একটি সমাজের পরিচয় তার সংস্কৃতির ভেতরেই লুকিয়ে থাকে। সংস্কৃতিই বলে দেয় সমাজ কতটা উন্নত, সভ্য, আধুনিক ও মানবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে এখন সংস্কৃতির নামে চলছে বাহ্যিক চাকচিক্যের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কেবল উৎসব, নাচ, গান বা বিনোদনকে সংস্কৃতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। অথচ সংস্কৃতি বলতে বোঝায় মানুষের জীবযাত্রা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আচরণ ও মানবিকতার সম্মিলিত প্রতিফলন। আজ আমরা এমন এক সময় পার করছি, যখন বিদেশী সংস্কৃতির ঢেউ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে। আধুনিকতার নামে অন্ধ অনুকরণ আমাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছে। পোশাক থেকে শুরু করে আচার-আচরণ পর্যন্ত আমরা ভুলে যাচ্ছি। অথচ মনে রাখা দরকার- একটি উন্নত সমাজ কখনোই নিজের সংস্কৃতি বিসর্জন দেয় না; বরং ইতিবাচক সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে। সমাজ হলো মানুষের সম্মিলিত জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি। আমরা যেমনভাবে চলি, ভাবি ও মূল্যবোধ ধারণ করি, তাই সমাজের সংস্কৃতি হয়ে ওঠে। যদি মানুষ মানবিক, সহানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল হয় তবেই একটি সমাজ মানবিক হয়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতায় আমরা দেখি, আমাদের সমাজ এখনও মানবিকতার দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘটছে অমানবিক ঘটনা। একেকটি ঘটনা আগেরটিকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। ধনী-গরিব, উচ্চবিত্ত- নিম্নবিত্ত বিভাজন সমাজের ঐক্যকে দুর্বল করছে। পরিবারে, প্রতিবেশি, এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আমরা বিভাজনের চিত্র দেখি। এর পেছনে কাজ করছে ভুল সংস্কৃতি, অর্থকেন্দ্রিক জীবনযাপন ও মানবিক মূল্যবোধের সংকট।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি ভয়াবহ সমস্যা। আইন থাকা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ থামানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএপির ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- দেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই হয়ে যায়। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি এক হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন মা হয়ে যায়। এ তথ্য ভয়ংকর বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অথচ বাংলাদেশ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েকে বা ২১ বছরের কম বয়সী ছেলেকে বিয়ে দেয়া সহায়তা করা বা উসকানি দেয়া অপরাধ। এ অপরাধে দু’বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড কিংবা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আইন থাকা সত্ত্বেও কেন বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না? এর কারণ সামাজিক মানসিকতা। এখনও সমাজের একটি অংশ মনে করে মেয়েদের বিয়ে মানেই দায়মোচন।

অনেক অভিভাবক মনে করেন- মেয়ে যত তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে, তত ভালো। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও কুসংসকার। বাল্য বিবাহ নিয়ে নিবন্ধ লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়! আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন নারী যখন বিবাহ জীবনে আবদ্ধ হন তখন তার জীবনে কালবৈশাখীর ঝড় নেমে আসে, সে বিষয়টি তুলে ধরা। নারীকে মায়ের জাত বলা হয়। ইসলাম নারীকে সবচেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছে। তারপরও কোন ঘরে পর পর তিনটি মেয়ে হলে তাকে সমাজের একশ্রেণীর নির্বোধ লোকেরা হেয়প্রতিপন্ন করে, টিটকারি করে। এমনকি বার বার মেয়ে হওয়ার কারণে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক পর্যন্ত দিতে কুন্ঠাবোধ করে না। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা আশ শূরা এর ৪৯-৫০ নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন- তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে ইচ্চা পুত্র সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাবান। আল্লাহ তায়ালার এ সিদ্ধান্ত মানা প্রতিটি মুসলীম নর-নারীর জন্য ফরয। অথচ এ ব্যাপারে অনেকে গাফেল।

প্রতিনিয়ত সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে। বিশেষ করে বিয়ে, জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী-সবকিছু এখন এক ধরনের প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। কে কত বড় আয়োজন করবে, কে কত খরচ করবে- এটাই সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। এর ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর চাপ বাড়ছে। প্রদর্শনী সংস্কৃতির কারণে মানুষ হীনমন্যতায় ভুগছে, আর সমাজে অর্থের ভিত্তিতে মর্যাদা নির্ধারণের সংস্কৃতি শক্তিশালী হচ্ছে। সামাজিক অনুষ্ঠানের আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল মিলনমেলা, প্রতিযোগিতা নয়। আজকের সমাজে আমরা যে অসংগতিগুলো লক্ষ্য করি সেগুলো কেবল ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজকেই গ্রাস করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রগাঢ় প্রভাব আমরা দেখি মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে উপকোটন ও আর্থিক দাবি, নারী বৈষম্য, সামাজিক প্রদর্শনী, বাল্যবিয়ে, কুসংস্কার, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অসংগতি। তাছাড়া একটি প্রচলিত অসংগতি হলো মেয়ের বিয়েতে উপকোটন বা বড় ধরনের আর্থিক ব্যয়। পরিবার মেয়ের বিয়েতে সোনা, গহনা বা নগদ অর্থ দাবি করে। এতে মেয়ের পরিবার আর্থিকভাবে নিগৃহীত হয় এবং সমাজের অর্থের ভিত্তিতে মর্যাদা নির্ধারণের সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়। এমন প্রথা মেয়ের মর্যাদা ও স্বাধীনতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মেয়েদের বিয়ের পর সমাজে যে অসংগতি ও নির্যাতন ঘটে, তা এক ধরনের লুকানো বাস্তব। পরিবার, সম্প্রদায় এবং সমাজের প্রচলিত প্রথার কারণে অনেক মেয়েই শ্বশুরবাড়িতে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে। এ সমস্যা শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক কাঠামোরই একটি অংশ। একজন পিতা-মাতা কত কষ্ট করে মেয়েকে লালন পালন করে থাকেন তা একমাত্র মেয়ের পিতারাই অনুধাবন করতে পারেন। মেয়ের যখন বিয়ের বয়স হয় তখন অভিভাবকেরা মহা দুশ্চিন্তায় পড়েন। কারণ যৌতুক দেয়া ও নেয়া অপরাধ জানা সত্ত্বেও কিছু বরের পিতা ভিন্ন কায়দায় কৌশলে মেয়ের বাপের কাছ থেকে ফার্নিচারের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। হাসিমুখে বলেন ছেলে তো আপনাদেরই। ছেলের ভবিষ্যতের জন্য যা যা করা দরকার এখন আপনি তা-ই করেন। আমাদের পরিবারকে কিছু দিতে হবে না।

শুধু ১০০ থেকে ২০০ মেহমান খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেই চলবে। মেয়ের বাবা বাধ্য হয়ে শ্বশুড়বাড়ির প্রস্তাব মেয়ে নেয়। এখানেই শেষ নয়! মেয়ের পিতা যখন কাবিনের টাকা বেশি দেয়ার প্রস্তাব করেন তখন ছেলের বাবা বলেন- আমার ছেলে এত টাকা কাবিন দিতে পারবে না। তার কামাই কত? প্রয়োজন হলে বিয়ে হবে না। এসব বলে মেয়ের বাবাকে কম টাকায় বিয়ের কাবিন করতে বাধ্য করেন। বাধ্য হয়ে মেয়ের বাবা বিয়ের কাজ সারেন। আর চোখের পানি ফেলেন। কলিজারটুকরা মেয়ে যখন শ্বশুড় বাড়িতে যায় তখন বাবাদের ঘুম হয় না। খাওয়া দাওয়া ঠিকমত হয় না। মেয়ে শ্বশুড় বাড়ি থেকে বাড়িতে আসলে বাবারা জিজ্ঞেস করেন মা তোর শ্বশুড় শাশুড়ি, দেবর ও ননদরা কেমন? মেয়ে হাসি দিয়ে বলেন বাবা সবাই খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু দিন কয়েক যাওয়ার পর সামাজিক রেওয়াজ রাখতে গিয়ে বহু পরিবারের চোখের জলে বুক ভাসায়। মেয়ে বিয়ে দেয়া হলে সব দায়িত্ব শুধু মেয়ের বাবাদের কাঁধে পড়ে, ছেলে পক্ষের উপর কোন দায় পড়ে না। যেমন: মেয়ের বাবার দায়িত্ব হচ্ছে প্রতি ঈদে ছেলেকে ঈদ সেলামি দিতে হবে, শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে কাপড় দিতে হবে। রোজার সময় ইফতারি পাঠাইতে হবে। কুরবানির ঈদের সময় গরুর রান পাঠাতে হবে। এগুলো দিতে না পারলে স্ত্রীর উপর নিপীড়নের স্টীম রোলার প্রয়োগ করা হয়। শুধু কি তাই! তরকারিতে লবণ কম-বেশি হলে বকা খেতে হয়। কোনদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হলে শ্বশুড়-শাশুড়ির কপালে ভাজ পড়ে। অথচ পুত্রবধূ হওয়া মেয়েটির মতো একই বয়সের তার একটি মেয়ে সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘুমায় তাতে কোন সমস্যা হয় না।

শ্বশুড়বাড়ির অনেক মেয়ের ওপর অতিরিক্ত বাড়ির কাজের চাপ চাপানো হয়- রান্না, ধোয়া, শিশু যত্ন, শ্বশুড় শাশুড়ির সেবা ইত্যাদি। অন্য সদস্যদের তুলনায় মেয়ের উপর দায়িত্ব বেশি এবং এ কাজগুলো প্রায়শই নির্লজ্জভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়। তারা ছোটখাটো ক্রটি বা পারিবারিক বিষয়ে অভিযোগের মাধ্যমে মেয়ের আত্মসম্মানহানি করে। মেয়েকে সামাজিকভাবে অপমানিত করা, তার মতামত উপেক্ষা করা বা পরিবারের কাজে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া ও নির্যাতনের অংশ। এ ধরনের আচরণ মেয়েকে মানসিকভাবে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। সারা ভুলেই যায়- বিবাহ সামাজিক মিলনের উৎস, আর্থিক প্রতিযোগিতা নয়। এসব অপসংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আমরা ডিগ্রিধারী মানুষ তৈরি করতে পারছি, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ গড়ে তুলতে পারছি না। ফলে সামাজিক মূল্যবোধের সংকট দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। পরস্পরের প্রতি সম্মান, সহমর্মিতা, শিষ্টাচার-এসব গুণ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সমাজ ও সংস্কৃতি একে অপরের প্রতিচ্ছবি। ভুল সংস্কৃতি মানে ভুল সমাজ। তাই এখনই প্রয়োজন সামাজিক সংস্কৃতির ভুলগুলো চিহ্নিত করে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া। অন্যথায় আমরা ক্রমেই অমানবিকতার অন্ধকারে ডুবে যাব।

লেখক : প্রাবন্ধিক।