নাদিরা হক অর্পা

ভুয়া খবরের দুনিয়ায় সত্য যেন এক নিঃসঙ্গ যোদ্ধা। একসময় সংবাদ ছিল সমাজের আয়না, এখন তা অনেক সময় হয়ে উঠেছে মিথ্যার মুখোশ। আমরা প্রতিদিন অসংখ্য খবর দেখি, শুনি, শেয়ার করি কিন্তু কতটা যাচাই করি? বিশ্বজুড়ে আজ তথ্যের যুগ। চোখের পলকে সংবাদ পৌঁছে যায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আজকের পৃথিবী যেন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে আবদ্ধ যেখানে তথ্যের চেয়ে দ্রুত ছড়ায় বিভ্রান্তি, সত্যের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয় মিথ্যা। প্রযুক্তির বিস্ফোরণ আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে গোটা দুনিয়াকে, কিন্তু সে সঙ্গে খুলে দিয়েছে ভুয়া খবরের এক ভয়ংকর দ্বার। একসময় সংবাদ মানে ছিল সত্যের অনুসন্ধান, এখন তা হয়ে উঠেছে ক্লিক, শেয়ার আর ভিউয়ের প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার ভিড়ে সত্য যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। বলা যায়, আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে “তথ্যের বন্যায় সত্যের মৃত্যু” ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত।

প্রযুক্তির হাত ধরে মানুষ এখন তথ্যের সমুদ্রে ডুবে আছে। প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় কোটি কোটি পোস্ট, ভিডিও, ছবি ও খবর তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এ বিশাল তথ্যভাণ্ডারের মধ্যে কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা তা বুঝে ওঠা বেশ কঠিন। ভুয়া খবর বা Fake News কোনো নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এর প্রভাব এখন বহুগুণ বেড়ে গেছে। আগে গুজব ছড়াতে সময় লাগত, এখন লাগে কয়েক সেকেন্ড। একটি ভুয়া পোস্ট বা ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ফলে সত্য প্রকাশের আগেই মিথ্যা মানুষের মনে গেঁথে যায়। একটি মিথ্যা খবর যদি বলে, “অমুক তারকা মারা গেছেন” বা “অমুক রাজনীতিক দুর্নীতিতে জড়িত” মানুষ প্রথমেই বিশ্বাস করে, তারপর আলোচনা শুরু করে। পরে যখন সত্য প্রকাশ পায়, তখন কেউ আর তেমন গুরুত্ব দেয় না। এভাবেই মিথ্যার জোয়ারে সত্য ধীরে ধীরে ডুবে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়া আজকের যুগে সবচেয়ে বড় খবরের উৎস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটাই হয়ে উঠেছে ভুয়া খবরের জন্মভূমি। কারণ এখানে খবর ছড়ানোর জন্য সাংবাদিকতা জানা লাগে না, দায়বদ্ধতাও লাগে না। যে কেউ নিজের মতামত, ছবি বা ভিডিওকে “তথ্য” হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। অ্যালগরিদম বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা নির্ধারণ করে দেয় কে কী দেখবে, কী শুনবে। এতে তৈরি হয় তথাকথিত “ইকো চেম্বার”অর্থাৎ, আপনি যা বিশ্বাস করেন, কেবল সেই রকম খবরই আপনার সামনে আসে। ফলে মানুষ একধরনের মানসিক ঘেরাটোপে আটকে যায়, অন্য মত বা সত্যকে আর গ্রহণ করতে পারে না।অনেকে সচেতনভাবে ভুয়া খবর ছড়ায় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। কোনো ভিডিও কেটে-ছেঁটে নতুন বার্তা তৈরি করা হয়, কোনো ছবি অন্য প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়। এ “ডিজিটাল কারচুপি” আজ সমাজে অবিশ্বাস, ঘৃণা আর বিভেদ বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।

ভুয়া খবর প্রায়শই আবেগকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। ভয়, রাগ, সহানুভূতি বা উত্তেজনা-এ আবেগগুলো মানুষকে চিন্তা না করেই প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য করে। এজন্যই ভুয়া খবরের শিরোনামগুলো হয় চমকপ্রদ ও উত্তেজক। যেমন “মাত্র এখনই ঘটেছে!”, “বিশ্ব হতবাক!”, “চোখে বিশ্বাস হবে না!” ইত্যাদি। একবার কোনো ভুয়া খবর মনোজগতে জায়গা করে নিলে তা মুছে দেওয়া কঠিন। যদিও পরে সত্য প্রকাশ পায়, তবুও মিথ্যার প্রভাব থেকে যায় মানুষের মনে। এটাই সত্যের সবচেয়ে বড় পরাজয়।

যখন সমাজে ভুয়া খবরের রাজত্ব শুরু হয়, তখন ধীরে ধীরে মানুষের আস্থা ভেঙে পড়ে। কেউ আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। না সাংবাদিককে, না প্রশাসনকে, না এমনকি নিজের বন্ধুকেও। এ অবিশ্বাসই সমাজে অস্থিরতা, বিভাজন ও ঘৃণা তৈরি করে। ভুয়া খবরের কারণে বহু জায়গায় সহিংসতা হয়েছে, প্রাণহানিও ঘটেছে। মিডিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেলে রাষ্ট্রের গণতন্ত্রও দুর্বল হয়। কারণ সত্য সংবাদই হলো একটি সুশাসনের ভিত্তি। যখন সংবাদ বিকৃত হয়, তখন জনমতও বিকৃত হয়। এর ফলে ভুল সিদ্ধান্ত নেয় জনগণ, আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোটা সমাজব্যবস্থা।

ভুয়া খবরের এ দুনিয়ায় সত্যকে বাঁচাতে হলে সমাজে তিনটি জিনিস খুব জরুরি সচেতনতা, শিক্ষা ও দায়িত্ববোধ।

নিজেকে ফ্যাক্ট-চেকার হিসেবে গড়ে তোল

খবর দেখেই শেয়ার নয়, আগে যাচাই করতে হবে উৎস। ওয়েবসাইটটি কতটা নির্ভরযোগ্য? অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে একই খবর এসেছে কি না? এসব প্রশ্ন করা অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। মিডিয়া লিটারেসি বা তথ্য-শিক্ষা

বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে কীভাবে তথ্য যাচাই করতে হয়। উন্নত দেশে এ শিক্ষা এখন বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশেও এর প্রয়োজনীয়তা প্রতিদিন বাড়ছে। দায়বদ্ধ মিডিয়া ও নীতিনির্ধারকরা গণমাধ্যমকে আরও বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। তারা যেন “ব্রেকিং নিউজ” এর নামে মিথ্যা না ছড়ায়। সরকারেরও উচিত ভুয়া খবর শনাক্তের জন্য স্বচ্ছ ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করা যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যাহত না করে।

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা

ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক এদেরও দায় রয়েছে। তাদের অ্যালগরিদম এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ভুয়া খবর বা হেট স্পিচ ছড়ানোর আগেই চিহ্নিত হয় এবং সরানো যায়। ‎সত্যের মৃত্যু একদিনে ঘটে না, ঘটে ধীরে ধীরে যখন আমরা নীরব থাকি, প্রশ্ন করা বন্ধ করি, আর যাচাই ছাড়া বিশ্বাস করি।

আজ যদি আমরা নিজের মধ্যে যুক্তি, বিবেক ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে না তুলি, তবে আগামী প্রজন্ম একটি “ডিজিটাল মরুভূমিতে” বাঁচবে যেখানে শব্দ থাকবে, কিন্তু সত্য থাকবে না। তাই এখনই সময় সত্যকে রক্ষা করার, তথ্যকে সম্মান করার, আর ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে একসাথে দাঁড়ানোর। কারণ সত্যই একমাত্র আলো যে আলো নিভে গেলে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে মানবতা নিজেই।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।