মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত

দীর্ঘ ১৬ বছর পর সরকার আবারও ’প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা’ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। গত ১৭-জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে জরুরি নির্দেশনা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুখের বিষয় হলো-নির্দেশনায় হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন, এনজিও পরিচালিত স্কুল, এবতেদায়ী মাদরাসাসহ অন্যান্য বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের এ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়নি। নির্দেশনায় বলা হয়েছে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় এবং সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় কেবল এই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। প্রশ্ন হলো এ তিন শ্রেণির বিদ্যালয় ব্যতীত দেশে যে আরও হাজার-হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে লক্ষ-লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করছে তাদের কী অপরাধ বা তাদের অযোগ্যতাই বা কী? এমনিতেই দেশে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ১০/১১ ধরনের স্কুল এবং প্রায় ৫/৬ ধরনের কারিকুলাম মিলে বৈষম্যমূলক এক হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে যুগ-যুগ ধরে। তার উপর সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রায় ৪০ হাজারের অধিক কিন্ডারগার্টেন এবং আরও প্রায় ৮/১০ হাজার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লক্ষ-লক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে চরম বৈষম্যের নামান্তর। দেশের একজন সচেতন নাগরিক এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে এ বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। এটি একটি বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত যা রাষ্ট্রের শিক্ষানীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকার একদিকে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলবে অপরদিকে সরকারি আর বেসরকারি স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বৈষম্যের একটি দেয়াল তুলে দিবে তা তো যুক্তিসঙ্গত নয়। শিক্ষা মানুষের জন্মগত ও মৌলিক অধিকার। সবার জন্য শিক্ষার সমান অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকার যদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেশের সকল শিশুদের উপযুক্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে পারত তাহলে তো আর এত কেজি স্কুল বা এত ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত না। সরকার সবার জন্য উপযুক্ত এবং সমান শিক্ষার সুযোগ করে দিতে পারছে না বলেই গড়ে উঠছে হাজার হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের পাশাপাশি দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার কাজে ব্যাপক অবদান রেখে যাচ্ছে যা অস্বীকার করার উপায় নেই।

জাতি গঠনের মূল ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষা। আর শিক্ষার প্রথম এবং প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক স্তর। সরকার শিক্ষার এ প্রাথমিক ও মূল জায়গায় সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিদার ব্যবস্থা না করে বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে বিভাজনের দেয়াল সৃষ্টি করে দিচ্ছে যা ভবিষ্যতে সামাজিক বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করবে। সরকার নিজেদের ব্যর্থতা কিংবা অপারগতাকে ঢাকতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে। যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের কারণে বঞ্চিত করা হচ্ছে বৃত্তি পরীক্ষা কিংবা এরকম আরও নানান সুযোগ-সুবিদা থেকে। এমনিতে দেশের হাজার-হাজার কেজি স্কুলের শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকদের কোন ধরনের সুযোগ-সুবিদা দেয় না সরকার। তারপরও এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠ দিয়ে যাচ্ছে হাজারো শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং আমাদের সন্তানদের শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি মজবুত করতে এবং সুশৃংঙ্খল জীবন গঠনে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে সহযোগীতা না করে বরং অবহেলা আর বৈষম্যমূলক আচরণ করে রাষ্ট্রীয় হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে একজন শিক্ষার্থীর পরিচয় হওয়া উচিত কেবলমাত্র শিক্ষার্থী হিসেবে। সরকারি, বেসরকারি, ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম বা অন্য কোন পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের ট্রিট করা মৌলিক অধিকার পরিপন্থি। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শুধুমাত্র সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষা নিলে বা তাদের মানোন্নয়ন করলেই কী হয়ে যাবে? শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়নের জন্য দেশের সকল শিক্ষার্থীদের প্রতি মনযোগী হতে হবে এবং যথাসম্ভব সমান সুযোগ-সুবিদা নিশ্চিত করতে হবে। কাউকে গ্রহণ করবেন কাউকে বাদ দিবেন এ প্রবনতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে নীতি নির্ধারকদের। কেজিতে পড়ুয়া লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের বাদ দিয়ে প্রাথমিকের এই বৃত্তি পরীক্ষা সত্যিই প্রশ্নবোধক হয়ে দেখা দিবে এবং এসব ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে তাতে সন্দেহ নেই। তাই বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারের নিকট আবেদন থাকবে বৈষম্যতার দৃষ্টিকোণে নয় বরং সাম্যতা আর সমাধিকারের আলোকে যোগ্যতার ভিত্তিতে সকল প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে কোমলমতি শিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে সরে আসুন এবং শিক্ষার্থীদের জন্মগত মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করুন।

লেখক : প্রবাসী প্রাবন্ধিক।