মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান
১০ মার্চ ১৯২০ সালে লীগ অব নেশন প্রতিষ্ঠা হয়। নানাবিধ বৈষম্যের কারণে তা বিলুপ্ত হয়। ৫১টি জাতির স্বাক্ষর নিয়ে ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ আবার সময়ের প্রয়োজনে জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৯৫টি। প্রতিষ্ঠা থেকেই এতে বৈষম্য চালু হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন ভেটো ক্ষমতা সস্পন্ন জাতিসঙ্ঘের স্থায়ী সদস্য দেশ হিসাবে জাতিসঙ্ঘে বৈষম্য প্রথা শুরু হয়। সে বৈষম্য প্রথা দুনিয়ার শান্তি এখন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বিশ্বশান্তি এখন ভেটো ক্ষমতাধর দেশের হাতে পুতুল হয়ে পড়েছে। ভেটো ক্ষমতা সম্পন্ন দেশগুলোর অন্যায্য চাহিদা মেটাতে ক্ষুদ্র দেশগুলো বাধ্য হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের স্থায়ী সদস্য বড় দেশগুলোর দাদাগিরি সারা দুনিয়ায় বিদ্যমান। বাংলাদেশেও বিএনপি নামক বড় একটি দল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সভায় তাদের দাদাগিরি যথারীতি বহাল রেখে চলেছে। বিশেষ করে ছোট কিছু দলগুলোকে চাপে রেখে এবং কিছু দলকে মুলা দেখিয়ে বস করে যাচ্ছে। বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট গুলো এক প্রকার বৈষম্যমূলক কার্যক্রম। বলতে হয় এগুলো নোট অব ডিসেন্ট নয় বরং ভেটো ক্ষমতা। গত দু’দিন আগে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন- সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে দেয়া হবে না। তিনি একটি পক্ষ হলেও তাঁর বক্তব্যটা বিচারকের রায় প্রদানের মত বলেছেন।
বাংলাদেশে ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশবাসীর কাছে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন তিনটি ইস্যু সামনে আসে। ৮ আগস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার গঠন করার পর। তিনি জনআকাক্সক্ষা অনুসারে সংস্কার কাজে হাত দেন। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন ও একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন। বড় একটি দলের দাদাগিরিতে অন্য সব সংস্কার কমিশনের কাজ মূখ থুবড়ে পড়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছিল কিন্তু সেটা এখন হাসপাতালে ভর্তি হতে যাচ্ছে। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে যাচ্ছে রাগ করে যদি প্রফেসর ইউনূস চলে যান দেশ একটা মহাসংকটে পড়বে। সবচেয়ে লাভবান হবে পতিত সরকার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম চলাকালে বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের বক্তব্য ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে কয়েকটি বিষয় মনে হয়েছে, তা হলো-
গিনেচ বুক অব ওযার্ল্ড রেকর্ডে নোট অব ডিসেন্ট : জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ প্রায় ৮০ দিনের কাছাকাছি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে একটা পর্যায়ে পৌঁছায়। বেশ কয়েকটি বিষয় বিএনপিসহ কয়েকটি দল নোট অব ডিসেন্ট দেয়। যেগুলো নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। নোট অব ডিসেন্ট কোনো অন্যায় বিষয় নয়; বরং এটি কোনো দলের একমত না হওয়ার প্রতিচ্ছবি। দুনিয়ার যেকোনো সভায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা সংসদে দ্বিমত পোষণ করে নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার রীতি আছে। নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার পরও বেশির ভাগের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সভায় উপস্থিত সবাইকে তা মেনে নিতে হয়। তবে নোট অব ডিসেন্টগুলো রেকর্ডে থাকে। এর বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশে নোট ডিসেন্টের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার পর অধিকাংশের মতামত অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সেটা সবাইকে মেনে নিতে হয়। সে নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য হয় না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বিএনপিসহ আর ২/৪টি দল এই নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে নানাবিধ অপপ্রচার চালাচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ করছে তারা। সারা দুনিয়ার রীতি উপেক্ষা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিএনপির নোট ডিসেন্টগুলো গ্রহণ করতে পারে? তাছাড়া নোট অব ডিসেন্টগুলো তো জুলাই সনদে থাকছেই। সুতরাং বিএনপির নোট অব ডিসেন্টগুলো ভেটো পাওয়ারের মত, তাই এটাকে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে তালিকাভুক্ত করার উচিৎ।
গণভোট কখন হওয়া উচিৎ : জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে গণভোটের প্রশ্ন আসে। গণভোট ও তার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা মত আসছে। যেহেতু জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কোন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয় এবং দেশের ৩০ বা ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই এ কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গণভোটের প্রয়োজন আছে। কিভাবে হবে গণভোট? একাধিক মতামত আসলেও অধিকাংশ সদস্যদের মতের বিপক্ষে যারা মত দিয়েছেন বা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন তাদের ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টগুলো গণভোটে দিলে জনগণই প্রকৃত রায় দিবে। গণভোট কখন হবে এ প্রশ্নটি বিরাট ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনের আগে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বা মতভেদ বাড়ে। তার ফলে তখন দেশের রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। এমনকি হানাহানি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।
প্রাণহানি অবশ্যই গণভোটের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে নভেম্বরের মধ্যে বা ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে গণভোট হলে হানাহানি ও প্রাণহানি কমানো সম্ভব হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে গণভোটও একই সাথে প্রশ্নের মুখোমুখি হবে। সুতরাং বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গণভোট ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পৃথক দিনে হওয়াই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। নির্বাচনের সময় অনেক স্থানে গোলযোগ হয়। এমনকি ভোট গ্রহণ বন্ধ বা স্থগিত হয়। এ রকম ঘটনা ঘটলে গণভোটের হালহকিকত খারাপ হতে পারে।
রাজনীতিতে দাদাগিরি অচল : এদেশের মানুষ ৪৭-এ সংগ্রাম করেছে, ৫২ তে সংগ্রাম করেছে, ৬৯-এ সংগ্রাম করেছে, ৭১-এ নয় মাসে দেশ স্বাধীন করেছে, ৯ বছরে এরশাদকে তাড়িয়েছে, ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়াকে দেড় মাসে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়েছে এবং ২০২৪ সালে কোন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশ গ্রহণ ছাড়া লৌহমানবী শেখ হাসিনাকে জয় বাংলা করেছে। জনগণ এখন রাস্তায় নামতে শিখেছে। ব্যাংক খেকোদের যারা প্রশ্রয় দিচ্ছে, স্বৈরাচারকে যারা পুনর্বাসন করতে চাচ্ছে জনগণই নোট অব ডিসেন্ট ধারীদের ভোট অব ডিসেন্ট দিয়ে ছাড়বে। জনগণের তিন দাবি সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এটা তারা আদায় করেই ছাড়বে। আমাদের বান্ধু রাষ্ট্র ভারত কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় দারাগিরি দেখাতে গিয়ে জয় বাংলা হয়েছে। সুতরাং রাজনীতিবিদরা অত্যন্ত হিসাব করে পদক্ষেপ নিবে বলে আশা রাখি। জনগণ যেহেতু রাস্তায় নেমেছে, প্রাণ দিতে শিেিখছে। সুতরাং রাজনীতিতে দাদাগিরি এখন অচল।