ইঞ্জিঃ মোঃ ফায়জুল বারী

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional representation) বা PR নির্বাচন পদ্ধতিতে কোনো একটি রাজনৈতিক দল কর্তৃক সারা দেশে প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতিক হারে জাতীয় সংসদে আসন পাবে। এই পদ্ধতিতে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দিবেনা বরং দলকে ভোট দিবে। নির্বাচনের পূর্বেই প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্ধারিত ৩০০ জন প্রার্থীর একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনের কাছে দাখিল করবে। ভোট গ্রহণের পরে নির্বাচন কমিশন কোনো রাজনৈতিক দলের সারা দেশের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে (%) ঐ দলের প্রার্থীতা লিস্টের প্রথম থেকে তত পার্সেন্ট পর্যন্ত প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করবেন। অর্থাৎ কোন একটি দল সারা দেশে ১০% ভোট পেলে ঐ দল তাদের প্রদত্ত তালিকার ৩০০ জনের মধ্য হতে প্রথম ১০% আসনে বিজয়ী বিবেচিত হবে এবং ঐ দলের তালিকার প্রথম ৩০ জন সংসদ সদস্য হবেন। এই পদ্ধতিতে নির্বাচিত MP ’রা নির্দিষ্ট কোন এলাকার বা নির্দিষ্ট কোন আসনের MP হবেন না বরং তারা হবেন সারাদেশের জন্য। তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন, বিধি ও নীতি প্রণয়ন করবেন। এ পদ্ধতি চালু করা হলে উন্নয়নমূলক কাজসমূহ MP দের অধীনে হবেনা বরং তা হবে স্থানীয় স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমালোচনা পদ্ধতিতে গঠিত সরকার ব্যবস্থা আনস্ট্যাবল হয়। যেহেতু এই পদ্ধতিতে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে কখনো কখনো ছোট ছোট দলের উপরে নির্ভর করে জোট সরকার গঠন করতে হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে উক্ত ছোট ছোট রাজনৈতিক দল সমূহ জোট সরকার হতে তাদের সমর্থন তুলে নেওয়ার ফলে যদি জোট সরকারের সমর্থন ৫০% এর নিচে নেমে যায় তবে প্রচলিত ধারনা অনুসারে এ পদ্ধতির সরকার বহাল থাকার বৈধতা হারাবে। এই ধারনার উপরে ভিত্তি করে আমাদের কেউ কেউ এ পদ্ধতির সরকারকে অস্থিতিশীল বলার চেষ্টা করছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারনা পৃথিবীর কোথাও ছিল না তার পরেও রাষ্ট্র ও জনগণের মৌলিক প্রয়োজনের বিবেচনায় আমরা তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর করার বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি, প্রচলিত নিয়ম ভেঙে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়ে আমরা রাষ্ট্র ও জনগণের মৌলিক প্রয়োজন বিবেচনায় আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি, ঠিক একই ভাবে দেশের সরকারের স্থিতিশীলতা একটি কার্যকরী রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য সন্দেহ নেই। প্রয়োজনীয় কিছু নীতিগত বা আইনি পরিবর্তন করার মাধ্যমে আনুপাতিক পদ্ধতির মাধ্যমে গঠিত সরকারকে স্থিতিশীল করা যেতে পারে।

প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় আমাদের দেশের জাতীয় সংসদে বিদ্যমান মোট আসন সংখ্যা ৩০০টি, (I) কোন একটি দল বা জোট সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে জয়ী হতে পারলেও সেই দল বা জোটের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। অপরদিকে উক্ত দল বা জোট যদি ১৫০টি আসনের উপরে ১টি মাত্র আসন বেশি পেয়ে যায় অর্থাৎ ১৫০+১=১৫১টি আসন অর্জন করতে সক্ষম হয় তাহলে সে দল বা জোট সরকার গঠন করতে পারে। চলমান পদ্ধতিতে জোট সরকার হতে আসনের সমর্থন তুলে নেয়ার কোনো সুযোগ শরিক দলসমূহের না থাকার কারণে জোট সরকার ভেঙে পড়ার বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা দেখা যায় না।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় যদি আমাদের দেশের জাতীয় সংসদে মোট আসন সংখ্যা ৩০০টি ধরা হয় তাহলে, কোন একটি দল বা জোট সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে জয়ী হতে পারলেও সেই দল বা জোটের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না। অপর দিকে উক্ত দল বা জোট যদি ১৫০টি আসনের উপরে ১টি মাত্র আসন বেশি পেয়ে যায় অর্থাৎ ১৫০+১=১৫১টি আসন অর্জন করতে সক্ষম হয় তাহলে সে দল বা জোট সরকার গঠন করতে পারবে। যেহেতু আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলসমূহ ইচ্ছা করলে তাদের সমর্থন তুলে নিতে পারবে কাজেই এই পদ্ধতিতে ১৫১টি আসন নিয়ে জোট সরকার গঠনের পরে যদি কোনো কারণে শরিক দলসমূহ জোট হতে ১টি মাত্র আসনের সমর্থন তুলে নেয় তাহলে জোটে আসন বাকি থাকবে ১৫০টি ফলে জোট সরকার বহাল থাকার বৈধতা হারাবে এবং জোট সরকার ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। এখানে সরকার গঠিত হওয়া এবং ভেঙে যাওয়ার জন্য ১টি মাত্র আসনের ব্যবধান, ফলে এই ধরনের সরকার অস্থিতিশীল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ সরকার টালমাটাল করার চাবিটি ঐ ১টি মাত্র আসনের মালিকের হাতের মুঠোয়। যদি আমরা কোনো ভাবে এমনটা করতে পারি যে, জোট সরকার গঠিত হওয়ার পরে শরিক দলসমূহ কমপক্ষে তাদের ১০টি আসনের সমর্থন তুলে নিলেই কেবল জোট সরকার ভেঙে যাবে, জোট সরকার হতে যদি ১ট, ২টি, ৫টি বা ৮টি আসনের সমর্থনও শরিক দলসমূহ তুলে নেয় তবুও জোট সরকার ভেঙ্গে পড়বে না, কমপক্ষে ১০টি আসনের সমর্থন হারালেই কেবল সরকার ভেঙ্গে পড়বে এই ক্ষেত্রে সরকার ভেঙে পড়াও অনেক কঠিন ব্যাপার হবে। তাহলে সংখ্যানুপাতি নির্বাচনে গঠিত সরকার কেউ চাইলেও আনস্ট্যাবল করতে পারবেনা। এই ১০ আসনকেই আমরা বাফার আসন বলছি, যে আসনগুলো সরকারকে অস্থিতিশীল হওয়া থেকে রক্ষা করবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, যদি কোনো একক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে কমপক্ষে ১৫১টি আসনে বিজয়ী হয় তাহলে উক্ত একক দল জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জনকারী দল হিসাবে সরকার গঠন করবে। একক দলের ক্ষেত্রে বাফার আসন রাখা অর্থহীন কারণ এখানে ছোট ছোট দল কর্তৃক আসন প্রত্যাহার করার কোন বিষয় নেই।

আলোচিত বাফার আসনের এই সংখ্যা বাড়িয়ে এ পদ্ধতির জোট সরকার স্থিতিশীল করা যেতে পারে। PR পদ্ধতির জোট সরকার স্থিতিশীল করার ২টি মডেল নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :

জোট সরকার গঠনের মডেল-০১০৪

এ নির্বাচন পদ্ধতিতে জোট সরকার গঠন করার জন্য প্রস্তাবিত এই মডেল অনুসারে কমপক্ষে ১৬০টি আসন নিয়ে জোট সরকার গঠন করতে হবে, এবং সরকারি জোট হতে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের ১০টি আসনের সমর্থন তুলে নেওয়ার পরে জোটে ১৫০টি আসন অবশিষ্ট থাকলে সরকার বহাল থাকার বৈধতা হারাবে বা সরকার ভেঙ্গে যাবে। এক্ষেত্রে এ পদ্ধতির জোট সরকার স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে ১০টি (বাফার) আসন রাখা হয়েছে। জোট সরকারের এই বাফার আসন হতে ১ট, ২টি, ৫টি বা ৮টি আসনের সমর্থন তুলে নিলেও সরকার ভেঙে পড়বে না, কমপক্ষে ১০টি আসনের সমর্থন হারালেই সরকার ভেঙ্গে পড়বে, তাহলে জোট সরকার ভেঙে পরার সম্ভবনা খুবই কম থাকবে।

জোট সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন-১৬০টি।

PR নির্বাচন পদ্ধতিতে জোট সরকার গঠন করার জন্য প্রস্তাবিত এই মডেল অনুসারে কমপক্ষে ১৫১টি আসন নিয়ে জোট সরকার গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে PR পদ্ধতির জোট সরকার স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে ১০টি (বাফার) আসন রাখা হয়েছে। জোট সরকারের এই বাফার আসন হতে ১টি, ২টি, ৫টি বা ৮টি আসনের সমর্থন তুলে নিলেও সরকার ভেঙ্গে পড়বে না, কমপক্ষে ১০টি আসনের সমর্থন হারালেই সরকার ভেঙে পড়বে, তাহলে জোট সরকার ভেঙ্গে পরার সম্ভবনা খুবই কম থাকবে।

আইনের ধরন হবে

১। যদি কোনো একক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে কমপক্ষে ১৫১টি আসনে বিজয়ী হয় তাহলে উক্ত একক দল জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জনকারী দল হিসাবে সরকার গঠন করবে।

২। জোট সরকার গঠনের জন্য কমপক্ষে ১০টি আসন বাফার আসন হিসাবে বিবেচিত হবে এবং যার ১০টি আসন ১৫০টি আসনের (৫০%) উপরে হবে অর্থাৎ জোট সরকার গঠনের জন্য কমপক্ষে ১৬০টি আসনের সমর্থন প্রয়োজন হবে। জোটবদ্ধভাবে গঠিত সরকারের আসনের সমর্থন হারিয়ে ১৫০টিতে নেমে আসলে বা অবশিষ্ট থাকলে সরকার ভেঙ্গে যাবে, অর্থাৎ জোটবদ্ধ ভাবে গঠিত সরকারের সমর্থন ১৫১টি আসনের অবশিষ্ট থাকলেও সরকার বহাল থাকবে।

৩। জোটবদ্ধভাবে সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে মূল দলের সাথে শরিক দলসমূহের সম্পাদিত চুক্তি আইনি ভিত্তিতে হতে হবে। মূল ও শরিক দলসমূহ সম্পাদিত চুক্তির শর্তসমূহ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে বাধ্য থাকবে। যদি কোনো পক্ষ চুক্তির শর্তসমূহ অমান্য করে তাহলে অপর পক্ষ কোর্টের বা আইনের সহায়তা নিতে পারবে এবং কোর্ট যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। লেখক : প্রাবন্ধিক