলো: বিভাগীয় কমিশনার।”
প্রথম আলোর রিপোর্টে আরো বলা হয় যে, এনসিপির মিটিংকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত হবে সেটি নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রথম থেকেই আতঙ্ক ছিলো। এ আতঙ্কের কথা পুলিশকেও জানানো হয়। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জ যাত্রার বেশ কয়েকদিন আগেই তারা সেটি পুলিশকে জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কোন রুট বা কোন পথ ধরে তারা গোপালগঞ্জে পৌঁছবেন সেটিও পুলিশই বাতলে দিয়েছিলো। তারপরেও তারা শহরে পৌঁছানোর আগেই দেখেন গাছ কেটে রাস্তা ব্লক করা হয়েছে। একটি দুটি নয়, বেশ কয়েকটি গাছ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকতে গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয় কিভাবে? তারপর গাছ যখন রাস্তায় ফেলে রাখা হলো তখন পুলিশ সেগুলো সরালো না কেনো? ঐ ব্যারিকেডের সামনে এসে যখন তাদের যাত্রা বিঘ্নিত হয় তখন এনসিপি নেতারা পুলিশকে বললে তারা ব্যারিকেড সরিয়ে নেয়।
দৈনিক যুগান্তর আরো মারাত্মক নিউজ দিয়েছে। পত্রিকাটি ১৮ জুলাই প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান সংবাদের চার কলাম হেডিং দিয়েছে, “দিল্লি থেকে একাধিক অডিও বার্তা/ হাসিনার নির্দেশেই হামলা”। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতাদের ওপর দফায় দফায় হামলা হয়েছে। দলটির ‘১৬ জুলাই: মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি পণ্ড করতে বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী সন্ত্রাসীদেরকে গোপালগঞ্জে জড়ো করে হামলা ঘটানো হয়। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী দু’দিন আগে আশেপাশের এলাকা থেকে গোপালগঞ্জ শহরে হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো করে আওয়ামী লীগ। টার্গেট ছিলো এনসিপিকে ঢুকতে দেয়া হলেও তাদের জীবিত বের হতে দেয়া হবে না। বিশেষ করে শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা।
এনসিপির সভা পণ্ড করা এবং প্রয়োজনে অন্তত ৩ জন এনসিপির নেতাকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা। এ আদেশটি দেন তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালকে। সে পিয়ালকে তিনি বলেন, “ওরা (এনসিপি) নাকি গোপালগঞ্জে যাচ্ছে। বাবার কবর ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এবার টুঙ্গিপাড়ায় হামলা চালাবে। তোমরা বসে আছো কেনো? যে যেভাবে পারো প্রতিহত করো। গোপালগঞ্জে কোনোভাবেই যাতে ওরা ঢুকতে না পারে। কোনো ধরনের কর্মসূচি যাতে করতে না পারে। মনে রাখবা, গোপালগঞ্জের মাটি থেকে ওদের কেউ যাতে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে।”
১৬ জুলাই এনসিপি নেতারা যাওয়ার ৩ দিন আগে থেকেই অর্থাৎ ১৩ জুলাই থেকেই আওয়ামী লীগের নেতারা শহর এবং টুঙ্গিপাড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে এই মর্মে জলজ্যান্ত মিথ্যা প্রচার শুরু করে যে, এবার এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জ আসছে শেখ মুজিবের সমাধি সৌধ ভাঙতে। তারা আরো প্রচার চালায় যে, ওরা অর্থাৎ এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জ জেলার নাম মুছে ফেলে দেবে। ওরা গোপালগঞ্জকে পার্শ¦বর্তী কোনো জেলার সাথে একীভূত করবে। বলা বাহুল্য, এসব প্রচারণা ছিলো ডাহা মিথ্যা। আর সে প্রচারণা ছিলো প্রকাশ্যে। এমন প্রকাশ্য প্রচারণার পরেই পুলিশের বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা করা উচিত ছিলো যে, এনসিপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনসমূহ এবার বড়সড় একটা কিছু ঘটাবে। প্রশ্ন হলো, এরপরেও পুলিশ অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করেনি কেনো?
১৬ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টায় সদর উপজেলার খাটিয়াগড় চরপাড়ায় পুলিশের ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা করে এবং পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এর ৪ ঘণ্টা পর অর্থাৎ বেলা ৩টায় এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা হয়। মাঝে ৪ ঘন্টা সময় পায় পুলিশ। এ ৪ ঘন্টায় মাদারীপুর এবং অন্যান্য আশেপাশের জেলা থেকে বাড়তি পুলিশ এনে পুলিশ বাহিনীকে রিইনফোর্স করা যেতো। সেটা করা হয়নি কেনো? খবর শুনে ইউএনও অকুস্থলে যান। তাকেও হেনস্তা করা হয় এবং তার গাড়িও পোড়ানো হয়। এরপর এনসিপির সভামঞ্চ বেপরোয়াভাবে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় তার ছবি সংবাদপত্রের পাতায় দেখা গেছে।
এসব ঘটনা থেকে প্রমাণ হয় যে, গত বছরের জুলাই বিপ্লবের সময় ২১ দিনে ১৪ শত লোককে হত্যা এবং ২৬ হাজার লোককে আহত করার পরেও আওয়ামী ঘরানার নেতাকর্মীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা আসেনি। তারা সব সময় প্রতিহিংসাপরায়ন ছিলো। জুলাই বিপ্লবে পরাজিত হওয়ার বদলা নিতে যে তারা গোপালগঞ্জে এনসিপির ৩ জন নেতা অর্থাৎ নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সারজিস আলমকে গোপালগঞ্জের মাটিতেই হত্যা করতে চেয়েছিলো সেটি এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার। পুলিশ ১৬ জুলাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ ব্যর্থতা কি ইচ্ছাকৃত? নাকি ডিউটি সম্পর্কে উদাসীনতা, সেটি পরিষ্কার জানা যায়নি। নাকি এরা বেগম খালেদা জিয়ার ভাষায় সে সব ‘গোপালী’, যারা সংখ্যায় পুলিশ বাহিনীতে প্রায় ৮০ হাজার এবং বিগত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা তাদেরকে লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহার করার জন্য পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এসব আওয়ামী সন্ত্রাসীদের টার্গেট শুধুমাত্র এনসিপি ছিলো না। যদি তাই হবে তাহলে তারা ডিসি অফিস জ¦ালিয়ে দিলো কেনো? জেলার কারাগারে হামলা চালালো কেনো? এখন তো একাধিক পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে যে, তারা জেল ভেঙে আটক আওয়ামী নেতাদেরকে ছিনিয়ে নেয়া এবং কারারক্ষীদের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে কারাগার আক্রমণ করে। বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে ২ জন কারারক্ষী বলেন যে, ওরা সংখ্যায় ছিলো অন্তত ৩ শত। আর আমরা হাতেগোনা মুষ্টিমেয় কয়েকজন। আল্লাহর রহমত, সময়মতো সেনাবাহিনী এসে পড়ে। তাই কারাগার রক্ষা পায়।
বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই গোপালগঞ্জ অরক্ষিত কেনো? এর বেশ কয়েকমাস আগে এ গোপালগঞ্জে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা স্বেচ্ছাসেবক দলের এক কর্মীকে হত্যা করে। ঐ সময় তারা সেনাবাহিনীর একটি গাড়িও পুড়িয়ে দেয়। তখনো কোনো কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় তাদের সাহস বেড়ে যায়।
এবার খুব বড়সড় আকারে সন্ত্রাসী কাজ করার জন্য তারা ঢাকা, মাদারীপুর, বাগেরহাট ও বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নিয়ে আসে। শেখ ফজলুল হক মনির ছোটো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম বিপ্লবের পর গোপালগঞ্জেই আশ্রয় নেন। এরপর সুযোগ বুঝে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দেন। সেখান থেকেই তিনি এসব অপারেশনের নির্দেশ দিচ্ছেন।
এখন ভারতে বসে ৩ ব্যক্তি বাংলাদেশে সারাক্ষণ যাতে অস্থিরতা বিরাজ করে তার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এরা হলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং শেখ সেলিমের বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মনির পুত্র ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
গোপালগঞ্জের ঘটনাই শেষ ঘটনা নয়। অনুসন্ধানী সিনিয়র সাংবাদিকরা বলেন যে, শুধুমাত্র যদি আওয়ামী লীগ হতো তাহলে তাদেরকে দমন করা কোনো ব্যাপার ছিলো না। কিন্তু আসলে আওয়ামী লীগ হলো ইন্ডিয়ার প্রক্সি। ইন্ডিয়া কৌশলগত কারণে বাংলাদেশকে হাতছাড়া করবে না। এক্ষেত্রে তার হাতিয়ার হলো আওয়ামী লীগ। ইন্ডিয়ার মদদে আগামী ৮ মাসে আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে ইন্ডিয়া আরো অনেক অঘটন ঘটাবে। সুতরাং বাংলাদেশবাসী হুঁশিয়ার।