প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

সরকারের দায়িত্ব গ্রহণে ড. ইউনূসের আট মাসের কিছু বেশি সময় হলো। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছর বা আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে তিনি সরে দাঁড়াতে চান। ড. ইউনূস যে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন সে ব্যাপারে জনগণের পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে।

রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে ড. ইউনূসের মাত্র আট মাসের শাসনামল দেখে। ড. ইউনূস আপাদমস্তক একজন সৎ, ভদ্র, নম্র ও গণতন্ত্রী মানুষ। তাঁর তুলনা তিনিই। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর একটা ভঙ্গুর রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং প্রতিবেশী ও পতিত সরকারের লোকজনের ক্রমাগত বিরূপ প্রচারণা ও নানামুখী তৎপরতার মোকাবেলায় দেশটাকে স্থিতিশীল অবস্থার দিকে এগিয়ে নেয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় জনগণ তাঁর প্রতি মুগ্ধ এবং ফেসবুক ও সাধারণ মানুষের কথাবার্তায় ড. ইউনূস সরকারের প্রশংসা ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। জনগণ চায় নতুন করে যেন আর কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম না হয়। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ড. ইউনূস অনেকগুলো কমিশন গঠন করেছেন। জনগণের দাবি আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন।

মাত্র আট মাসে ড. ইউনূস সরকারকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সরকার নানাবিধ আন্দোলন মোকাবেলায় শক্তি প্রয়োগ না করে পরম ধৈর্যের পরিচয় দান করেছেন। সেই র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, সশস্ত্র বাহিনীই রয়েছে যেখানে কোনো গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নেই, শক্তিপ্রয়োগ নেই বরং আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়া শোনার চেষ্টা করা হয়েছে এবং যৌক্তিক হলে মেনে নেয়া হয়েছে। ড. ইউনূসের বক্তৃতায় নেই কোনো বাগাড়ম্বর, আছে দেশ ও মানুষের সমস্যা সমাধানের দিকনির্দেশনা। রাজনীতিবিদদের সাথে উপর্যুপরি আলোচনা এবং অতীতের ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার দোসরদের বাদ দিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে সক্রিয় ছোটবড় সবাইকে মূল্যায়ন করে সবার সাথে মতবিনিময় করার চেষ্টা করা হয়েছে। সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা গণতন্ত্রের যে মৌলিক দাবি তা ড. ইউনূস প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁকে দেখে সমাজের সৎ লোকদের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার প্রবণতা বাড়বে। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছাড়া জনগণের সত্যিকার কল্যাণ সম্ভব নয়। এজন্য আল্লাহপাক সকল নবি-রসুলকে সমসাময়িক রাজশক্তির মোকাবেলায় দাঁড় করিয়েছেন।

প্রশাসন, বিচার ও ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে পতিত সরকারের সুবিধাভোগীরা ঘাপটি মেরে আছে। বিস্ময়ই লাগে, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন নিজমুখে প্রকাশ্যে বলেন, তাঁর পিয়নও চারশো কোটি টাকার মালিক ও হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না তখনও কিছু লোককে তাঁকে ও তাঁর দলকে সমর্থন করতে দেখি তখন সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, দুর্নীতির শিকড় কতো বিস্তৃত। এরাই হলো অন্ধ, বধির ও বোবা। আমাদের দেশে দুর্নীতি প্রসারের মূল কারণ রাজনীতির ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তপনা। রাজনীতির অঙ্গনে সীমাহীন দুর্নীতিই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এটি রোধ করার প্রধান উপায় মানুষের মাঝে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া এক আজব ব্যাপার। সমাজে যারা দুর্নীতি ও খুন-খারাবি করে এরা কেউই পরকালে বিশ্বাসী না, নিরেট কাফির বা মুনাফিক বৈ আর কিছু নন। আল্লাহপাক সূরা মাউনে বলেছেন, পরকালে অবিশ্বাসী তারাই যারা ইয়াতিমের সাথে দুর্ব্যবহার করে ও মিসকিনকে খাবার দানে উৎসাহিত করে না, আবার নামাযে সিরিয়াস না। আবার সূরা হুমাজায় বলা হয়েছে, যারা মানুষকে সামনাসামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে তাদের ধ্বংস নিশ্চিত। এতটুকু অপরাধের পরিণতি যদি এমন হয় তাহলে যারা গুম-খুন, সম্পদ পাচার ও সুদ-ঘুসের সাথে জড়িত তাদের পরিণতি কী হতে পারে? আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তির পক্ষে কি জুলুম করা সম্ভব? এককথায় জবাব, না। এতে স্পষ্ট যে, জালেমের জন্য জান্নাতে কোনো বরাদ্দ নেই, জাহান্নামই তার ঠিকানা। ফিরে আসলে (তওবা করলে) বিষয়টি আলাদা হতে পারে। জুলুমের বড়ো অংশটা আসে একশ্রেণীর রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে। জালেম হিসেবে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় নমরুদ, ফেরাউন, আবু জেহেল ও আবু লাহাবদের নাম। দেশে দেশে জালেম শাসকরা মূলত তাদেরই উত্তরসূরী।

ড. ইউনূসের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। জনগণ শাসক হিসেবে একমাত্র ড. ইউনূসকে পেয়েছে যার পরিচিতি ও খ্যাতি বিশ্বজোড়া অথচ অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, ধৈর্যশীল ও সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক। দেশটাকে লুটেপুটে খাওয়ার মতো ধান্ধাবাজ নন তিনি। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে আর একটি নাম যোগ হয়েছে যার নাম আশিক চৌধুরী। তাঁকে দিয়ে বর্তমান প্রজন্ম স্বপ্ন দেখছে নতুন কর্মসংস্থানের ও নতুন বাংলাদেশের। এর পেছনেও কৃতিত্ব ড. ইউনূসের। দেশে ব্যাপক বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জনগণ বিশ্বাস করে যে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির পরেই নির্বাচন হওয়া দরকার। ফলে পরবর্তী সরকারের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে চলা সম্ভব হবে। রমযানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি এবং ঈদে ঘরে ফেরা ও ঈদ উদযাপন শেষে নির্বিঘ্নে কর্মস্থলে ফেরা অতীতে কখনো ঘটেনি। এটাও তাঁকে জনগণের কাছে প্রিয় করে তুলেছে।

প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন আদৌ সম্ভব নয়। এমনিতেই দখলদারিত্বের অভিযোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই বলে শুধু হাত বদল হয়েছে মাত্র। বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় এমন সকল দলের কর্মী সমর্থক ছড়িয়ে আছে সারা দেশে এবং আনুপাতিক পদ্ধতিতে সকল দলের ভোট মূল্য পাবে।

শতকরা এক ভোট পেলে সে দলের প্রাপ্ত আসন হবে তিনজন। ফলে কোনো দলের অনুকম্পা ছাড়াই সংসদে সকল দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং সংসদ হবে যোগ্য লোকদের মিলনকেন্দ্র। সরকার গঠন ও দেশের কল্যাণে সংসদ হবে এক নীতিনির্ধারণী ফোরাম। এলাকার উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ ভূমিকা রাখবে। সব এলাকায় রাজনৈতিক গডফাদার থাকে এবং স্থানীয় প্রশাসনে তাদের বিরাট প্রভাব রয়েছে ও নিজেদের রয়েছে মাস্তান বাহিনী। বিদ্যমান ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভণ্ডুল করেছে একই প্রক্রিয়ায় বর্তমানে যারা প্রভাবশালী তারাও করবে, কোনো সন্দেহ নেই।

দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে পরিবর্তিত পরিবেশে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান জরুরি মনে করি। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতি সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে পারে। নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত থাকলে যতো দ্রুত সম্ভব স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে জাতি উপকৃত হবে।

ড. ইউনূসের সরকারে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বাধা না দিলেও জনমত দ্রুত উঠানামা করে। গণতন্ত্রে এটিই সৌন্দর্য। তাই দেখি মানুষ দ্রুত ভুল স্বীকার করে নিজেকে সংশোধন করে নেয়। গণতন্ত্রের পথে আমাদের যাত্রা মসৃণ হোক। দেশের রাজনীতি পশুশক্তির প্রভাবমুক্ত হোক এবং সভ্য, ভদ্র, বিনয়ী ও ধৈর্যশীল মানুষ এগিয়ে আসুক- এই হোক আমাদের কামনা।

লেখক : সাবেক উপাধ্যক্ষ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।