ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নারী ও শিশুদের চিৎকার ও আর্তনাদে প্রতিনিয়ত ভারি হয়ে উঠছে গাজার আকাশ ও বাতাস। মুসলমানদের পবিত্র পুণ্যভূমি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের বর্বরোচিত হামলায় ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে গাজা। ইসরাইলের হায়েনারা দিনের পর দিন গাজাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। ধ্বংস করেছে মুসলমানদের প্রথম কিবলা জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা। যাকে বলা হয় বায়তুল মোকাদ্দাস, আল কুদস।

ধ্বংস করেছে বহু ঘরবাড়ি ও সুউচ্চ ইমারত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। যুদ্ধবিরতির নীতি ভঙ্গ করে নতুন করে গত ১৮ মার্চ থেকে অব্যাহতভাবে গাজা উপত্যকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে এযুগের নব্য ফেরাউন নেতানিয়াহুর ইহুদি সন্ত্রাসী বাহিনী। ফিলিস্তিনের গাজাকে বহুদিন ধরেই এমন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করা হয়েছে। নারী-শিশু, অশীতিপর বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না ইসরাইলী মৃত্যু দৈত্যের হাত থেকে।

ইসরাইলের বর্বর গণহত্যার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছে গাজার হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশু ও নারী। যেসব শিশু বেঁচে আছে; মৃত্যুভয়, অবর্ণনীয় দুর্দশা, খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার অভাবে তারা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে। ইসরাইলের ইহুদিরা এতোটাই অমানবিক, নির্মম ও নির্দয় যে, ফিলিস্তিনে কোনো মানবিক সহায়তা পর্যন্ত তারা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।

ইসরাইলের জালিম শাসক নেতানিয়াহুর অত্যাচার, গণহত্যা ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ গাজার নিরীহ নিষ্পাপ মানুষগুলো। ইতোমধ্যে মা-হারা, বাবা-হারা, পরিবার-হারা শিশুরা আর্তনাদ করছে, আহাজারি করছে আর বলছে; We have no food, we have no water, we have no house| । তারা বলছে; Please help me, help me সব. ইসরাইলের তাণ্ডবে কত শিশু মা-বাবা হারিয়ে এতিম হয়ে গেছে; কত শিশু, ভাইবোন হারিয়ে অসহায় হয়ে গেছে, বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। ধ্বংস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে কত শিশু; তা কেউ জানে না। তাদের শৈশব-কৈশোর বলে কিছুই নেই। শান্তিতে একজন নোবেল বিজয়ীর মতে, ইসরাইল গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা হামলা চালিয়েছে। ৯০ শতাংশের বেশি স্কুল-কলেজ ধ্বংস করেছে। এমনকি স্কুল ভবনে আশ্রয় নেওয়া নারী-শিশুরাও হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। পুরো গাজাই এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে; গাজাবাসীর জীবন বাঁচানোই যেখানে দায়; তাদের শিশুর শিক্ষার কথা চিন্তা করা সম্পূর্ণ অকল্পনীয় বিষয়।

সম্প্রতি “’Gaza’s Stolen Childhood’ -বা গাজার চুরি হয়ে যাওয়া শৈশব শিরোনামে আল জাজিরা ২৬ মার্চ একটি ‘লংফর্ম স্টোরি’ প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ইসরাইলের সন্ত্রাসী বাহিনী প্রতি ৪৫ মিনিটে গাজার একটি শিশুকে হত্যা করছে। শিশু এবং নারীরা তাদের প্রধান টার্গেট। কারণ শিশুদের ধ্বংস করতে পারলে পরবর্তী প্রজন্ম শূন্য হয়ে যাবে। তাই তারা শিশু নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে। তার আগের প্রায় সাড়ে পাঁচশ দিনে প্রতিদিন তারা প্রায় ৩১ জন শিশুকে হত্যা করেছে। সে হিসাবে ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে প্রায় ১৮ হাজারের অধিক শিশুকে হত্যা করেছে ইসরাইল। যার মধ্যে সাড়ে ১৬ হাজার শিশুকে চিহ্নিত করা গেছে, বাকিদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে তাদের কবর হয়তো ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে। এর মধ্যেও কেউ জীবিত আছে কিনা, তা জানা সম্ভব হচ্ছে না।

ইসরাইলী বোমায় এমন হাজারো শিশু শহীদ হয়েছে, যারা সবেমাত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যাদের বয়স সাত দিন, পনেরো দিন বা এক মাসও হয়নি। যাদের বয়স ছয় মাস বা এক বছর হয়নি। প্রথম জন্মদিনটিও পালন করতে পারেনি। এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর শহীদ হয়েছে এমন একজন শিশু মোহাম্মদের ওপর অবর্ণনীয় হত্যার কাহিনী তুলে ধরেছে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা। যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ১৮ মার্চ যখন ইসরাইল গাজায় পুনরায় বোমা হামলা শুরু করে, তার মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ৩৩৬ জন ফিলিস্তিনী প্রাণ হারায়। এর মধ্যে ১৮৩ জন নিষ্পাপ শিশু রয়েছে। সেখানে ১ বছরের শিশু মোহাম্মদ তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সঙ্গে শহীদ হয়েছে। এতো নিষ্ঠুর অমানবিক বর্বরোচিত হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা মাকে পর্যন্ত তারা রেহাই দেয়নি। গাজার আল মাওয়াসির নির্ধারিত ক্যাম্পে ইসরাইলের উপর্যুপরি বিমান হামলায় তারা শহীদ হয়। মাটির সাথে মিশিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে অগণিত শহীদের মৃতদেহ।

এমন ক্যাম্পটিকে ইসরাইল ‘সেফ জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এমন আরও বহু ফিলিস্তিনী শিশু, নারী ও নিরীহ নাগরিক প্রাণ হরিয়েছে। এভাবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ৫০ হাজারেরও অধিক মানুষকে শহীদ করেছে ইসরাইল। যেখানে এক-তৃতীয়াংশ শিশু ছাড়াও রয়েছে নারী, সাংবাদিক, নিরাপত্তাকর্মী, মানবিক সহায়তাকারী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সমাজকর্মী, শ্রমজীবী মানুষ, বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও বৃদ্ধ অসহায় মানুষ। হামলা থেকে রেহাই পায়নি হাসপাতাল, এমনকি রোগীরা পর্যন্ত।

দেড় বছরের অধিক সময় ধরে একের পরে এক ইসরাইল গাজায় এমন পাশবিক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট শিশুদের লাশে মোড়ানো কফিন নিয়ে হাজারো পিতা-মাতা-স্বজনের আর্তনাদে গোটা ফিলিস্তিনের আকাশ ভারি হয়ে উঠছে। মিনিমাম কোনো বোধসম্পন্ন মানুষ এমন লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারে না। অথচ ইসরাইল গোটা প্রজন্মকে নি:শেষ করে দিচ্ছে। যাতে করে ভবিষ্যতে মুসলিমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এখন প্রশ্ন উঠছে কী করছে বিশ্ববিবেক, কী করছে বিশ্বমুসলিম। কী করছে ওআইসি এবং জাতিসংঘ ও তার মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। আরব বিশ্বের ভূমিকাই বা কতটুকু। শুধু সাম্প্রতিক সময়ে নয়, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ইসরাইল নিরীহ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করেই চলেছে। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করছে আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। গায়ের জোরে ফিলিস্তিনীদের ভূমি দখল করে সেই ফিলিস্তিনীদের ওপরেই গণহত্যা চালানোর পর ইসরাইলের কিছুই হচ্ছে না।

এর রহস্য কোথায়? কারণ ইসরাইলের খুঁটির জোর আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব। পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াও ইসরাইলের পক্ষে সাফাই গাইছে। অথচ তারাই কিনা সারা পৃথিবীতে শান্তির জিগির করছে। অথচ নিষ্পাপ, নিরীহ ইসরাইলী শিশুরা প্রতিদিন শহীদ হচ্ছে, তাতে এমনকি মুসলিম বিশ্বেরও টনক নড়ছে না। মুসলমানদের কয়েকটি দেশ নামেমাত্র লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অথচ ইসরাইল ঘিরে আছে মুসলিম বিশ্ব। মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হলে ইসরাইলের এমন আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ চালানো কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। আমরা জানি না, সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের নেতারা কবে নাগাদ গভীর ঘুম থেকে জাগ্রত হবেন। ইসরাইলী বর্বরতার সরাসরি সম্প্রচার আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। গাজার প্রাণ হারানো মায়ের হাহাকার মুসলিম বিশ্বের নেতাদের কর্ণকুহরে কবে পৌঁছাবে তা আমরা জানি না। শিশু হত্যাসহ ইসরাইলের মানবতাবিরোধী অপরাধের হাজারো দলিল বিশ্বের মিডিয়ায় বিরাজমান। মানবাধিকার ও মানবতাবাদী সংগঠনগুলোও ইসরাইলী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে। এমনকি ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলাও হয়েছে। তাতেও ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কিছুই হচ্ছে না।

জাতিসংঘ মহাসচিবও বারবার নিন্দা জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কাজের কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। ১৮ মার্চের পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেন আরও বেশি মাতাল ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যেন তাকে ফিলিস্তিনীদের হত্যার সব লাইসেন্স দিয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাপী ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ কম হচ্ছে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব-জনমত বোঝার চেষ্টা করছে না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যখনই ভোট হয়; যুক্তরাষ্ট্রসহ ৪-৫টি দেশ ব্যতীত প্রায় সবাই ইসরাইলের বিপক্ষে ভোট দেয়। কয়েকটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। কিন্তু জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো শক্তির কাছে অসহায় বনে যায়। ভেটোধারী অন্য দেশগুলোও কার্যকর কিছু করছে না। ইসরাইলী অসহায় শিশুদের আর্তনাদ আর কতদিন সহ্য করতে হবে আমরা জানি না।

জানি না আর কত রক্ত দিবে আমাদের মাতৃতুল্য নারীরা। মহান আল্লাহর অলৌকিক শক্তি ও সাহায্যের কখন তাদের জন্য অফুরন্ত শান্তির বার্তা নিয়ে আসবে সেদিকে তারা দৃষ্টিপাত করে আছে। ইহুদিদের এ জুলুম কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না। মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা; “কী কারণে তোমরা সেই সব নারী, পুরুষ ও শিশুদের খাতিরে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছ না, যারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হওয়ার কারণে আর্তনাদ করছে এবং বলছে-হে আল্লাহ! জালিমদের এই জনপদ থেকে আমাদেরকে বের করে নেও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোনো বন্ধু দরদি ও সাহায্যকারী পাঠিয়ে দাও”-[সুরা নিসা : ৭৬]।

এমতাবস্থায় সারা বিশ্ববিবেক নিশ্চুপ থাকলেও থেমে নেই বাংলাদেশের তৌহিদী জনতা। গত ১২ এপ্রিল শনিবার এদেশের সর্বস্তরের জনগণ ফিলিস্তিনের গাজায় অত্যাচারিত মুসলিমদের প্রতি সংহতি প্রকাশ, ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যা বন্ধের দাবি এবং আন্তর্জাতিক আদালতে নেতানিয়াহুর বিচারের দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রি প্যালেস্টাইন, ফ্রি প্যালেস্টাইন শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ।

পরিশেষে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট আমরা আহ্বান জানাতে চাই, আসুন ইসরাইল কর্তৃক গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং আন্তর্জাতিক আদালতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিচার নিশ্চিত করি।

লেখক : শিক্ষাবিদ।