ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিনা ভোটে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিলো আওয়ামী লীগের মধ্যে। প্রতিবেশী দেশ ভারত আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলো। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করলেও ভারতের কারণে আওয়ামী লীগ তা আমলে নেয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধ্বংস করে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলো। রাজনৈতিক দেশগুলো সাড়ে ১৫ বছর আন্দোলন করেও ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করতে পারেনি। অবশেষে ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত চলে যাওয়ার পর সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সুপ্রিমকোর্টের রেফারেন্সের ভিত্তিতে এ সরকার ৮ আগস্ট শপথ নেয় ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বর্তমান সরকারের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধুমাত্র একটি নির্বাচনই এ সরকারের উদ্দেশ্য নয়। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মূল দাবি ছিলো সংস্কার এবং বিচার। স্বৈরাচার সরকার যেন আর ফিরে আসতে না পারে এটাও ছিলো গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি। সকল রাজনৈতিক দলই সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। সঙ্গত কারণেই সংস্কারের ন্যূনতম কাজ সম্পন্নের পর নির্বাচনের আয়োজন সম্পন্ন করাটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তারা বদ্ধপরিকর।
ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে, অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তারা সমাবেশ, মিছিল ও দলীয় বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে এ সরকারকে আর সমর্থন করবে না এবং আন্দোলনের পথে ধাবিত হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে। তাদের এ ঘোষণা জনগণের মধ্যে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে। অধিকাংশ বক্তব্যই সংস্কার ও বিচারের পর জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে।
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই ৩০ মে একটি জাতীয় দৈনিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের একটি বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক অঙ্গণে ঘোলাটে পরিস্থিতি বিরাজমান তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতের এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তার বক্তব্যে ড. মোহাম্মদ ইউনূস কয়েকদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে ‘নয়া দিল্লী বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে’ বলে যে অভিযোগ করেছেন তা নাকচ করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের এসব অভিযোগ প্রকৃত সমস্যা থেকে দৃষ্টি সড়ানোর চেষ্টা মাত্র। বাংলাদেশ সরকার যেহেতু উদ্বিগ্ন সে ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও শাসন ব্যবস্থার পূর্ণ দায়ভার তাদের সরকারের উপরই বর্তায়। বাইরের কোন শক্তি বা অন্য কেউ এ অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী বলে যখন মন্তব্য করা হয় তখন আসল সমস্যাগুলো থেকে মনোযোগ সরিয়ে অন্যদের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের বক্তব্য দায় এড়ানোর কৌশল বলেই মনে হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। যাতে জনগণের আকাক্সক্ষা ও ম্যান্ডেট নিশ্চিত হয়।
বিএনপি, এনসিপি ও সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে সামনে রেখে ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ড. মোহাম্মদ ইউনূস ক্ষোভ প্রকাশ করলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অবতারণা ঘটে। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর পরিস্থিতি উত্তরণে সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বানের জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানান। ২৪ মে বিএনপি ও জামায়াতের সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ মে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর সেনাপ্রধানের বক্তব্য, বিএনপির নির্বাচনকেন্দ্রিক বক্তব্য নিয়ে যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো তার অবসান ঘটেছে বলে মনে করা হয়েছিলো। ২৮ মে ও ৩০ মে বিএনপি, এনসিপি এবং জাপানে সফররত প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নির্বাচন নিয়ে পরিস্থিতি নতুন রূপ লাভ করেছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন।
২৮ মে ঢাকার পল্টনে তারুণ্যের সমাবেশে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। তিনি সমাবেশে উপস্থিত তরুণ যুবকদের লক্ষ্য করে বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হবে। এ নির্বাচনের জন্য সবাই প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা চলছে। অল্প ও বেশি সংস্কারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এ আলোচনা। মনে হচ্ছে সরকারের কোন ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। আদালত নিয়ে সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব দেখতে পাচ্ছি। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা নষ্ট হয় এমন কোন পদক্ষেপ (অন্তর্বর্তী সরকারের) নেওয়া ঠিক হবে না।
সমাবেশে বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ জোর গলায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তাদের বক্তব্যের সারাংশ হচ্ছেÑ জাতীয় নির্বাচন বিলম্ব করার জন্য অনেকে ষড়যন্ত্র করছে, নির্বাচন বিলম্বের যে কোন ষড়যন্ত্র জনগণ রুখে দিবে। সংস্কার আমরাও চাই, এ সংস্কার একা করা যাবে না। বিচার ও সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর কোন সুযোগ নেই। আমরা নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছিলাম, আমরা প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইনি। কিন্তু তিনি পদত্যাগের নাটক করেছেন।
সমাবেশে আরও বলা হয়েছে তরুণদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার এখন সংকুচিত। একজন নেতা বলেছেন, আপনি ভোটের তারিখ দিতে না পারলে আমরা একটু অপেক্ষা করবো। তারপর আমরাই ভোটের তারিখ দিয়ে দিবো। বিএনপির এ বক্তব্যগুলো বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য উত্তেজনাকর বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা চারদিনের জাপান সফরে থাকা অবস্থায় বলেছেন, ‘আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।’ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নির্বাচন কোন অবস্থাতেই জুন মাস অতিক্রম করবে না। এমনকি ১ জুলাইও হবে না। উপদেষ্টারাও শক্ত কণ্ঠে বলেছেন, আমরা শুধু নির্বাচন করার জন্য আসিনি। আমাদের সামনে তিনটি কাজÑ সংস্কার, বিচার, নির্বাচন। সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন কখনো সুফল বয়ে আনবে না।
প্রধান উপদেষ্টা জাপানের টোকিওতে নিক্কেই ফোরামে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় একটি দল, সব দল নয়। আমার কোন রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবো। অপরদিকে ৩০ মে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, আমরা বলতে চাই সবাই নির্বাচন চায়, একটি লোকে নির্বাচন চায় না তিনি হচ্ছেন ড. মোহাম্মদ ইউনূস।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়, শুধু নির্বাচনই নয়, সংস্কার এবং গণহত্যার বিচার প্রশ্নেও বিএনপির সঙ্গে সরকারের বিরোধ দেখা দিয়েছে। সরকারের বক্তব্য হচ্ছে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের হোতাদের বিচার চায় সারাদেশের মানুষ। ছাত্রজনতার অন্যতম দাবি হচ্ছে সংস্কার। বিএনপি বলছে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে হবে। ন্যূনতম সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যেই যাতে নির্বাচন হয় সরকারকে সে দিকেই যেতে হবে। দেশকে আগে গণতন্ত্রের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ প্রসঙ্গে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার না করে নির্বাচনের দিকে গেলে পরিস্থিতি আগের মতোই হবে। অন্তর্বর্তী সরকার শুধু নির্বাচনকেই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ মনে করে না। নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কার এবং বিচারকেও গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারের এমন অবস্থানের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না বিএনপি।
বিএনপির সমাবেশে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় তারা নির্বাচনের দিনক্ষণ আদায় করে নিতে চাচ্ছে। এ লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনাও সাজাচ্ছে তারা। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময় এর উপর তারা বিশ্বাস রাখতে পারছে না। প্রশ্নটি আস্থা-অনাস্থার। বিশ্লেষকগণ বলেছেন, বিএনপি ১৩ মের পর থেকে রাজপথে যে আন্দোলন করে আসছে, বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের শপথ নেয়ার বিষয়ে তাদের অবস্থান, রাজনৈতিক কর্মসূচি, আদালত কেন্দ্রিক চাপ প্রয়োগের ঘটনা কোন ভালো লক্ষণ নয়। বিএনপি বলার চেষ্টা করছে নির্বাচন বিলম্বিত হলে বিরাজনীতিকরণ বা সরকারের মদদপুষ্ট কোনো একটি কিংস পার্টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকার নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ চেষ্টা যেন সফল না হয় সে জন্য তারা নির্বাচনের দিনক্ষণের দাবিতে আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে।
বিএনপির এ বক্তব্যের পাশাপাশি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রজনতার বক্তব্যও সামনে রাখা প্রয়োজন। যারা বুলেটের সামনে বুক পেতে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে তাদের দাবি হলো গণহত্যার বিচার, সংস্কার অতঃপর নির্বাচন। তারা জুলাই সনদের কথাও বলেছেন। সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর ঐকমত্য কমিশন সকল রাজনৈতিক দলের সাথে প্রথম পর্যায়ের বৈঠক শেষ করেছেন। ২ জুন, ২য় পর্যায়ের বৈঠক আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতে যাচ্ছে। এরপর জুলাই-এর ১৫ তারিখের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। জুলাই সনদ ঘোষিত হলেই নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আর কোন বাধা থাকার কথা নয়।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে জনগণের বড় ধরনের ভোগান্তি ছাড়া একটি স্বস্তিদায়ক সময়ে নির্বাচন হতে পারে বলে পূর্বেই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ফেব্রুয়ারি বা ঈদের পরপরই নির্বাচনের বিষয়ে সাংবাদিকদের সামনে মন্তব্য করেছেন। আমীরে জামায়াত সংস্কার ও নির্বাচন দু’টো রোডম্যাপ এবং দৃশ্যমান বিচার চেয়েছেন। আমীরে জামায়াতের এ মতটি ভারসাম্যপূর্ণ বলে বিভিন্ন মহল থেকে মন্তব্য করা হয়েছে।
অনেক আন্দোলন ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্তিলাভ করেছে। যাদের রক্তের বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিস্টের কবল থেকে মুক্ত হলো সে গণহত্যার বিচার না হলে দেশ রক্তঋণ থেকে মুক্তি পাবে না। আর বিচার যত প্রলম্বিত হবে তত বিচার না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিবে। ছাত্রদরে মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে, সংগত কারণেই বিচার প্রক্রিয়া থেমে যেতে পারে। আর বিচার প্রক্রিয়া থেমে গেলে, রাজনৈতিক সরকার গঠিত হবার পর আবার বিচার কার্যক্রম চালু হতে অনিশ্চয়তা দেখা দিবে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় তাদের প্রধান অঙ্গীকার ছিল গণহত্যার বিচার। দেশের আপামর জনগণ গণহত্যার বিচার চায়।
যে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার কারণে শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছর স্বৈরশাসন কায়েম রেখেছিল এবং হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, মানবাধিকার হরণ, আয়নাঘর তৈরি, বিচার বিভাগকে ধ্বংস, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল এবং জনগণের ভোটাধিকার তথা নির্বাচন ব্যবস্থার দাফন ঘটিয়েছিল; সেই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মূলোৎপাটন চায় জনগণ। সংস্কার ব্যতীত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে পারে না। সুতরাং যে কোন বিবেচনায় সংস্কার অপরিহার্য।
বিএনপি আন্দোলনের যে হুমকি দিয়েছে তার পরিণতি কী হতে পারে তা ভেবে দেখা দরকার। রাজনৈতিক ঐকমত্য ব্যতীত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতে পারে না। অতীতে এ সত্য কথাটি রাজনৈতিক দলসমূহ উপলব্ধি করতে পারেনি। ১৯৯১-১৯৯৬ পাঁচ বছরের শাসনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সকল রাজনৈতিক দল ঐকমত্য হলেও বিএনপি ঐ সময় তা আমলে নেয়নি। বরং যেনতেন প্রকারে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলো। সেটি খারাপ নির্বাচনের একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছিলো। তবে সে ইলেকশনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্টেই গৃহীত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন। এরপর ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সকল দলের মতামতের ভিত্তিতে বিএনপি সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকর বিলটি সংসদে আলোচনার ব্যবস্থা করলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্নদিকে প্রবাহিত হতো। অতীতের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে সংযমী আচরণের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল ঐকমত্য হতে না পারলে রাজনীতি জটিল রূপ ধারণ করতে পারে। নির্বাচনের জন্য যে আন্দোলনের কথা বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে এরকম ঘোষণা বিগত স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বহুবার দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু কোন ফল বয়ে আনতে পারেনি। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শাসনমুক্ত বাংলাদেশে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে বাধ্য করার ঘোষণা বিএনপিকে আরও অজনপ্রিয় করে তুলবে।
বিশ্লেষকগণ বলেছেন, ইতোমধ্যেই বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে অন্যান্য দল ও সাধারণ মানুষের মাঝে বেশ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে প্রত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন, চাঁদাবাজী ও দখলদারিত্বের অভিযোগ উঠেছে বিএনপির বিরুদ্ধে। এতে বিএনপির নেতাকর্মীরা বেশ বিব্রত এবং দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। দ্রুত নির্বাচন না হলে এ পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। যে কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি।
সার্বিক বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক গণহত্যার বিচার ত্বরান্বিত, সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে স্বল্পতর সময়ের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এটাই সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান।
লেখক : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারী।