॥ এস এম হাসানুজ্জামান ॥

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর। মানুষ আজ নিরাপত্তাহীনতার এক অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছে। সরকার ও প্রশাসন চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না বললেও বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অপরাধ যেন দিনদিন আরও ভয়ংকরভাবে বিস্তৃত হয়ে পড়ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর (জানুয়ারি-আগস্ট) এ আট মাসে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি হত্যা, দস্যুতার ঘটনায় চার হাজার ৩১৬টি মামলা হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে ৫৪০টি মামলা হয়েছে। মোট মামলার মধ্যে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা এক হাজার ৭০২টি এবং দু’হাজার ৬১৪টি খুনের মামলা। এর আগের বছর ২০২৪ সালে ১২ মাসে ডাকাতি-দস্যুতা ও হত্যার ঘটনায় মোট পাঁচ হাজার ৩৩৪টি মামলা হয়েছে। সে বছর প্রতিমাসে গড়ে মামলা হয়েছে ৪৪৫টি। এর মধ্যে ডাকাতি-দস্যুতায় এক হাজার ৯০২টি ও খুনের মামলা তিন হাজার ৪৩২টি। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে ডাকাতি-দস্যুতা ও খুনের ঘটনায় ৯৫টি বেশি মামলা হয়েছে। এর আগের বছর ২০২৩ সালের সঙ্গে তুলনা করলে চলতি বছরের প্রতি মাসে গড়ে ১৬০টি মামলা বেড়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন পুলিশ পরিসংখ্যানে কখনো এসব ঘটনার প্রকৃত তথ্য উঠে আসে না, বাস্তবে এসব অপরাধ আরো বেশি ঘটছে বলে মনে করছেন তারা।

এর আগের বছরে সারাদেশে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে এক হাজার ৬১৯টি। এই সময় মাসে গড়ে মামলা হয়েছে ১৩৫টি। পুলিশ সদর দপ্তরের এ হিসাবে আগের বছরের চেয়ে পরের বছরে ৮৩৮টি মামলা বেশি হয়েছে। এ সময় মাসে ৭০টি মামলা বেশি হয়েছে।

আবার পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধবিষয়ক মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৩ মাসে সারা দেশে সাত ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় ৩৯ হাজার ৯৩৬টি মামলা হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি মাসে মামলা তিন হাজার ৭২টি। প্রতিদিন মামলা ১০২টি।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, হয়তো এবার পরিস্থিতি বদলাবে। মানুষ নিরাপত্তা পাবে, চাঁদাবাজরা ধরা পড়বে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু সে আশাগুলো এখন ভেঙে গেছে। অপরাধ আরও বেড়েছে, চাঁদাবাজি আরও বেপরোয়া হয়েছে, মানুষের ভয় আরও গভীর হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা, পুলিশের মনোবলে ঘাটতি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, দেশের বর্তমান অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে মূলত তিনটি বড় কারণ কাজ করছেÑবেকারত্ব, মাদকাসক্তি ও সামাজিক বৈষম্য। যখন একজন যুবক শিক্ষিত হয়েও কাজের সুযোগ পায় না, তখন সে সহজেই অপরাধের পথে ঝুঁকে পড়ে। অন্যদিকে মাদক আজ শুধু তরুণ সমাজ নয়, পুলিশ, রাজনীতি, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আর সামাজিক বৈষম্য এমনভাবে বেড়েছে যে, ধনী ও গরিবের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ বৈষম্যই অপরাধের অন্যতম প্ররোচক হিসেবে কাজ করছে।

এদিকে চাঁদাবাজির ভয়াবহতা এখন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। দেশের ৬৪ জেলায় প্রকাশ্যে ও নীরবে চলছে চাঁদাবাজি। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাজার, বন্দর, পরিবহন খাতÑসবখানেই চাঁদার দাপট। একটি ট্রাক নওগাঁ থেকে ঢাকায় আসার পথে একাধিক পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়। ব্যবসায়ী, দোকানদার, এমনকি সাধারণ পথচারী পর্যন্ত চাঁদাবাজদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি খুন করা হচ্ছে। সম্প্রতি পুলিশ চাঁদাবাজদের হামলায় গুরুতর আহত হন। এ হামলাকারীরা লাঠি, রড ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। ঘটনাটি প্রমাণ করে, অপরাধীরা এখন এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তারা আইনরক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতিও কোনো সম্মান দেখাচ্ছে না। পুলিশের ওপর হামলা মানে রাষ্ট্রের ওপর হামলা, অথচ এই বার্তা যেন এখন কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না।

এদিকে রাজধানী ঢাকাতেও নতুন ধরণের চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে সংগঠিত মব চক্র বিভিন্ন জায়গায় ভয়ভীতি সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় করছে। সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আসাদুর রহমান আকাশ নামের এক ব্যক্তি এ চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা শুধু চাঁদা আদায়ই করছিলেন না, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের রাজনৈতিক বা ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন। মিথ্যা মামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, এমনকি সাংবাদিকদের ওপর হামলাÑসবকিছুই ছিল তাদের কর্মকা-ের অংশ। অপরাধ বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। দেশে অপরাধীরা ধরা পড়লেও তাদের অনেকেই রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ বা দুর্বল তদন্তের কারণে আবার মুক্তি পেয়ে যায়। ফলে তারা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ দেখে, অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে নাÑতখন সমাজে এক ধরনের নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে পড়ে যে, অপরাধ করলেও পার পাওয়া যায়। এই অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।

এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসে খালবিল, ঝোপঝাড় থেকে ৫২ জন অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যার শিকার হয়েছে ৮৩ নারী, যা আগের মাসের চেয়ে আটজন বেশি। গত মাসে ৫৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

এ কথাটি আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ, সমাজ যখন অপরাধকে সহনীয় মনে করতে শুরু করে, তখনই সেটি ভয়াবহ রূপ নেয়। আজ দেশের গ্রাম-শহর সবখানেই মানুষ ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। রাস্তার পাশে দোকান খোলার আগে ব্যবসায়ীকে ভাবতে হচ্ছে, কখন কে এসে চাঁদা চাইবে। ট্রাকচালক ভাবছে, পথে কত জায়গায় টাকা দিতে হবে। শিক্ষক ভাবছেন, স্কুলে নিরাপত্তা আছে তো? মা ভাবছেন, তার মেয়ে নিরাপদে স্কুলে ফিরতে পারবে কি না। এ ভয়ই এখন পুরো জাতিকে পেয়ে বসেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি। শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, সামাজিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমÑসবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সমাজে মানবিকতা, সততা ও নৈতিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা ছাড়া অপরাধ কমানো সম্ভব নয়। তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, মাদকের সরবরাহ বন্ধ করা, এবং বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাই হতে পারে অপরাধ দমনের মূল পথ।

বিচার নিশ্চিত না হলে অপরাধীরা কখনো ভয় পাবে না। আর ভয় না থাকলে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাই অপরাধ দমন মানে শুধু অপরাধীকে গ্রেপ্তার নয়; বরং তাকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তি দেওয়া, এবং সেই শাস্তি জনগণের সামনে দৃশ্যমান করা।

দেশে এখন সবচেয়ে বড় সংকট হলোÑমানুষের মনে আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে যাওয়া। মানুষ বিশ্বাস করে না যে, তার অভিযোগ শুনবে কেউ, বিচার পাবে সে। এই আস্থাহীনতা দূর করতে হলে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। আজ অপরাধ, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, রাজনৈতিক সহিংসতাÑসবকিছু মিলে সমাজ যেন অস্থিরতার এক অন্ধকারে ঢেকে গেছে। এই অন্ধকার থেকে বের হতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সামাজিক ঐক্য। যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে অপরাধ শুধু সমাজ নয়, রাষ্ট্রের কাঠামোকেও দুর্বল করে ফেলবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে নাগরিকের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে, আর মানুষ হারাবে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-নিরাপত্তার বিশ্বাস। অপরাধ দমন কেবল পুলিশের কাজ নয়, এটি একটি জাতির সম্মিলিত দায়িত্ব। রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিক-সবারই ভূমিকা রয়েছে। যদি আমরা সবাই মিলে অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, চাঁদাবাজদের প্রতিরোধ করি, ন্যায়ের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনি-তাহলেই এ অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা সম্ভব হবে।

দেশকে নিরাপদ করতে হলে আজই শুরু করতে হবে সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। নইলে অপরাধের এই অন্ধকার ছায়া একদিন পুরো জাতির ভবিষ্যৎকে গ্রাস করে ফেলবে। অপরাধের এ অন্ধকার যদি আজই রোধ করা না যায়, তাহলে আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া হবে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার সমাজ। আজকের শিশুরা বড় হবে ভয় নিয়ে, তরুণরা হারাবে স্বপ্ন দেখার সাহস, আর সাধারণ মানুষ হারাবে ন্যায়ের প্রতি আস্থা। তখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকবে কেবল কাগজে-কলমে, কিন্তু বাস্তবে ভেঙে পড়বে এর নৈতিক ভিত।

চাঁদাবাজি ও অপরাধ দমন করতে হলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন দ্রুত বিচার ও দৃশ্যমান শাস্তি। অপরাধীরা যদি দেখে যে আইনের হাতে ধরা পড়লে রেহাই নেই, তাহলে তারা ভয় পাবে। কিন্তু যখন তারা দেখে যে অর্থ, প্রভাব কিংবা রাজনীতি দিয়ে আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে আসা যায়, তখন অপরাধকে তারা পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। তাই বিচারপ্রক্রিয়াকে শক্তিশালী ও স্বচ্ছ করতে হবে।

একই সঙ্গে দরকার সমাজের ভেতরে নতুন সচেতনতা সৃষ্টি করা। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনÑসব জায়গায় মানুষকে বুঝাতে হবে যে, অপরাধ কোনো সমাধান নয়, বরং এটি নিজের ও সমাজের ধ্বংস ডেকে আনে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে, তরুণদের হাতে দিতে হবে সৃজনশীল বিকল্প, যেন তারা অপরাধের পথে না যায়। সবশেষে একটি কথাই স্পষ্ট-অপরাধ ও চাঁদাবাজি দমন শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব নয়, এটি পুরো জাতির দায়িত্ব। সরকার, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষ সবাই যদি সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসে, তাহলে এখনো আশা আছে। আইন যদি সত্যিকারের শাসন প্রতিষ্ঠা করে, ন্যায় যদি ফিরে আসে, তাহলে বাংলাদেশ আবার নিরাপদ, ন্যায়ের পথে চলা এক শান্ত সমাজে পরিণত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে-অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মানে শুধু অপরাধীকে দমন নয়; বরং ন্যায়, মানবতা ও দায়িত্ববোধকে জাগিয়ে তোলা। আজ যদি আমরা সবাই মিলে সেই সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তাহলে এই অন্ধকার একদিন কেটে যাবে, আর বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আবার বলতে পারবে-‘আমরা নিরাপদ’।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।