২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি বরং আওয়ামী লীগের দীর্ঘ অপশাসন ও দুঃশাসনে তা রীতিমত অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। মূলত, আইন ও সাংবিধানিক শাসনের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কদর্য মানসিকতা থেকেই রাজনীতিতে চরমপন্থার অনুপ্রবেশ ঘটে। ইতিহাস পর্যালোচনায় এমন অনেক নজির পাওয়া যায়, যেখানে একনায়ক বা স্বৈরশাসকের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে ব্যাপক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে ঠিক উল্টো। এসব একনায়করা সব সময় দাবি করে এসেছেন তারা যা কিছু করেছেন এসব মানুষের কল্যাণে নিবেদিত।

এক অনিবার্য বাস্তবতায় গত বছর ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লব সাধিত হয়েছিলো। যা জুলাই গণহত্যা এবং পরবর্তীতে তা জুলাই বিপ্লব নামে সারাবিশ্বেই পরিচিতি পেয়েছে। মূলত, এ গণহত্যা ছিল ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমনপীড়ন ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। মূলত, গত বছরের জুন মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করলে জুলাইয়ের শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে জোরদার হয়। ১৫ জুলাই আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর উত্তেজনা বেড়ে যায়। পরবর্তী দিনগুলোতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের সাথে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ফলে অসংখ্য ছাত্র-জনতা নিহত হয়। আগস্টের শুরুর দিকে সহিংসতার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। মূলত, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এ নির্মম গণহত্যা। এ অস্থিরতার সূত্রপাত ঘটে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০% চাকরির কোটা পুনর্বহাল করার মাধ্যমে। এর আগে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এ কোটা সংস্কার করা হয়েছিল।

২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারিকৃত পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। পরবর্তীতে এটি অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। ফলে ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ এবং দেশত্যাগ করেন এবং ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হওয়ার পর, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপি হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদের উপর ব্যাপক নির্যাতন ও ধর-পাকড় চালায়, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন মামলায় সাজা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের নেতৃত্বশূন্য করে ফেলা হয়। এ সময়ে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমে তথ্য প্রচার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর মতো আইনের মাধ্যমে কঠোরভাবে জনসাধারণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

২০১৮ সালে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়, যা ছাত্রদের মধ্যে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে চলমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং শিক্ষার্থীদের চাপে, সরকার ৪৬ বছর ধরে চলা এ কোটাব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেয়। তবে ২০২১ সালে এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ জুন মহামান্য হাইকোর্ট কোটাব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। রায় প্রকাশের পরপরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এ সময়ে আন্দোলন দমাতে পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ফলে সংঘর্ষ ঘটে এবং রংপুরে আবু সাঈদ নামে একজন শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ঘটনাটি আন্দোলনকে আরও জোরালো করে এবং দেশজুড়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এরপর ঢাকাসহ সারাদেশে আন্দোলন সহিংহ হয়ে উঠে ও বিভিন্ন জায়গায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মতো সংগঠনের হামলায় অনেক হতাহত হয়। এ সময় সারাদেশে কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

৪ জুলাই আপিল বিভাগ ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি না করে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপাতত বহাল রাখে। রাষ্ট্রপক্ষকে ‘লিভ টু আপিল’ দায়ের করার কথা বলা হয়। এ সময় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আন্দোলন হচ্ছে হোক। রাজপথে আন্দোলন করে কি হাইকোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন’? পরবর্তীতে ১০ জুলাই আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষ ও দুই শিক্ষার্থীর করা আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহ স্থিতাবস্থা জারির আদেশের পাশাপাশি কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা জারি করে। এ দিন ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়।

১৪ জুলাই হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রপক্ষ ও দু’ শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। ১৮ জুলাই এটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম মামলার শুনানির তারিখ ২১ জুলাই নির্ধারণ করেন। ২১ জুলাই আপিল বিভাগ কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করে। একইসাথে সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয় হলেও সংবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদালত সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধা-ভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার নির্দেশ দেয়।

জুলাই গণহত্যা বলতে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পরিচালিত দমনপীড়ন ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডকে বোঝানো হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে দমনের উদ্দেশ্যে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে এ অভিযান পরিচালনা করে। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়ে কারফিউ জারি করে। এ দমন অভিযানে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে ১৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ছাত্র, আন্দোলনকারী এবং সাধারণ বেসামরিক নাগরিক। পরবর্তীতে বিবিসির একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে একটি যাচাইকৃত অডিও রেকর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি গুলি করার নির্দেশের প্রমাণ প্রকাশিত হয়। সরকারের পতনের পর, অন্তর্বর্তী সরকার এ হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার ঘোষণা দেয় এবং এ মামলায় সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হোন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন, গণগ্রেফতার এবং বহু হতাহতের ঘটনার পর, যা পরবর্তীতে জুলাই গণহত্যা নামে পরিচিতি লাভ করে, আন্দোলনকারীরা আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। সরকারের পক্ষ থেকে নয় দফা দাবি মেনে না নেওয়ায়, ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সমন্বয়কারীরা ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সকল দাবি একত্রিত করে একটি চূড়ান্ত দাবি উত্থাপন করেন। এটি এক দফা দাবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার নিঃশর্ত পদত্যাগ। এ ঘোষণার মাধ্যমে কোটা সংস্কারের আন্দোলন দেশব্যাপী সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির সূচনা হয়। সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না, যা ছাত্র-জনতাকে চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ করে।

এক দফা দাবি আদায়ের চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ প্রথমে ৬ আগস্ট, সারাদেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে নিয়ে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সারাদেশ থেকে মানুষকে রাজধানীতে একত্রিত করে সরকারের ওপর চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করা। তবে দেশজুড়ে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকায় এবং আন্দোলন তীব্রতর হওয়ায়, ৪ আগস্ট রাতে এক জরুরি সিদ্ধান্তে এ কর্মসূচি এগিয়ে এনে সোমবার, ৫ আগস্ট পালনের আহ্বান জানানো হয়। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখো মানুষ সকল বাধা উপেক্ষা করে রাজধানীর কেন্দ্রস্থল, বিশেষ করে গণভবন অভিমুখে রওনা দেয়। এ গণজোয়ারই শেখ হাসিনা সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে এবং ঐ দিনই তার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

এর আগে ২২ জুলাই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন দু’দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ ইন্টারনেট সংযোগ চালুর দাবি জানায়। পরের দিন ২৩ জুলাই, তদানীন্তন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান যে, সরকার ইন্টারনেট সংযোগে বিঘ্ন ঘটার পর তা আংশিকভাবে আবার চালু করবে ব্যাংক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রপ্তানি খাত ও নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়। সে অনুযায়ী, ২৪ জুলাই, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা হয় এবং ২৮ জুলাই, মোবাইল ইন্টারনেট চালু করা হয়। যদিও ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলি তখনও ব্লক করা ছিল। ৩১ জুলাই ১৩ দিন বন্ধ থাকার পর, বিকেল ৩টায়, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি আবার চালু করা হয়। ২ আগস্ট আবারও অস্থিরতা শুরু হওয়ায়, ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রাম বন্ধ করে দেয়। পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর ফেসবুক ও মেসেঞ্জার আবার চালু করা হয়, তবে টেলিগ্রাম তখনো বন্ধ থাকে। ৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল। এদিন প্রায় ৯১ জন মারা যান। ফলে সরকার আবারও সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর দ্বিতীয় দিনে ইন্টারনেট পুনরায় চালু হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ আগস্ট দুপুর ১টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হয় এবং দুপুর ২টার পর মোবাইল ইন্টারনেট ফিরে আসে। তবে, সামাজিক মাধ্যমে প্রবেশাধিকার তখনও সীমিত ছিল।

অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে জুলাই বিপ্লব সাধিত হয়। আর এর প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয় দীর্ঘদিনের আওয়ামী-বাকশালী শাসনে পঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে। ফলে একটি সফল বিপ্লব রীতিমত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বিপ্লবোত্তর গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ গেজেটে সারাদেশের ৮৩৪ জন শহীদের নাম উঠে আসে। ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ এ গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। গেজেটে মেডিকেল কেইস আইডি, নাম, বাবার নাম, বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছিল গত ২১ ডিসেম্বর। সেখানে ৮৫৮ জন শহীদের নামের পাশাপাশি আহতদের তালিকায় ১১ হাজার ৫৫১ জনের নাম ছিল।

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে সরাসরি রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি দৃশ্যমান না হলেও, আন্দোলনের সফলতার পর বিভিন্ন দল এ ঘটনার কৃতিত্ব দাবি করে। মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণ থাকলেও, আন্দোলনের সময় তাদের দলীয় পরিচয় সামনে আসেনি। শিক্ষার্থীরা একে দলনিরপেক্ষ গণআন্দোলন হিসেবেই দেখেছেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সে সময় আওয়ামী লীগ সরকার অভিযোগ তোলে যে তারা আন্দোলনে সহিংসতা ছড়িয়েছে। তবে বিএনপি আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে ‘নৈতিক সমর্থনের’ কথা বলে। জামায়াতও প্রাথমিকভাবে একাত্মতা জানালেও, পরে তাদের সংগঠিত সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, তারা সচেতনভাবে নিজ সংগঠনের নাম গোপন রেখে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে যাতে তা সার্বজনীন রূপ পায়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেন, তারা মাঠে উপস্থিত ছিলেন, যদিও দলীয়ভাবে নয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দাবি করেন, আন্দোলনের সঙ্গে দলগুলোর কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল না, তবে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ব্যক্তি উদ্যোগে অংশ নিয়েছেন। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এ বিপ্লব থেকে আওয়ামী বিরোধী কোন রাজনৈতিক শক্তিই বিচ্ছিন্ন ছিলো না। আর এ প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ অপশাসন-দুঃশাসনের কারণে। এক নির্মম বাস্তবতায় তা প্রাসঙ্গিকও হয়ে উঠেছিলো।

মূলত, আওয়ামী ফ্যাসীবাদীরা ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবকে নস্যাৎ করার জন্য ব্যাপক দলন-পীড়ন ও গণহত্যার আশ্রয় নিয়েছিলো। যা ছিলো রীতিমত মানবতাবিরোধী অপরাধ। আর বিশ্ব ইতিহাসে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিষয়টি অভিনব না হলেও আগস্ট বিপ্লবকেন্দ্রিক গণহত্যা ইতিহাসে নজীরবিহীন বলতেই হবে। কারণ, এ গণহত্যা চালানো হয়েছিলো এক ব্যক্তিকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে রাখার জন্য। শুধু তাই নয় বরং ফ্যাসিবাদী শাসনকে পাকাপোক্ত ও চিরস্থায়ী করার জন্য সারাদেশেই ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটানো হয়েছিলো। হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম ও গুপ্তহত্যা ছিলো নিত্যদিনের। আর ‘আয়না ঘর’-এর নির্যাতন তো ইতিহাসের সকল নির্মমতাকে হার মানিয়েছিলো। তাই এসব অপরাধীর নুরেমবার্গের আদলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত। অন্যথায় সভ্যতার ইতিহাস কোনভাবেই কলঙ্কমুক্ত হবে না।

[email protected]