॥ জিবলু রহমান ॥

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দলগত স্বার্থে ব্যবহারের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ছিলেন বিরল। তার শাসনামলে প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়েছিল শতভাগ। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ-জোটের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে নানা টালবাহানায় বিভিন্ন উপায়ে পার করেন টানা সাড়ে ১৫ বছর। ‘দিনের ভোট রাতে’, ‘মরা ব্যক্তির ভোটে’, ‘ভোট জালিয়াতি’ ও প্রশাসনের সব স্তরকে ব্যবহার করে ‘ভোট ডাকাতি করে’ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ক্রমেই হয়ে ওঠেন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার। ক্ষমতাকে ধরে রাখতে ক্ষমতার অপব্যবহারে হিংস্র হয়ে ওঠেন তিনি। বিরোধীমত দমনে করেছেন গণহত্যা-গুম-খুন।

শুধু তাই নয়, ভারতের প্রেসক্রিপশনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কিলিং মেশিনে পরিণত করেছেন। পুলিশের আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, গোয়েন্দা প্রধান, র‌্যাব প্রধান, বিজিবি প্রধান, এনএসআই, ডিজিএফআই, এসবিসহ দেশের সব জেলায় পুলিশের যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের শেখ হাসিনা গুম, খুন, নিপীড়ন, নির্যাতনের মেশিনে পরিণত করেছিলেন। এর সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সম্পৃক্ততা ছিল। এসব কিলিং মেশিন শেখ হাসিনার কথার বাইরে তো যেতই না, বরং অতিউৎসাহী হয়ে অপকর্ম করত।

একক কর্তৃত্বের শাসনে শেখ হাসিনার সরকার সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বকে শত্রু বানিয়ে শেষ পর্যায়ে ভূরাজনীতিতেও প্রায় একা হয়ে পড়েছিলেন হাসিনা। সর্বশেষে সহিংসতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই-এ ভেবে সহিংসতার পথ বেছে নিয়ে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার সব চেষ্টাই করেছেন। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাকে একজন কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিক হিসেবে প্রাথমিকভাবে কারোই মনে হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শেষে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর তিনি কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকেন।

একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় বিচারের মুখোমুখি করেন। তাঁকে কারাদ- দেওয়া হয়। দুর্বল হয় বিএনপি।তিনি তার বাবাকে ‘দেবতাতুল্য’ করে তোলার চেষ্টা ত্বরান্বিত করেন এবং এমন এক পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে সরকারের সমালোচনা সহ্য করা হয় না।

হাসিনা তার নীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও একসময় নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেন। ভারতের সংবাদপত্র দ্য হিন্দুর কথায়-‘হাসিনা ক্রমেই তার সেরা উপদেষ্টাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।’ পুলিশের রিমান্ডে থাকার সময় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেছেন-‘শেখ হাসিনা তার মন্ত্রীসহ কারো কথাই শুনতেন না। নিজেই সিদ্ধান্ত নিতেন। তার কথাই ছিল হুকুম। তার দানব সরকারের সবাই তার মুখের দিকে চেয়ে থাকত। কার সাধ্য ছিল, এ হুকুম অমান্য করে।’

শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডের নিবন্ধে বলা হয়Ñ‘বাংলাদেশে একপ্রকার নৈরাজ্য চলছে। নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সহিংসতায় রবিবার (৪ আগস্ট ২০২৪) কমপক্ষে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কার্যালয় জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী সহিংস আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শেখ হাসিনার গদি টলমল। রবিবার অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দিনব্যাপী সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা ৮৮ তে পৌঁছে গেছে। প্রতি মিনিটে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবি মেনে নেন, তাহলে আগামী দিনে একটি সামরিক সরকার প্রত্যক্ষ করতে চলেছে বাংলাদেশের মানুষ। কারণ জনগণের রায় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। স্পষ্টভাবে বিক্ষোভকারীদের সমর্থনের কথা না বললেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে তারা জনগণের পাশে আছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান অফিসারদের বলেছেন যে, ‘‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের আস্থার প্রতীক’’ এবং ‘‘তারা সর্বদা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে এই সমর্থন অব্যাহত থাকবে।’’ একই সময়ে কয়েকজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন এবং সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সমর্থন প্রদর্শনে তার ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি লাল করে দিয়েছেন।

গত বছরের ১৯ জুলাই কোটা বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যোগ দেওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর নেতারা সহিংস বিক্ষোভের শিকার হচ্ছেন। ঐক্যবদ্ধভাবে স্লোগান তোলা হচ্ছে-‘‘হাসিনা সরকারকে যেতে হবে।’’ রবিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে।

ইন্টারনেট আংশিক বন্ধ আছে। বাংলাদেশি মোবাইল ফোন অপারেটরদের কর্মকর্তারা বলেছেন যে, তারা দেশে ফোর জি পরিষেবা বন্ধ করার নির্দেশনা পেয়েছেন। ঢাকা-ভিত্তিক একটি সূত্র ইন্ডিয়া টু ডে-কে জানিয়েছে-‘‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন লাগানো হয়েছিল কিন্তু পুলিশ বা অন্য কোনো নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি।’’ তিনি আরও জানিয়েছেন, বেশিরভাগ জেলায় আওয়ামী লীগের অফিসে আগুন দেওয়া হয়েছে। একজন এমপির বাসভবনে হাজার হাজার জনতা হামলা করেছে এবং তাকে পানির ট্যাঙ্কে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে।’

‘...ঢাকাভিত্তিক সূত্র মোতাবেক, হাসিনা সরকারকে সমর্থন দেওয়ায় বাংলাদেশিদের মনে ভারতের বিরুদ্ধে তিক্ততা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ১৯ জুলাই থেকে একটি নজিরবিহীন বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করছেন এবং তারা বিশ্বাস করেন যে, হাসিনা সরকার এই মুহূর্তে পতনের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন চালিয়েছে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ তীব্র হওয়ার সাথে সাথে, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ২১ জুলাই কোটা কমিয়ে ৫% করে। এরপরেও বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। বিক্ষোভকারীরা অশান্তি দমন করতে সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত অত্যধিক বল প্রয়োগের জন্য জবাবদিহিতার দাবি জানায়। আন্দোলন (যার কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা), যা একাধিকবার সহিংস রূপ নিয়েছে, তাতে এখনো পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ২৫০ জন (সরকারি হিসেব) নিহত হয়েছে। সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান।’

২০২৪ সালের জুলাইয়ের শুরু পর থেকে একের পর এক বুলেটের আঘাতে ঝাঁজড়া হয়েছে ছাত্র-জনতার হৃদয়। রাজধানী ছাড়িয়ে বিক্ষোভের আগুন পৌঁছেছে শহর-নগর-গ্রামে। ২০২৪ সালে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় ছাত্ররা। পরে তা একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট এ কর্মসূচির ডাক দেয় তারা। ছাত্র-জনতা রাজধানীর শাহবাগ ও উত্তরা দুদিক দিয়ে গণভবনমুখী আসতে শুরু করে। দুদিক দিয়ে হেঁটে মাত্র ৪৫ মিনিটের দূরত্বে ছিল ছাত্র-জনতা।

ছাত্রজনতা ৫ আগস্ট গণভবন ঘেরাও করতে আসার খবরে সেনাবাহিনী, নৌবাহনী ও বিমান বাহিনীর প্রধানরা শেখ হাসিনার সঙ্গে সকাল সাড়ে ৯টায় গণভবনে বৈঠক করে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। কিন্তু হাসিনা নাছোরবান্দা। তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। এ নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে চলে বাহাস। তার পরিবারের লোকজনকে বোঝানো হয় পরিস্থিতি। কিন্তু তাতেও হাসিনা রাজি হচ্ছিলেন না।

পরে ‘অবাধ্য’ হাসিনাকে পদত্যাগে রাজি করাতে তার ছোটো বোন শেখ রেহানাকে অনুরোধ জানান, কিন্তু কাজ হয়নি। এরপর হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তাকে ফোন করেন। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনায় তিন বাহিনীর প্রধান শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার জন্য ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনের ‘ঢাকা মার্চ’ কর্মসূচির মুখে শেষমেশ দুপুরের পদত্যাগ করেন তিনি। রক্তসমুদ্রে গোটা দেশ ভাসিয়ে পতন ঘটল স্বৈরশাসকের। ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভ ও দাবির সামনে হাসিনাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে এবং নিজের সমস্ত সমর্থক ও রাজনৈতিক অনুরাগীদের নিরাসক্ত রেখে খুব তাড়াহুড়ো করে এ সময় ভারতে ঢুকতে সাময়িক অনুমতির জন্য তড়িঘড়ি আবেদনও করেন হাসিনা। দেশ ছাড়ার আগে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। অবশ্য সে সুযোগ তাকে দেওয়া হয়নি। পরে তিনি বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ওইদিন দুপুরে দেশ ছাড়েন। প্রথমে তিনি যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাজ্য রাজি না হওয়ায় দেশ ছাড়ার আগে শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যেতে হয়।

একসময় তাকে উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশে উড়োজাহাজ পাঠানোর জন্য ভারতকে অনুরোধ করেন। কিন্তু বাংলাদেশে উড়োজাহাজ পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় ভারত সরকার। কারণ হিসেবে বলা হয়, বাংলাদেশের আকাশসীমায় উড়োজাহাজ পাঠালে তাতে আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। এরপর সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।

চূর্ণ হয় দম্ভের অপশাসন। শেখ হাসিনার আচমকা বিদায়ের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে কারফিউ ভেঙে উল্লাসে মেতে ওঠে ছাত্র-জনতা। রাজপথে নেমে আসে নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ সর্বস্তরের মানুষ। স্বৈরাচারের বিদায়ে সন্ধ্যার পরও আনন্দ মিছিল চলছিল দেশজুড়ে।

সর্বাত্মক অসহযোগের মধ্যে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনও দখল করে নেয়। সেখানে জাতীয় পতাকা হাতে তাদের উল্লাসের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন-‘প্রতিটি হত্যা, অবিচারের বিচার হবে। সবার চেষ্টায় দেশে শান্তি ফিরে আসবে।সেনাপ্রধান ছাত্র-জনতাকে ধৈর্যধারণের আহ্বান জানান। ওই দিনই বিকালে সেনাপ্রধান এক টেলিভিশন ভাষণে জানানÑ‘দেশ পরিচালনায় অন্তর্বতী সরকার গঠন করা হবে।’

এ খবরে আনন্দমিছিল নিয়ে রাজধানীর পথে পথে ঢল নামে লাখো মানুষের। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। পরে তিনি জানান, বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করে যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দুপুরে দেশ ছাড়ার পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হওয়ার মাঝখানে বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে দলীয় নেতা-কর্মীরা চলে যান আত্মগোপনে। কেউ কেউ দেশ ছাড়েন।

দেশের ইতিহাসে তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত ও পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার মতো নিষ্ঠুর ও নির্মম স্বৈরাচারী শাসক দেখা যায়নি। তাকে স্বৈরাচার হিসেবে গড়ে তুলেছে মূলত ভারতের মোদি সরকার এবং দেশের ভারতপন্থী কিছু মিডিয়া। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে মোদি যে ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি অবলম্বন করেন, তাতেই তার এ মানসিকতা লুকিয়ে আছে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে তার কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার সরকার গঠন ও আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তবে হাসিনা সরকার ছাড়া সে দেশগুলো মোদির এমন আধিপত্যবাদী মনোভাব প্রত্যাখ্যান করে। শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকার মোদির কর্তৃত্ববাদী নীতি অবলম্বন করতে গিয়ে জনরোষ ও অভ্যুত্থানে পালিয়ে গিয়েছিল। নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ মোদির কুমতলব বুঝতে পেরে তার কাছ থেকে সরে যায়। ২০১৫ সালে নেপাল বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি থেকে সরে এসে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হলে মোদি বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

তাতে অবশ্য নেপাল সরকার তোয়াক্কা করেনি। উল্টো ভারতের খবরদারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ভুটানও ভারতের দাদাগিরি থেকে বের হয়ে যায়। অন্যদিকে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মইজ্জু তার নির্বাচনে ভারতবিরোধী ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা চালিয়ে বিপুল বিজয় লাভ করে এবং ভারতকে মালদ্বীপ থেকে কিকআউট করে দেন।

আফগানিস্তানও যুক্তরাষ্ট্রকে বিতাড়িত করে ভারতের কাছ থেকে সরে যায়। ভারতের পাশ থেকে একে একে যখন দেশগুলো সরে যায়, তখন শেখ হাসিনাই ছিল মোদির একমাত্র ভরসা। শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে মোদি কি না করেছেন! বিনাভোটে নির্বাচন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সব জায়গায় তার সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল প্রকাশ্য। তার উসকানিতে শেখ হাসিনা প্রধান বিরোধীদল বিএনপিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য হেন কোনো পন্থা নেই, যা অবলম্বন করেননি। ভারতের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে শেখ হাসিনা দানব হয়ে উঠেছিলেন। এ দানবের স্তুতিতে এবং তোষামোদিতে মেতে উঠেছিল দেশের বেশিরভাগ পত্রিকা, চ্যানেল এবং এগুলোতে কর্মরত একশ্রেণীর সাংবাদিক।

লেখক : প্রাবন্ধিক।