আসিফ আরসালান

আজ লেখার মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে কয়েকটি উদ্বেগজনক সংবাদ দিচ্ছি। ২৯জুন দৈনিক কালের কন্ঠের একটি খবর সামাজিক মাধ্যমে ফটোকার্ড হিসাবে পোস্ট করা হয়েছে। ঐ পোস্টে সাইদুর রহমান পাভেল নামক একজন অভিনেতা বলেছেন, “এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটা তো আরও খারাপ হয়ে গেলো। এখন দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। এখন তো মনে হচ্ছে ভুল করেছি ভাই। ভুল করেছে সবাই”। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া আর একটি ফটোকার্ডে অভিনেত্রী বাঁধন লিখেছেন, “জুলাই বিপ্লবের পর আমি আশাবাদী ছিলাম, কিন্তু ভুল করেছি”।

একজনের পরিচয় অভিনেতা, আরেকজনের পরিচয় অভিনেত্রী। দু’জনই বলছেন তারা ভুল করেছেন। কী ভুল করেছেন? জুলাই বিপ্লবে অংশ নিয়ে? তারা কি জুলাই-অগাস্টের উত্তাল দিনগুলোতে জনতার সাথে ছিলেন? ছিলেন না। আজমেরি হক বাঁধন তো আওয়ামী রাজনীতি করতেন। এখনো সম্ভবত করেন। এখন বলছেন জুলাই বিপ্লব ভুল ছিলো। তাহলে তিনি বা তারা আবার বিপ্লব পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যেতে চান? আর অভিনেতা সাইদুর রহমান পাভেল বলছেন, এখন নাকি অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে, দেশের মানুষ ভুল করেছে। ভুল করেছে সবাই।

বিপ্লবের এক বছরও পূরণ হয়নি। অথচ এর মধ্যেই আওয়ামী লীগের এ প্রোপাগান্ডা শুরু হয়ে গেছে। তাও সুক্ষ্ম প্রোপাগান্ডা নয়। একেবারে প্রকাশ্যে, ফেসবুকে ফটোকার্ড দিয়ে। এগুলো কিভাবে ঘটছে? কোত্থেকে তারা এত সাহস পাচ্ছেন? আওয়ামী লীগ জামানায় কেউ যদি শেখ হাসিনার আমলে বলতেন যে, আগের আমলই ভালো ছিলো তাহলে তার জায়গা হতো আয়নাঘরে। এগারো মাসে ওরা পরিস্থিতি খারাপ দেখলেন কিভাবে? ২৩৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ কি পাচার হয়েছে? এ সরকার কি এগারো মাসে ১৪০০ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে? আসলে তো একজন মানুষকেও হত্যা করা হয়নি। রাজনৈতিক কারণে একজনকেও গ্রেফতার করা হয়নি। ইসলামী টেলিভিশন, দিগন্ত টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান এবং পিস টিভির মতো চারটি টেলিভিশন কেন্দ্র তখন বন্ধ করা হয়েছিলো। এখন কি একটি টিভি চ্যানেলও বন্ধ করা হয়েছে? দৈনিক আমার দেশকে বন্ধ করা হয়েছিলো। এখন কি একটি পত্রিকাকেও বন্ধ করা হয়েছে? কোনো পত্রিকাকে কি ওপর থেকে বলা হচ্ছে যে, এটা ছাপিয়ো না, ওটা ছাপিয়ো না? বরং যার যা মনে হচ্ছে তাই লিখে যাচ্ছে।

আমার প্রশ্ন হলো, সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয় এব্যাপারে কী করছে? ড. ইউনূস বলেছেন যে, মাহফুজ আলম নাকি জুলাই বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড। তো সে মাস্টার মাইন্ড সাহেব কি এসব দেখছেন না? তিনি কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন? সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী তো সিনেমার লোক। তিনি নিশ্চয়ই এদেরকে চেনেন। তার চোখেও তো এগুলো পড়ার কথা। তিনি কেনো এব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখবেন? নিজেরা যদি এ্যাকশন নেওয়ার সাহস না পান তাহলে নিদেন পক্ষে বিষয়গুলো তো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নজরে আনতে পারতেন। এরা যা বলছেন সেগুলো সরাসরি জুলাই বিপ্লবকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। এদের তো স্থান হওয়া উচিত সে সাবেকি আমলে যাকে বলা হতো লাল দালান, সেখানে। কিন্তু তা না করে তারা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন। শেখ হাসিনার আমলে শেখ হাসিনা সম্পর্কে ফেসবুকে কেউ কোনো কটাক্ষ করলে, কটাক্ষকারী যদি বান্দরবানেও থেকে থাকে, তাহলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে পাকড়াও করা হতো। তারপর রিমান্ড, সেখানে অমানুষিক জুলুম এবং তারপর সিধা এক বছরের জেল। শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ করার তথাকথিত অপরাধে কলেজের অধ্যাপকের জেল হয়েছে। গত ১৫ বছরে অসংখ্য ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, অনেক মানুষের চাকরি খাওয়া হয়েছে। এসব কথা কি ঐ বাঁধন আর পাভেলরা ভুলে গেলেন? আরো অনেক কথা আছে।

ইদানীং কথায় কথায় বলা হয়, মব জাস্টিস। আপনারা মব জাস্টিসের দেখেছেন কী? কথায় কথায় বলা হয়, বিনা বিচারে কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না। আমি নিজেও বলি, মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিনা অপরাধে বা বিনা বিচারে কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে কয়েক হাজার মানুষের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কাদের সিদ্দিকী স্বয়ং রাইফেলের বেয়োনেট দিয়ে ৩ ব্যক্তিকে হত্যা করেন (বাংলা ট্রিবিউন)। তারপর প্রচার করা হয়, ঐ ৩ জন নাকি রাজাকার ছিলো। তো কাদের সিদ্দিকীর সহস্তে হাজার হাজার লোকের সামনে বিনা বিচারে এ হত্যাকাণ্ড কি মব জাস্টিস নয়? এর চেয়ে বড় মব জাস্টিস আর কি হতে পারে? তখন তো কেউ এটাকে মব জাস্টিস বলে প্রতিবাদ করেনি।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে জামায়াতে ইসলামীর জনসভা হচ্ছিলো। প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনার আমলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলানো জামায়াত আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। তখন পুলিশের আইজি ছিলেন আনোয়ারুল ইকবাল। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে আমি ঐ সভা দেখছিলাম। বিকেলে হঠাৎ হাউজ বিল্ডিংয়ের গলি এবং জিপিওর পাশ দিয়ে, অর্থাৎ দু’দিক দিয়ে বেশ কয়েকজন যুবক হাতে লাঠি এবং রাম দা নিয়ে জামায়াতের মিটিংয়ে হামলা করে। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে বেপরোয়াভাবে হামলা চালাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে লাঠি দিয়ে মারতে মারতে অন্তত ৬ জনকে শহীদ করে। ছাত্র ইউনিয়নের বাপ্পাদিত্য নামের এক নেতা একজন শহীদের বুকের ওপর উঠে নৃত্য শুরু করে। এ রক্ত হিম করা হত্যাকাণ্ড যখন চলছিলো তখন সভার আশে পাশের পুলিশ নির্লিপ্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মাওলানা নিজামী বারবার পুলিশের আইজি আনোয়ারুল ইকবালকে ফোন করেন। কিন্তু তার ফোন পাওয়া সত্ত্বেও পুলিশ নির্বিকার থাকে। আজ যারা মব জাস্টিস বলে চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছেন, সেদিন অর্থাৎ ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর মব জাস্টিস কোথায় ছিলো? এর চেয়ে বড় এবং নারকীয় মব ভায়োলেন্স আর কোনো দিন ঘটেনি। তখন এসব মব জাস্টিসের ব্যাপারীরা কেনো ছিলেন স্পিকটি নট?

১৯৬৯ সালের ১৫ অগাস্ট টিএসসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র আব্দুল মালেককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সকলেই দেখেছেন, ছাত্রলীগের পাণ্ডারা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। যে ব্যক্তি ছাত্রলীগের গুণ্ডাদেরকে মালেক হত্যার নির্দেশ দেন, সে ব্যক্তি মারা গেছেন। তাই আর আজ তার নাম নিলাম না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তখন কোথায় ছিলেন এসব সুশীল? কোথায় ছিলো মব জাস্টিস?

পাভেল ও আজমেরি বাঁধনেরা তো নাচের পুতুল। সীমান্তের ওপার থেকে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদিরা এবং তাদের আজ্ঞাবহ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ যে জুডিশিয়াল কিলিং বা বিচারিক হত্যা করলো তার বেলায়? এখন তো এটি প্রমাণ হয়ে গেছে যে জামায়াতের ৫ নেতা এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ ৬ নেতাকে বিচারের নামে মহাতামাশা করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে। এটি আমাদের কথা নয়, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের মাধ্যমে এ অনুক্ত কথাটি বাঙময় হয়েছে। জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে আগের সুপ্রিম কোর্ট ফাঁসির রায় দিয়েছিলো। আগের সুপ্রিম কোর্টের আমলেই এটিএম আজহারের তরফ থেকে রিভিউ পিটিশন করা হয়। সে রিভিউ পিটিশনটি চূড়ান্তভাবে ডিসপোজ অব করেছেন বর্তমান মহামান্য হাইকোর্ট। আজহার সাহেবকে শুধুমাত্র বেকসুর খালাসই দেননি, বরং তার প্রতি বিচারের নামে যে প্রহসন করা হয়েছে তার জন্য সুপ্রিম কোর্ট দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

শেখ হাসিনার সুপ্রিম কোর্ট এটিএম আজহারের প্রতি বিচারের নামে যে অবিচার করেছিলেন, সে একই অবিচার মওলানা নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামাান, মীর কাশেম আলী এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতিও করা হয়েছে। আফসোস, তাদের ফাঁসি শেখ হাসিনা কার্যকর করেছেন। যদি তারা বেঁচে থাকতেন তাহলে আজহারের মতো তারাও আজ বেকসুর খালাস পেতেন।

আমার এবং সে সাথে দেশবাসীর প্রশ্ন, মাহমুদ হোসেন, এসকে সিনহা, ওবায়দুল হাসান, এনায়েতুর রহিমরা মানুষকে ইনসাফ দেয়ার পরিবর্তে আইনের কাঠগড়ায় তুলে যেভাবে হত্যা করলেন সেব্যাপারে এ সব সেক্যুলার, বাম, ভারতপ্রেমী আঁতেলরা মুখ সেলাই করে বসে আছেন কেনো? এখন তো দেখছি, পান থেকে চুন খসলেই গেলো গেলো বলে ওরা চিৎকার শুরু করেন। কোথায় গেলেন এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না?

ধর্ষণ অবশ্যই অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এজন্য দণ্ডবিধি সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এখনো এখানে সেখানে দু’চারজন নারী ধর্ষিতা হচ্ছেন। কালপ্রিটদেরকে ধরে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হোক। যারা ধর্ষণ নিয়ে এ সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, কোথায় ছিলেন তারা যখন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানিক ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন করে? সে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বুক ফুলিয়ে গর্ব করে যে আজ সে নারী ধর্ষণের মহোৎসবে এক শতজনকে ধর্ষণ করলো এবং এর মাধ্যমে তার ধর্ষণের সেঞ্চুরি পূরণ হলো। এত বড় বীভৎস এবং নারকীয় ঘটনার পর আজ সে কোথায়? এ ধর্ষককুল শিরোমনিকে হাসিনা সরকার সেফ এক্সিট দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। তখন কোথায় ছিলেন রোকেয়া প্রাচী, খুশি কবির গংরা?

যেসব কথা আজ আমরা বললাম সেসব কথা তো সরকারের বলার কথা। কিন্তু এভাবে তথাকথিত নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নামে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি নিতে থাকলে এক সময় সেগুলো বুমেরাং হয়ে সরকারের দিকেই ফিরে যাবে।

যে বিষয়টি নিয়ে আজ লিখতে চেয়েছিলাম সেটি স্থানাভাবে আর লেখা হলো না। পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছা রইলো।