আলাউদ্দিন ইমামী
যার নামে আগস্ট মাসের নাম করণ করা হয়েছে তিনি ছিলেন রোমান সম্রাট জুলিয়াসের পালকপুত্র। তার নাম ছিল অগাস্টাস। জুলিয়াসের মৃত্যুর পর তিনি রোম সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন। অগাস্টাস থেকেই আগস্ট। লাতিন ভাষায় অগাস্টাস শব্দের অর্থ মহান, শ্রদ্ধেয়, রাজকীয়, অভিজাত, সম্মানিত ইত্যাদি। লাতিন ভাষাও আল্লাহর দেয়া ভাষা। আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন রং ও ভাষা দিয়ে সৃষ্টি করেছি।” (আল-কোরআন) হয়তো এ কারণেই আল্লাহ এ মাসে জালিমকে পরাজিত করে মুসলমানদেরকে বিজয় দিয়ে সম্মানিত করেছেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, বিশ্ব মানবতার ত্রাণকর্তা পেয়ারা নবী (সা:) এর জন্মও ২৯শে আগস্ট হয়েছিলো। মানুষ আল্লাহর প্রিয় এবং সেরা সৃষ্টি। যে জাতের, বর্ণের, বংশের এবং যে অঞ্চলেরই হোক। আল্লাহ বলেন, আমি বনি আদমকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছি। তাই তিনি জালিম ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও শাসককে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে ছাড় দিয়েছেন, ছেড়ে দেননি। যখন ধরেছেন ভালোভাবেই ধরেছেন। তিনি বলেন, “হে নবী আপনার রবের ধরা খুবই শক্ত।”
অনেক বড় বড় জালিম, নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর শাসককে এই আগস্ট মাসেই আল্লাহ নাকানিচুবানি খাওয়ান।
জালিম, অত্যাচারী, ক্ষমতালোভী, স্বৈরাচারী শাসকগণ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য মানুষ খুন করাকে তাদের পেশায় পরিণত করে। ফেরাউন তাদের অগ্রজ। শিশুরাও রেহাই পায়নি তার হাত থেকে। নেতানিয়াহুও আধুনিক ফেরাউন হয়ে গাজায় নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে। বলতে গেলে সে হার মানিয়েছে ফেরাউনকে। মহানবী (সা:) এর উম্মত দাবি করে নিষ্পাপ বাচ্চাসহ নিধন করেছে নবীর বংশ। আধুনিক যুগের হাসিনা হার মানিয়েছে জাহেলী যগের হিন্দাকে। যে প্রিয় নবীর (সা:) চাচা হযরত হামজার কলিজা চিবিয়ে খেয়েছিল। এভাবে যুগে যুগে জালিম শাসকগণ মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম, ক্ষমতার লোভে নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাতে এতটুকু কৃপণতা করেনি। এসব জালেমরা আল্লাহর দুশমন, মানবতার দুশমন। এদের সহযোগী যারা তারাও এদের মত অপরাধী। আল্লাহ বলেন, “তোমরা জালিমদের সহযোগী হইও না। আল্লাহ জালিমদের ভালবাসেন না।”
ব্রিটিশ বেনিয়ার দল ব্যবসায়ী হয়ে এসে চক্রান্তের জাল বুনে প্রভু হয়ে বসেছিল ভারতবাসীর উপর। রাতদিন জুলুম নির্যাতনে লিপ্ত ছিল। প্রায় পৌনে দু’শ বছরের শাসনামলে অমুসলিমদের হাত করে হাজার হাজার মুসলিম নিধন করেছে। পেশোয়ার থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত প্রতিটি গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল খুন করা আলেমের লাশ। মানুষ যেন ভীত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে বিরত থাকে। রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করে ক্ষমতায় ঠিকে থাকতে চেয়েছিল জালিমের দল। ফল তেমন হয়নি। যত পড়েছে রক্ত, আন্দোলন হয়েছে দ্বিগুণ। শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিলে মুসলমানগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ব্রিটিশ জালিমদের তাড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
২০০১, সালে আমেরিকা টুইন টাওয়ারের হামলাকে ওসামাবিন লাদেনের কারসাজি আখ্যা দিয়ে, তাকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলে আফগান ও লাদেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আফগানিস্তানে হামলা চালায় এবং দখল করে। ২০ বছর যুদ্ধ করে, সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেও তারা আফগানিস্তানের তালেবানদের কাবু করতে পারেনি। অথচ তখন আফগানে প্রতিষ্ঠিত সরকারও আমেরিকার মদদপুষ্ট ছিল। আসলে আল্লাহর সাহায্য থাকলে কেউ কিছু করতে পারে না। শুধু একটু ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ২০০১ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত পুরো ২০ বছর তালেবান যোদ্ধারা লড়াই করে, আড়াই হাজার শত্রু সেনাকে যমঘরে পাঠিয়ে আমেরিকাকে বাধ্য করেছে পরাজয় বরণ করতে। আমেরিকা ১৫ আগস্ট পরাজয় স্বীকার করে নেয় এবং ৩১ আগস্ট আধুনিক সকল যুদ্ধাস্ত্র তালেবানকে দিয়ে কোন মতে প্রাণ নিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করে চলে যেতে হয়।
শেখ মুজিব সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একটিমাত্র দল বাকশাল গঠন করেছিলেন। মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি চালু করেছিলেন শেখ মুজিব। সব পত্রিকা বাতিল করে মাত্র ৪টি পত্রিকা চালু রেখেছিলেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী ও মুজিব বাহিনী গঠন করে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সে ১৫ আগস্টেই শেখ মুজিবকে পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যা করেছে তার লোকেরাই। যারা জুলুম করে আল্লাহর নাফরমানি করে তাদের পরিণতি এমনই হয়।
মুজিবের চাইতে ঢের বেশী করেছে মুজিব কন্যা। ফলে ছাত্র-জনতা এ রকম বেটি কেন জন্ম দিল বলে সারা দেশে মুজিবের মূর্তি ভাংচুর করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলেন, মুজিবের কন্যাই মুজিবকে ডুবিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যে ভারত তাকে মুখ্যমন্ত্রীর টিপ পড়িয়ে দিয়েছিল সে মোদি দাদার আশ্রয়ে চলে গেছে। চলে যেতে হয়েছে।
হাসিনার আমলনামা খুবই খারাপ এমন কোন পাপ, অন্যায়, দুর্নীতি, জুলুম নেই যা হাসিনা করেনি বা করায়নি। কারা নির্যাতিত মজলুম আলেমদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন হাসিনা এবং তার বাহিনীর নির্যাতন কত নির্মম, নির্লজ্জ, বীভৎস ও পাশবিক ছিল! ২৮ অক্টোবর হাসিনার লগিবৈঠার হিংস্র তান্ডব গোটা বিশ্ব দেখেছে। এসব অন্যায় কাজ তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাদের উপর গজব দিলেন। সামান্য কোটা আন্দোলনকে কেঁচো খুঁড়তে সাপ ওঠার মতো করেই মহাবিপজ্জনক বানিয়ে দিলেন। রাধা ভাতও খেতে পারেননি। ১৭ বছর অপেক্ষা ও সহ্য করে আল্লাহ এমন ধরা ধরলেন সবাইকে পালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। মজলুম আলেমদের অভিশাপে ৩৪ জুলাই এক দফা ঘোষণা হল; আল্লাহর গজবে ৩৬ জুলাই হাসিনাকে পালাতে হলো। আল্লাহ ঠিকই বলেছেন- ক্ষমতা দেয়ার মালিক আল্লাহ; ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার মালিকও আলাহ। এরা তওবা করে, ক্ষমা চেয়ে, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ত্যাগ করে, আল্লাহর পথে ফিরে আসা উচিত। অন্যথায় আখেরাতে এদের জন্য আরো কঠিন আজব অপেক্ষা করছে। নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ তাদেকে হেদায়ত করুন। যে ইউনুসকে হাসিনা পদ্মা নদীতে চুবিয়ে তুলতে চাইল, আল্লাহ তাকেই বসিয়ে দিল হাসিনার চেয়ারে। আল্লাহ বলেন, “তারা চাল চালে, আল্লাহও কৌশল করেন, আল্লাহ সর্বোত্তম কৌশলী।”
আল্লাহ যে এ দিন ছাত্র নেতাদের নেতৃতে জাতিকে হাািসনার জুলুম ও ভারতীয় আধ্যিপত্যবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছেন, এ জন্য পুরা জাতি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। জুলাই আন্দলনের ছাত্র জনতা এরা ছিল হাসিনার হস্তী বাহিনী থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য খোদায়ী আবাবিল পাখি। তাদেরকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। প্রধান সেনাপতি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও আন্তরিক ধন্যবাদ তাদের দেশপ্রেমিক ভূমিকার জন্য। আগস্ট বিপ্লবের চেতনা ধরে রাখার, ভারতীয় আধিপত্যবাদমুক্ত বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য, ছাত্র-জনতার ঐক্য সুদৃঢ় রাখতে সক্রিয়, সচেতন থাকতে হবে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী নেতৃবৃন্দকে। এ আন্দোলনের নায়কদেরকে জাতীয় বীর ঘোষণা করে, সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে হাসিনার দুঃশাসনের প্রকৃতি এবং জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ত্যাগ ও আন্দোলনের নায়কদের সংগ্রামী ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হবে। জাতিকে জানাতে হবে ভারত হাসিনাকে দিয়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ বিরোধী কত এবং কী কী চক্রান্ত করিয়েছে। চক্রান্তকারীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, “তারা উপরে যা দুশমনি দেখায় তার চাইতে আরো বেশি ক্ষতিকর ও মারাত্মক দুশমনি তারা অন্তরে গোপন রাখে।”
লেখক : খতিব ও প্রাবন্ধিক।