দেশে দারিদ্র্যের হার আবারও বেড়েছে, এটি কোন নিছক পরিসংখ্যান নয়, বরং কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-শিক্ষার সংকটের নগ্ন বাস্তবচিত্র। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠন করা উন্নয়নের প্রধান শর্ত। অথচ আমরা উন্নয়নের সূচক হিসেবে কেবল সড়ক, সেতু কিংবা কিছু অবকাঠামোকে সামনে আনি, দারিদ্র্য বিমোচনকে গুরুত্ব দিই না। ফলে উন্নয়ন চোখে পড়লেও এর সুফল জনগণের ঘরে পৌঁছায় না। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে সাধারণ দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০২৫ সালে তা বেড়ে প্রায় ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে অতিদারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ পরিসংখ্যান শুধু উদ্বেগজনকই নয়, বরং বিগত সময়ে গৃহীত দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলের ব্যর্থতার স্পষ্ট প্রমাণ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দের বড় একটি অংশ প্রকৃত দরিদ্র মানুষের হাতে পৌঁছায় নাÑ ফলে কাগজে-কলমে সহায়তা থাকলেও বাস্তবে তা অকার্যকর হয়ে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে দারিদ্র হার কমিয়ে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে সেখানে ‘‘বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার আবারও বেড়েছে- এ খবরটি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয় ; বরং কোটি মানুষের দুঃখ দুর্দশার প্রতিচ্ছবি।’’
পিপিআরসির গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে প্রতি চারজনের একজন এখন গরিব। বিবিএসের জনশুমারি অনুসারে, ২০২২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। তখন পরিবারের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১০ লাখ। জনসংখ্যার ওই হিসাবটি বিবেচনায় আনলে দেশে এখন কমপক্ষে পৌনে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। তিন বছরে জনসংখ্যাও বেড়েছে। বিগত তিন বছরের ব্যবধানে শহরের পরিবারের মাসিক আয় কমেছে, কিন্তু খরচ বেড়ে গেছে। বর্তমানে শহরের একটি পরিবারের গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা, ব্যয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। অপরদিতে শহরের তুলনায় গ্রামের পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়েছে। গ্রামের একটি পরিবারের গড় আয় এখন ২৯ হাজার ২০৫ টাকা, ব্যয় ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। সার্বিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। আর ব্যয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। অর্থাৎ মানুষের গড় সঞ্চয় মাসে মাত্র ৭০ টাকা। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করে বলেছেনÑ কিছু মানুষ নাক বরাবর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে, সামান্য ঢেউ এলে তারা তলিয়ে যাবে। আসলেই এ দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ দরিদ্র না হলেও দারিদ্রসীমার ওপরে টিকে আছে অস্থির ভঙ্গিতে। সামান্য ধাক্কায় তাদের দরিদ্র হয়ে পড়তে হয়। ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমরা যত দরিদ্র তার চেয়ে বেশি দরিদ্র আয়ের দিক থেকে। প্রতিবছরই দরিদ্রের হার বাড়ছে। তিনি আরও বলেনÑ ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজে চরম দারিদ্র্য থাকতে পারে না। কোনো দেশ এত গরিব হতে পারে না যে তার সব মানুষের জন্য সে অন্তত জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এখন তো আমাদের কোনো অজুহাত দেখালে চলবে না যে, আমরা সবাইকে ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারব না। ফলে এ দারিদ্র্য দূর করা আমাদের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সে সঙ্গে এটিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে এখন থেকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।
দারিদ্র্য বাড়ার পেছনে যতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম মূল্যস্ফীতির প্রভাব। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বেড়ে যায়। কারণ তাদের ব্যয়ের তুলনায় আয় বাড়েনি। অপরদিকে কিছু মানুষ দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ঘুষ বাণিজ্য নতুন কোন বিষয় না। যুগ যুগ ধরে ঘুষ বাণিজ্য চলে আসছে। মানুষ যত দিন পর্যন্ত নৈতিকতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, ঘুষের পরিমাণ কিছুটা হলেও কমেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে পতিত স্বৈরাচার ক্ষমতায় থাকাকীল সময়ে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ ঘুষ দিতে হতো সেখানে এখন ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ ঘুষ দিতে হচ্ছে। কিন্তু ঘুষ বন্ধ হয়নি।
শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নত হতে পারে নাÑ এটা সবাই জানে। কিন্তু শিক্ষার মানউন্নয়নে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ কোন সরকাই গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে বার বার শিক্ষার মান হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার যায়, সরকার আসে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি। শিক্ষার মান না বাড়ার কারণে কর্মদক্ষ জাতি গড়ে উঠছে না, কমংসস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না এবং বেকারত্বের হার কমছে না। অপরদিকে ধনী-গরিবের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। এ বৈষম্য কিছু মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দারিদ্র্যতা অভিশাপ হলেও বিশ্বের কিছু কিছু দেশ দারিদ্র্যতার হার কমিয়ে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেমন : চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। গত চার দশকে চীন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে শিল্পায়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন ও শহরের মধ্যে বৈষম্য কমানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি, রপ্তানি বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ করেছে। এই প্রচেষ্টাগুলো চীনকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সহায়ক ভূমিকা পাল করেছে। অথচ মাও সেতুং এর শাসনামলে, বিশেষ করে তার মৃত্যুর ঠিক আগে এবং পরবর্তী সময়ে চীনের দারিদ্র্যের হার ছিল ব্যাপক।
১৯৭৮ সালের দিকেও চীনের গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতো এবং জীবনযাত্রার মান ১৯৫৮ সালের চেয়েও খারাপ ছিল। এ সময়কালে চীনÑভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়েও বেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। ১৯৭৮ সালের পর চীনের মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয় এবং জনগণের আয় ও কর্মস্থানের নতুন দুয়ার উন্মোচন হয়। ১৯৫০ সালের দিকে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ছিল। অথচ দেশটি বর্তমানে উন্নয়নের মাইফলক হিসেবে বেশ পরিচিত। তারা শিক্ষা বিস্তার থেকে শুরু করে প্রযুক্তির উন্নয়ন, শিল্পায়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে অর্থনীতির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছেন। আর একটি দেশের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সংঘটিত দীর্ঘমেয়াদী সামরিক সংঘাতের নাম ভিয়েতনাম যুদ্ধ। প্রায় ২০ বছর ধরে চলা এ যুদ্ধে ভিয়েতনামের অর্থনীতি তছনছ হয়ে পড়েছিল।
তখন দেশটি দরিদ্রের তকমা পায়। ১৯৮৫ সালের দিকে দেশটির মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২৩১ ডলার যা ২০২৫ সালে এসে দেশটির মাথাপিছু জিডিপির অনুমান করা হচ্ছে প্রায় ৪৮০৬ মার্কিন ডলার। অথচ ১৯৮০ সালের দিকেও দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। ২০২৩ সালের শেষে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগণের হার ছিল মাত্র ২%। এখন সে ভিয়েতনাম বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনীতির দেশেগুলোর একটি। মালয়েশিয়া একসময় দারিদ্র্যের রোল মডেল ছিল। বর্তমানে দেশটিকে উন্নয়নের রোল মডেল বলা হয়। তারা শিল্পায়ন, রাবার, তেল-ইলেক্ট্রনিক ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যতাকে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সিঙ্গাপুর স্বাধীনতার শুরুর দিকে খুবই দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ ছিল। অথচ দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির উন্নয়নের ছোয়ায় তারা আজ উন্নত দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। দারিদ্র্যতা অর্থনৈতিক সমস্যাকে প্রকট করে তোলে। ফলে কেউ আঙ্গুল পুলে কলাগাছ বয়ে যায় আবার কেউ নি:স্ব হয়ে যায়।
দেশ থেকে দারিদ্রতা দূর করতে হলে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার বাড়ানো, বেকারত্ব দূর করা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা, দুর্নীতি বন্ধ করা, ধনী-গরিবের বৈষম্য কমানো, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন-প্রতিরোধ করা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা প্রয়োজন।
সর্বোপরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে না পারলে বিনিয়োগে ভাটা পড়বে। ব্যবসায়িক পরিবেশ ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে পড়বে। সুতরাং আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে, দারিদ্র্য শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়; এটি একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকট। দারিদ্র্যের দায় কেবল এক সরকারের ব্যর্থতায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ঘাটতি, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবের ফসল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা কি চাই আমাদের আগামী প্রজন্মও একই প্রশ্ন করুক! ‘দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি, দায় কার? নাকি আজই আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবো, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব?
লেখক : প্রাবন্ধিক