স্ট্রিট ফুড হলো রাস্তায়, বাজারে বা মেলার মতো জনবহুল জায়গায় বিক্রি করা খাবার, যা সাধারণত পোর্টেবল ফুড কার্ট বা বুথ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের নগরজীবন কিংবা গ্রামীণ আড্ডায় জনপ্রিয় মুখরোচক স্ট্রিড ফুডের মধ্যে ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, হালিম, সিঙ্গারা, ডালপুরি, ভেলপুরি চটকদার কাবার, শর্মা তেলে ভাজা পরোটা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ব্যস্ত নগরীর মোড়ে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে এসব খাবারের ছড়াছড়ি। স্বল্পমূল্য ও সহজলভ্য হওয়ায় সব শ্রেণি পেশার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব খাবার খাচ্ছে। অথচ খাবারগুলো কতটুকু শরীরের জন্য নিরাপদ, তা কেউ ভাবে বলে মনে হয় না। ভাবলে এভাবে রাস্তার নোংরা পরিবেশে খাবার গ্রহণ করতো না। এ খাবার সবই খারাপ, তা আমি বলছি না। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে খাবারগুলো শরীরের জন্য নিরাপদ নয়; বরং শরীরে অসুখ বাঁধছে। বিশেষ করে ডায়রিয়া, বদহজম, লিভারের অসুখ, কিডনির অসুস্থতাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়াচ্ছে। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা কত উন্নত তা করোনাকালীন সময়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। দেশে কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে, এমন মানুষের অনুমিত সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (সূত্র ঃ ৯ মার্চ ২০২৪, প্রথম আলো)। কিডনি রোগের চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়ে বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছেন। স্ট্রিট ফুডের নামে আমরা যে বিষ খাচ্ছি তা প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যেন আমরা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারি।
বেশ কয়েক বছর আগে স্ট্রিট ফুড নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম। বিদেশী এক লোক বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগর দায়রা ও জজকোর্টের সামনে দিয়ে যাতায়াত করার সময় আশপাশের খাবারের দোকানগুলোর খাবার বিতরণের দৃশ্য দেখে বলেছিলেন- ‘‘এতদিন মনে করেছিলাম ঈশ্বর নেই। এখানে এসে বুঝতে পারলাম, ঈশ্বর একজন আছেন। তা না হলে এরকম নোংরা পরিবেশের খাবার খেয়ে মানুষ কিভাবে সুস্থ ও বেঁচে থাকতে পারে!’’ এত গেল গল্পের কথা। বাস্তবেও তাই! শুধু পুরান ঢাকার জজকোর্ট নয়, সারা দেশের ফুটপাতগুলোতে একই অবস্থা। তার কিছু কারণও রয়েছে। স্ট্রিড ফুড যারা বিক্রি করেন তাদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের মানুষ। তাঁরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে রাস্তার পাশে নোংরা পরিবেশে খাবার বিক্রি করে সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করেন। ইচ্ছা থাকলেও তারা স্বাস্থ্যসম্মত দোকান সাজাতে পারেন না। এমনকি নিরাপদ উপকরণও সংগ্রহ করতে পারেন না। এসব ব্যবসায়ীদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়ালে স্ট্রিট ফুড খাবার বিষে পরিণত হতো না। সিটিকরপোরেশন এলাকায় যত স্ট্রিট ফুড ব্যবসায়ী আছে তাদের সবাইকে একই ছাতার নিচে আনা এবং লাইসেন্স এর আওতায় আনা প্রয়োজন। প্রয়োজন খাবার বিক্রির বিষয়ে বিক্রেতা এবং ক্রেতাকে সচেতন ও সাবধান করা। মানুষের মৌলিক চাহিদার ভেতর খাদ্য একটি অন্যতম মৌলিক চাহিদা। সুতরাং বাঁচার জন্য প্রত্যেকটি মানুষের বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু হোটেল- রেস্তোরাঁয় ভেজাল বা বাসি খাবার বা পচা খাবার সরবরাহের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা হয়। কিন্তু ভেজাল থামেনি। ফলে বিশুদ্ধ খাবার অনেক সময় অখাদ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। ইদানিং আখের রসের শরবত বিক্রির বৈচিত্র্যময় সরবরাহ দেখা যায়। এসব শরবত কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত তা বিবেচনার দাবি রাখে। তবে লক্ষণীয় যে যিনি শরবত বিক্রি করছেন কিংবা যে পাত্রে ক্রেতাকে খাওয়ার জন্য সরবরাহ করছেন কোনটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ফুচকা, ঝালমুড়ি, চটপটি যারা বিক্রি করেন তাদের চেহারা দিকে তাকালে খাবারের রুচিবোধ চলে যায়। সেখানে কিছু মানুষ দিব্যি মজা করে এগুলো খাচ্ছে! এর পরিণতি হলো- মহাখালীর কলেরা হাসপাতাল আর শিশু হাসপাতালের বিছানায় গড়াগড়ি।
স্ট্রিট ফুড খাবারে অধিকাংশ সময় ধুলোবালি, ধোঁয়া, মাছি-মশার অবাধ বিচরণ চোখে পড়ে। বিশেষ করে রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে বা গণপরিবহনের আশেপাশে যেসব দোকান বসে, সেখানকার খাবার খেয়ে দ্রুত অসুস্থ হওয়ার সম্ভবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিক্রেতাদের অনেকেই হাত ধোয়ার সুযোগ পান না বা পানির অভাবে হাত না ধুয়েই খাবার পরিবেশন করেন। অথচ ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ে এ ব্যাপারে নির্বিকার। বিক্রেতা বিক্রি করছেন, ক্রেতা কিনছেন এবং খাচ্ছেন। এ সব অস্বাস্থ্যকর খাবার যারা খাচ্ছেন তারা কেউ নিরাপদ নন। কারণ অধিকাংশ দোকানদার একই তেল বারবার ব্যবহার করছেন। আবার বানানো খাবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিক্রি করার পর যা অবশিষ্ট থাকে তা আবার পরের দিন বিক্রি করছেন। এসব খাবার ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। এসব খাবার গ্রহণ করলে রক্তে কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ট্রান্সফ্যাটমুক্ত খাবার নিশ্চিত করা না গেলে বৈশ্বিকভাবে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের হার আরও বাড়বে। অথচ আমাদের দেশে এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি দৃশ্যমান নয়। ফলে প্রায় প্রতিটি কিন্ডারগার্ডেন ও প্রাইমারী স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে এ ধরনের খোলা খাবার নির্বিচারে বিক্রি হচ্ছে। বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া অথবা আসার পথে এসব অনিরাপদ খাবার খাচ্ছে। অনেক সময় অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে কলিজারটুকরার সন্তানকে বিষ খাওয়াচ্ছেন। সবাই দেখছে। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে না। এটা বিপদজনক। আর একটা বিপদজনক ব্যাপার হচ্ছে এ সব খাবারের কারণে কিডনি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে,যা আগেই উল্লেখ করেছি। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লিভারের রোগীর সংখ্যা। এটা উদ্বেগজনক। রোগীরা যখন চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয় তখন বোঝা যায় এর ক্ষতির দিকটা। একদিকে স্বাস্থ্যহানি, অপরদিকে সীমাহীন চিকিৎসা খরচ এসব রোগীর জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। একজন কিডনী রোগীর বা একজন লিভারের রোগী অথবা ক্যান্সারের রোগীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে বহু পরিবার ফতুর হয়ে গেছে। এসব বিষয়কে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এখানে জীবন হার মানে। সুতরাং সুস্থ নিরাপদ ও দীর্ঘায়ুর লক্ষ্যে জীবনকে জীবন হিসেবে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে স্ট্রিট ফুডের ব্যবহারের উপর তদারকির ব্যবস্থা করা দরকার।
বাংলাদেশে স্ট্রিট ফুড বিক্রেতার সঠিক সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও সংস্থার জরিপ মারফত জানা যায় যে, বাংলাদেশে আনুমানিক ১০-১২ লাখ স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা আছেন। শুধু ঢাকাতাতেই প্রায় ২ লাখের বেশি স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা আছেন। ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ স্ট্রিট ফুড খায়। সারাদেশে ছোট বড় মিলিয়ে আনুমানিক ১০ থেকে ১২ লাখ স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা রয়েছে। রাজধানীতে হকার ও ফুটপাতের দোকানদার মিলিয়ে ৫ থেকে ৬ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এর বড় একটি অংশ স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা। রাজধানীতে স্ট্রিট ফুডের প্রধান কেন্দ্রগুলো হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ, নিউমার্কেট, আজিমপুর, এলিফ্যান্ড রোড, মতিঝিল ও পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, ফকিরাপুল, ধানমন্ডি লেক, সাতমসজিদ রোড, মিরপুর-১, ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ, কমলাপুর, গুলশান, বনানী ও বসুন্ধরা এলাকা। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই স্ট্রিট ফুড রয়েছে। কিন্তু এটার নিয়ন্ত্রণেরও একটা ব্যবস্থা আছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে তারা স্বাস্থ্যবিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। সিঙ্গাপুরে স্ট্রিট ফুড বিক্রেতাদের আলাদা করে ‘হকার সেন্টার’’ বা নির্দিষ্ট জায়গায় দোকান বসাতে হয়।
প্রত্যেক বিক্রেতাকে লাইসেন্স নিতে হয় এবং নিয়মিত নবায়ন করতে হয়। খাবার রান্না ও সংরক্ষণের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক। কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ইনস্পেকশন (পরিদর্শন) করে এবং স্বাস্থবিধি না মানলে জরিমানা বা দোকান বন্ধ করে দেয়। থাউল্যান্ডে স্ট্রিট ফুড খুব জনপ্রিয়। দেশটির সরকার নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সময় অনুযায়ী বিক্রির অনুমতি দেয়। ফুড হাইজিন ট্রেনিং বাধ্যতামূলক। বিক্রেতাদের পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতে হয় এবং হাতমোজা ব্যবহার করতে হয়। ইচ্ছে করলেই যে কোন জায়গায় বসা যায় না। শহরের জন্য আলাদা স্ট্রিট ফুড জোন আছে। মালয়েশিয়াতে স্ট্রিট ফুড ব্যবসা করতে হলে বিক্রেতাদের ফুড হ্যান্ডলিং কোর্স করতে হয়। খাবার প্রস্তুতকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। খাবারের সঙ্গে ব্যবহৃত পানি ও বরফকে নিরাপদ হতে হয়। না হলে জরিমানা করা হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নিয়ম না মানলে দোকান সিলগালা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্রিট ফুড বিক্রির জন্য পারমিট ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। প্রতিটি রাজ্যে আলাদা আলাদা স্বাস্থ্যবিধি আছে- যেমন নিউইয়র্কে (Food Protection Certificate) না থাকলে কেউ খাবার বিক্রি করতে পারে না। নিয়মিত পরিদর্শন হয় এবং খাবার নোংরা পরিবেশে বিক্রি করলে লাইসেন্স বাতিল হয়। আমাদের দেশে এমন নজির স্থাপিত হয়নি বলেই ভেজাল খাবারের ছড়াছড়ি। অথচ খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩ (Food Safety Act, 2013) অনুসারে খাবার প্রস্তুত, সংরক্ষণ ও বিক্রির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুসারে খাদ্যে ভেজাল বা নিম্নমানের খাবার বিক্রি করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়ার অপরাধে ১৪ বছরের কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু ভেজাল খাবার বন্ধ হয়নি। স্ট্রিট ফুড শুধু খাবার নয়, আমাদের সংস্কৃতির একটি প্রাণবন্ত অধ্যায়Ñ রাস্তার কোলাহলে যে খাবার ক্ষুধা মেটায়, সেটিই আবার অনেকের জীবিকার অবলম্বন। তাই এ সংস্কৃতিকে বাদ না দিয়ে সচেতনতার আলোকেই পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। বিক্রেতা যদি দায়িত্ববান হন, ক্রেতা যদি সচেতন হন এবং প্রশাসন যদি আন্তরিকভাবে তদারকি করেনÑ তাহলে মুখরোচক স্ট্রিট ফুডও হতে পারে নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত। আমরা চাই না রসনাতৃপ্তির আনন্দ হোক রোগব্যাধির সূচনা। চাই, রাস্তায় বিক্রি হওয়া প্রতিটি খাবারে থাকুক জীবনের স্বাদ, মৃত্যু নয়। তবেই এই খাবার সত্যিকারের আনন্দের উৎস হতে পারে, ঝুঁকি নয়।