মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। তবে সবাই একই হাসপাতালে যান না। কেউ সরকারিতে, কেউ যান বেসরকারিতে। যাদের অঢেল অর্থবিত্ত আছে তারা সামান্য জ¦র বা কাশি হলে বেসরকারি হাসপাতালের কেবিনে ওঠে। আর যাদের অর্থ-কড়ি নেই তাদের ঠিকানা হয় সরকারি হাসপাতাল। অথচ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। দেশের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। রাজধানী ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা পিজি হাসপাতালে সকালে ভিজিট করলে দেখা যাবে, বহির্বিভাগের টিকেট কাউন্টারের সামনে লম্বা সিরিয়াল। কখন সিরিয়াল আসবে সে চিন্তায় রোগী আর রোগীর স্বজনেরা তালগাছের মত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই সিরিয়াল অনুসারে চিকিৎসকের দেখাও পায় না। তার অন্যতম কারণ জনবল সংকট ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব। যারা খুবই অসুস্থ দাঁড়াতে পারেন না তারা পড়েন মহাবিপদে। কখনও দাঁড়ান, কখনও বসেন। তবু একটু সহানুভূতি পান না। হুইল চেয়ার ও ট্রলি চাইলেও পাওয়া যায় না। যদিও এগুলো রোগীদের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে। অবস্থাটা এমন দাঁড়ায়, যার টাকা আছে, তার চেয়ার আছে, যার টাকা নেই, তার কোন সিরিয়াল কিংবা সিট ও নেই। অথচ দালাল চক্রের সীমাহীন উৎপাতে রোগীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। ভর্তি থেকে শুরু করে বেড, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবকিছুতেই দালালের হাতের পরশ। বকশিস ছাড়া হুইল চেয়ার-ট্রলি কিছুই নড়ে না। ট্রলি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেয়। ছুটির দিন আর রাতের বেলায় হলে তো বিপদের শেষ নেই। দালালদের নিপীড়নের শিকার হতে হয়।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হলেও চিকিৎসা সেবার মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। ফ্যাসিস্ট বিতাড়িত হওয়ার পর অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের স্বাস্থ্য সেবাকে জনমুখী, সহজলভ্য ও সার্বজনীন করার প্রয়াসে গত ১৮ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে ‘‘স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন’’ গঠন করেছেন। দ্রুত এ কমিশন স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি অনিয়ম বিতাড়িত করবে, এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা। চিকিৎসা সেবা কোন মুনাফা কিংবা ব্যবসা নয়। এটা নিরেট জনসেবা। কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসা সেবাকে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিকিকরণ করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে বহু মানুষ নিজের জায়গা-জমি, ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে, সঞ্চয় ভেঙ্গে, ঋণ করে চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ফতুর হচ্ছে। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ওষুধ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় টেস্টগুলো মানুষ করাতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেটের মতো চিকিৎসাখাতেও সিন্ডিকেটের থাবা বিরাজমান। ফলে কখনো কখনো রোগীদের ৫০০ এমএল ব্যাগের স্যালাইন ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় ক্রয় করার খবর পত্রিকায় পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় কম হওয়ার রোগীরা সরকারি হাসপাতালমুখী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচের প্রায় ৯৫ ভাগ ব্যয় সরকার বহন করে। ফলে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে ১০ টাকা এবং ভর্তি হতে ১৫ টাকা খরচ হয়। রোগীদের থাকার জন্য ৭০ শতাংশ বেড বিনামূল্যে এবং ৩০ শতাংশ নামমাত্র মূল্যে পাওয়া যায়। বিনামূল্যে ভর্তি রোগীদের খাবারও দেয়া হয়। যা অন্যান্য হাসপাতালে ভাবাই যায় না। কমমূল্যে চিকিৎসা হওয়ার কারণে অধিকাংশ মানুষ গ্রাম থেকে রাজধানীর নামি-দামি সরকারি হাসপাতালগুলোতে ছুটে আসেন সুস্থ হওয়ার প্রত্যাশায়। কিন্ত অনেক সময় সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালের নোংরা পরিবেশ ও অব্যবস্থাপনার কারণে। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় রোগী অনেক বেশি। এটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু একটু কঠোর নিয়মনীতি আর দুর্নীতি বন্ধ হলে অল্প সংখ্যক জনবল দিয়েও বহু মানুষের জীবনে আলো ফুটানো সম্ভব। একটু সদিচ্ছা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। সরকারি হাসপাতালে অনেকগুলো সমস্যার ভেতর অন্যতম হচ্ছে দালাল। দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে বহু মানুষের ভাগ্যে সঠিক চিকিৎসা জুটে না। অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। দালাল চক্র চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের, রোগীদের স্বজনদের বিভিন্ন ধরনের কথা বলে, ফুসলিয়ে অন্য মানহীন, অনুমোদনহীন বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে যারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশ মানুষ ভুল চিকিৎসা অথবা অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। দালালরা মূলত কমিশন বাণিজ্যের বিনিময়ে কাজ করেন। একজন রোগী যখন চিকিৎসকের রুম থেকে বের হন তখন থেকেই তারা ওৎ পেতে থাকেন এবং পিছু নিতে শুরু করেন। কৌশলে রোগীদের ব্যবস্থাপত্র হাত থেকে নিয়ে নেন এবং জিম্মি করে রাখেন, বাধ্য করেন তাদের সঙ্গে বাইরের বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে যেতে। যদি কেউ যেতে না চায় তখন থেকে শুরু হয় বাগবিতন্ডা। অনেক সময় চিকিৎসকের সহকারীরাও দালালদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বলেন ওরা যে জায়গাতে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে যান। কোন অসুবিধা হবে না। দ্রুত টেস্টগুলো করতে পারবেন। কম টাকা লাগবে। স্যার সবসময় ওখান থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। ফলে রোগীর স্বজন থেকে শুরু করে রোগীরাও হেনস্তার স্বীকার হচ্ছেন। হাসপাতালের নিরাপত্তার স্বার্থে আনসার সদস্য ডিউটি করেন। কিন্তু অধিকাংশ আনসার সদস্যদের নিকট থেকে রোগীরা কোন ধরনের সহযোগিতা পান না। যদি বকশিস দেয় তাহলে কেবল সহযোগিতা মেলে। হাসপাতালে ভতি রোগী দেখার একটা নিয়ম আছে। কিন্তু টাকা দিলে নিয়মের বাইরে গিয়েও রোগীর সাথে দেখা করা যায়। আর এ সুযোগটা করে দেন আনসার সদস্যরা। বকশিস দিলে সাত খুন মাফ। এমন অশুভ প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন।
হাসপাতালের দালালচক্র সদস্যদের গ্রেফতারের খবর প্রায়ই পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়। কখনো ঢাকায়, কখনো চট্রগ্রাম, কখনো সিলেট কিংবা রাজশাহীতে। কিন্তু কিছুদিন পর আবার তারা তৎপরত হয়ে উঠে। পুরোপুরি বন্ধ করা যায় না। কারণ অধিকাংশ দালালেরা হাসপাতালের কাছেই বসবাস করেন। একবার গ্রেফতার হলে আবার জামিন নিয়ে সেই একই কাজে নেমে পড়ে। তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য কঠোর আইনের প্রয়োজন। প্রয়োজন রোগীদের ভেতর সচেতনতা তৈরি করা। পাশাপাশি হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় দালালদের খপ্পরে না পড়ার জন্য সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা প্রয়োজন।
জরুরি যন্ত্রপাতি জেলাশহরের হাসপাতালগুলোতে স্থাপন করা দরকার। যেন ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমে আসে। আর সকল হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে পারলে সরকারি হাসপাতালও চিকিৎসা সেবার মাইলফলক হতে পারে। লেখক : প্রাবন্ধিক।