মনসুর আহমদ
ভারতে ইংরেজ আগমনের পর হিন্দু জাতীয়তার পুনর্জাগরণ ও হিন্দু রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংকল্প তাদেরকে মুসলমানদের প্রতি চরম বৈরীভাবাপন্ন করে এবং ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব তাদের অসহনীয় হয়ে পড়ে। অকারণে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে দাংগা হাংগামার মাধ্যমে মুসলমানদের নির্মূল করার এক নীল নকশা তৈরি করা হয়। এ নকশা অনুযায়ী ভারতের সর্বত্র লোমহর্ষক মুসলিম নিধন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯২০ সাল থেকে বৃহৎ আকারে মুসলিম নিধন যজ্ঞ শুরু হয়।
বৃটিশ ভারতের বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকায় বসবাসকারী প্রায় তিনশত মিলিয়ন হিন্দু মুসলিম জনতার যে বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে ঘৃণা সৃষ্টি হচ্ছিল তা ছিল রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধ ‘Bloodshed and civil war’ তা শুরু হয়ে গেল। জিন্নাহ এ বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন।
ভারতে বৃটিশ শাসনের বিষাদময় শেষ মাস গুলিতে যে রক্তপাত ও গৃহ যুদ্ধ ঘটে ছিল সে সবের বর্ণনা দিয়েছেন জেনারেল স্যার ফ্রান্সিস টুকার তার While Memory serves নামক বইতে। বইখানার তিনটি অধ্যায়ে যথা ‘ কলিকাতার ভয়ানক গণহত্যা’ (আগষ্ট, ১৯৪৬), ‘ বিহারে নিষ্ঠুর মুসলিম গণহত্যা’ (অক্টোবর-নভেম্বর-১৯৮৬) এবং ‘Garhmukteswar Massacre (নভেম্বর- ১৯৪৬) বৃটিশদের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ায় ভারতে কী ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার পূর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ সময় ভারতীয়রা আইন নিজদের হাতে তুলে নিয়ে ছিল।
‘কলিকাতার ভয়ানক গণহত্যা’ আগষ্টের ১৬ তাং ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবসে শুরু হয়েছিল। দিবসটি ছিল বসন্ত কালের অত্যন্ত উত্তপ্ত, কষ্টকর ও সুপরিচিত দিন। সে দিন মুসলমানদের বিরাট সমাবেশ যখন তাদের মহান নেতাদের ব্যখ্যা শুনতেছিল, তখনই শুরু হয়েছিল এ গণ হত্যা। হিন্দু ও মুসলমানেরা তাদের ধারাল ছুরি নিয়ে একে অপরের মুখো মুখি দাঁড়াল। জেনারেল স্যার ফ্রান্সিস টুকার সে লাগামহীন নৃশংসতা, নরঘাতি উন্মাদনায় ক্ষিপ্তদের মার মার কাট কাট ও জ্বালাও পোড়াও এর ভয়ানক ঘটনা বর্ণনা করেছেন তার বইতে। তিনি এক যায়গায় লিখলেন, “কলিকাতার অপরাধ জগতের লোকদের হাতে ক্ষমতা চলে গেল।.. বাজার গুলো মরা মানুষে ভরে গেল। একটি কক্ষে ছিল পনেরটি লাশ এবং বাকি বারটিতে.. আমরা জীবন্ত দুটি শিশু উদ্ধার করলাম, উভয়টি ছিল আঘাত প্রাপ্ত যার একটি ইতোমধ্যে গ্রাংগ্রিণ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। তারা ছিল আধা পাগল অবস্থায়। শহরের আধিকাংশ মৃতের দূরতম ধারণা ছিল না যে তাদের কি ঘটতে যাচ্ছিল। কলিকাতার এ ঘটনায় চার হাজার মুসলমান ও হিন্দু নিহত হয়।”
যে মুসলিম জনগোষ্ঠী পুরুষাণুক্রমে হিন্দু প্রতিবেশীদের মাঝে হৃদ্যতা ও বিশ্বস্তার সাথে বিহারে বসবাস করে আসছিল, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে হঠাৎ করে হিন্দুদের এক বিরাট উচ্ছৃংখল জনতা তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞে নিহত মুসলিম নারী পুরুষ ও শিশু সংখ্যা ছিল প্রায় সাত থেকে আট হাজার। ইউনাইটেড প্রদেশে গর্ভবতী মহিলাদের পেট ফেড়ে বাচ্চা বের করা হয়, শিশুদের মাথা দেওয়ালে ঠুকে মাথার মগজ বের করে জমিনে ছড়িয়ে দেওয়া হয় । সেখানে চলছিল মহিলাদের উপর সীমাহীন ধর্ষণ। মহিলা ও শিশুদের দু’পা দু’দিকে টেনে ছিড়ে ফেলা হত। এ সব বর্ণিত হয়েছে একজন দায়িত্বপূর্ণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নথী থেকে। এ সব রাজনীতির ঘোলাটে মেঘের আড়ালে বসবাসকারী কোন কল্পনা বিলাসীর তথ্য নয়, বরং নিজ চোখে এ সব ঘটনা যে দেখেছিলেন ও তা দূরীভূত করতে সচেষ্ট ছিলেন তারই বর্ণনা।
এ সব করুণ দৃশ্য হোয়াইট হলে পৌঁছে গেল। ধ্বংস যজ্ঞের বিবরণী ও মধ্যবর্তী সরকারের অচলাবস্থা বৃটিশ কেবিনেটকে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার শেষ প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত করল। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে, লর্ড ওয়াভেল, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু এবং শিখদের প্রধিনিধি হিসাবে সরদার বলদেব সিং ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে লণ্ডন পৌঁছবেন। সেখানে তাঁরা কেবিনেট মিশনের পরিকল্পনাকে রক্ষা করার জন্য বৃটিশ গভার্মেন্টের সাথে শেষ বারের মতো আলোচনা চালাবেন। এই পুনর্মিলনের শেষ প্রচেষ্টাটি ছিল ভাসা ভাসা কিন্তু কঠোর। লণ্ডনে শিমলা কনফারেন্সের যুক্তি গুলি পুনরায় আলোচনায় স্থান পেল। কিন্তু কংগ্রেস ও লীগ নেতারা কেউই কোন ছাড় দিতে ইচ্ছা পোষণ করলেন না, ফলে মিটিং ব্যর্থ হলো।
দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির যেভাবে অবনতি ঘটতেছিল তার মোকাবিলা করে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী মিঃ এটলী ভারতের এ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করবার জন্য হাউস অফ কমন্সে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বৃটিশ সরকার কর্তৃক ভারতের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছা প্রকাশ করেন এবং ১৯৪৮ সালের জুন মাসের তাদের ভারত ছেড়ে চলে যাবার ঘোষণা দেন। সে উদ্দেশ্যে লর্ড ওয়াভেলের স্থলে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ‘entrusted with the task of transferring to Indian hands the responsibility for the government of british India in a manner that will best ensure the future happiness and prosperity of india’ নতুন এবং শেষ বড় লাট হয়ে আসেন। নতুন ভাইসরয়কে শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। দিল্লীতে পদার্পণ করেই তিনি ঘোষণা করলেন যে, বৃটিশ সরকার ১৯৪৮ সনের জুন মাসের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং কংগ্রেসের দাবির প্রেক্ষিতে অখণ্ড ভারত রক্ষার্থে যথেষ্ট চেষ্টা করেন। কিন্তু আপোষের কোনরূপ সম্ভাবনা দেখা গেল না।
জিন্নাহ Kingsway Hall-এ ঘোষণা দিলন, “ÒDemocracy is the blood of Mussalmans…I give you an example. Very often when I go to mosque, my chauffeur stands side by side with me. Mussalmans believe in fraternity, equality, and liberty… There is no other way but to divide India, Give Muslims their home land and give Hindus Hindustan” এভাবে জিন্নাহ ও লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের পাকিস্তান দাবিতে অটল থাকলেন। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস লীগের দাবি অনুসারে ভারত বিভাগ করণে রাজী হয়। কিন্তু লীগকে ও পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য কংগ্রেস এক নতুন দাবি উত্থাপন করল যে, বাংলা ও পাঞ্জাব হিন্দু- মুসলমান অধিবাসী এলাকা হিসাবে ভাগ করতে হবে। জিন্নাহ, পাঞ্জাবের গভর্ণর স্যার জেনকিনস, বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং গভর্নর ফ্রেডারিক বরোজ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু ভাইসরয় কংগ্রেসের ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগের প্রস্তাব করেন। অবশেষে সে ভাবেই বিভক্ত পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়।
লেখক : প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক।