মোঃ মঈনুদ্দিন চৌধুরী
অতিসম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে অনুষ্ঠিত এক সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদসমূহের নিয়োগ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে বিধি-বিধান পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটি কর্তৃক প্রণীতব্য নীতিমালাসমূহ অনুমোদনের পর যথারীতি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে পত্রিকাসূত্রে জানা গিয়েছে। অনেক দেরিতে হলেও এ মহৎ এবং শিক্ষা-বান্ধব উদ্যোগ নেয়ার জন্য একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সাধুবাদ ও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। প্রকৃত অর্থে বিগত বছরগুলিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া একদিকে যেমন অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, অন্যদিকে গুণী, মেধাবী, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকবৃন্দের এসব পদে নিয়োগ প্রত্যাশিত থাকা স্বত্ত্বেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ব্যবস্থাপনার তিনটি স্তরের মধ্যে (উচ্চস্তর, মধ্যস্তর ও নিম্নস্তর) প্রশাসন হচ্ছে উচ্চস্তরের অন্তর্ভুক্ত- যেখানে যাবতীয় লক্ষ্য ও নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি কার্যসম্পন্ন করা হয়। বাকি কাজ মধ্যস্তর ও নিম্নস্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। অর্থাৎ প্রশাসন বা উচ্চস্তর হচ্ছে চিন্তনীয় কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে বাকি দু’টি স্তর করণীয় কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত । প্রশাসনকে একটি রেলগাড়ির ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করা যায়, যেটি ট্রেনের বাকি বগিগুলোকে টেনে নিয়ে যায়। একটি সম্পূর্ণ রেলগাড়িকে যদি ব্যবস্থাপনা হিসেবে ধরা হয় সেক্ষেত্রে রেলগাড়ির ইঞ্জিনকে প্রশাসন (উচ্চস্তর) এবং এটির বগিসমূহকে ব্যবস্থাপনার বাকি অংশ অর্থাৎ মধ্যস্তর ও নিম্নস্তর হিসেবে গণ্য করা যায়। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নয়) উল্লেখিত প্রশাসনিক পদসমূহে সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে নিয়োগ না দেয়ার কারনে/ বঞ্চিত করার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে হেনরি ফেয়লের শৃঙ্খলার নীতি(ব্যবস্থাপনার একটি নীতিমালা) লঙ্ঘিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। ফলশ্রুতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মানের অবণতি ঘটায় প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এনটিআরসি -এর মাধ্যমে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক পদসমূহে নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ নিঃসন্দেহে যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বাড়িয়ে দেবে- যা দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে নতুন বিধি-বিধান বা নীতিমালা প্রণয়নে সম্মানীত নীতি নির্ধারকদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষন করে কিছু সুপারিশ প্রস্তাব আকারে পেশ করছি।
১. শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা, চাকুরির শর্তাবলী কিংবা রেগুলেশনের মধ্যে যেসব বিষয়ে অস্পষ্টতা ও সাংঘর্ষিকতা এখনও বিদ্যমান রয়েছে সেসবের মধ্যে ঐক্যতান বজায় রাখা বা সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা- যাতে হেনরি ফেয়লের অন্যতম মূলনীতি/নীতিমালা ‘আদেশের ঐক্যনীতি’ ও ‘নির্দেশনার ঐক্য নীতি ’ ব্যাহত না হয়।
২. শিক্ষার্থী তথা শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়নের স্বার্থে উল্লেখিত প্রশাসনিক পদসমূহে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬২ বছর এবং পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রিধারীদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর করা;
৩. শৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্ব এড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করে ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে শুধুমাত্র ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ রাখা। তবে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে কর্মরত এমফিল ও পিএইচডিধারীদের এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা যায়;
৪. উল্লিখিত পদসমূহে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার সনদের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ সনদের নম্বর বন্টনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব প্রদান করা।
৫. পিএইচডি ও এমফিল সনদকে সনদ নম্বর বন্টনের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় নেয়া;
৬. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়/এইচএসটিটিআই/ ব্যানবেইজ প্রদত্ত কম্পিউটার/আইসিটি/ মাল্টিমিডিয়া সনদকেও সনদ নম্বর বন্টনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া এবং উক্ত পদসমূহে কম্পিউটার/ ল্যাপটপ পরিচালনার জ্ঞান থাকাটা আবশ্যিক করা, কারণ, যুগের চাহিদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান/উপ-প্রধানের কম্পিউটার পরিচালনা/ আইসিটি বিষয়ক ধারনা থাকা অত্যাবশ্যক;
৭. যেহেতু অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদ দু’টি যথাক্রমে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদের সমতূল্য তাই উক্ত পদ দু’টির নিয়োগ প্রার্থীদের কমপক্ষে একটি আর্টিকেল (দেশি অথবা আন্তর্জাতিক জার্নালে) এবং কমপক্ষে পাঁচটি আর্টিকেল (জাতীয় বাংলা অথবা ইংরেজি সংবাদপত্রে) থাকাটা বাধ্যতামূলক করা;
৮.বাংলাদেশে কিছু ইন্টারমিডিয়েট কলেজ রয়েছে যেগুলোতে স্নাতক (পাস) কোর্সে অধিভুক্তি /এমপিওভুক্ত না থাকলেও এমপিওবিহীন অনার্স কোর্স চালু রয়েছে সেসব কলেজে অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে শর্তাবলী সুস্পষ্ট করা (যেহেতু রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন সময়ে প্রথমে ডিগ্রি পাস কোর্স খোলার শর্ত এড়িয়ে শর্ত ভঙ্গ করে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে);
আশা করি সম্মানীত নীতি নির্ধারকগণ তাদের বিচক্ষণ ও পান্ডিত্যপূর্ণ সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শিক্ষক তথা শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষার প্রতিটি স্তর ও পর্যায়ের জন্য দূরদর্শী, বিজ্ঞানসম্মত, যুগোপযোগী ও বৈষম্যহীন একটি নীতিমালা এই জাতিকে উপহার দিতে সক্ষম হবেন। নীতিমালা প্রণয়নের সময় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার নিয়মাবলী এবং প্রখ্যাত ব্যবস্থাপনা বিশারদ হেনরি ফেয়লের ১৪ টি মূলনীতি উত্তমরূপে বিশ্লেষন করে নীতিমালা প্রণয়ন করলে আশা করা যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নীতিমালাসমূহের মধ্যে যে সাংঘর্ষিকতা রয়েছে তা দূর করা সম্ভব হবে। ক্ল্যাসিক্যাল থিওরি মোতাবেক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি ‘সর্বোত্তম উপায় বা পদ্ধতির’ কথা বলা হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বর্তমানে এধারনার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বলা হয় ‘কোন একটি উপায় বা পদ্ধতিই সর্বোত্তম নয়’। এখন সম্পূর্ণরূপে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করেই ব্যবস্থাপকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।