জাফর আহমাদ

ইসলামে গালি-গালাজ করা সম্পূর্ণরূপে হারাম এবং একটি বড় (কবীরা) গুনাহ। এটি একজন মানুষকে হেয় করা, তার ভাবমূর্তি নষ্ট করা এবং অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করা সবই কবীরা গুনাহের অন্তুর্ভুক্ত। ইসলামের নিন্দনীয় কাজগুলোর মধ্যে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা অন্যতম। সাধারণ লোকদের পাশাপাশি কোন আলেম বা ধার্মিক ব্যক্তিকে গালি দেয়া আরও বেশি গুরুতর পাপ কারণ এর মাধ্যমে জ্ঞানকে অবমাননা করা হয়।

আবদুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসিকী এবং হত্যা করা কুফরী। শুবাহ সূত্রে গুনদারও এ রকম বর্ণনা করেছেন। (বুখারী : ৬০৪৪, কিতাবুল আদাব, বাবু মা উনহা মিনাস সিবাবে ওয়াল লায়ানে, আ.প্র: ৫৬০৯, ইফা : ৫৫০৫, বুখারী ৭০৭৬, কিতাবুল ফিতান, বাবু কাউলি রাসুলিল্লাহ (সা:), বুখারী : ৪৮, মুসলিম : ৬৪)

আবু যার (রা:) হতে বর্ণিত। নবী (সা:) বলেছেন: একজন অপরজনকে ফাসিক বলে গালি না দেয় এবং একজন অন্যজনকে কাফির বলে অপবাদ না দেয়। কেননা, অপরজন যদি তা না হয়, তবে সে অপবাদ তার নিজের উপরই আপতিত হবে। (বুখারী : ৬০৪৫, কিতাবুল আদাব, বাবু মা উনহা মিনাস সিবাবে ওয়াল লায়ানে, বুখারী : ৩৫০৮, মুসলিম, ৬১, আহমাদ : ২১৫২১, আপ্র:৫৬১০, ইফা : ৫৫০৬) আনাস ইবনে মালিক (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) অশালীন, লা’নতকারী ও গালিদাতা ছিলেন না। তিনি কাউকে তিরস্কার করার সময় শুধু এটুকু বলতেন: তার কী হলো? তার কপাল ধূলিমলিন হোক। (বুখারী: ৬০৪৬, কিতাবুল আদাব, বাবু মা উনহা মিনাস সিবাবে ওয়াল লায়ানে, বুখারী: ৬০৩১, আ;প্র:৫৬১১, ইফা : ৫৫০৭)

আবু যার (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: তার উপর একখানা চাদও ও তার গোলামের গায়ে একখানা চাদও দেখে বললাম, যদি আপনি ঔ চাদরটি নিতেন ও পরতেন, তাহলে আপনার এক জোড়া হয়ে যেত আর গোলামকে অন্য কাপড় দিয়ে দিতেন। তখন আবু যার বললেন: একদিন আমার ও আরেক লোকের মধ্যে কতাবার্তা চলছিল। তার মা ছিল জনৈকা অনারব মহিলা। আমি তার তুলে গালি দিলাম। তখন লোকটি নবী (সা:) এর নিকট তা বলল। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি অমুককে গালি দিয়েছো? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: তুমি কি তার মা তুলে গালি দিযেছো? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: নিশ্চয়ই তুমি তো এমন লোক যার মধ্যে জাহিলী যুগের স্বভাব আছে। আমি বললাম: এখনো? এ বৃদ্ধ বয়সেও? তিনি বললেন: হাঁ। তারা তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তা’আলা ওদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা যার ভাইকে তার অধীন করে দেন, সে নিজে যা খায়, তাকেও যেন তা খাওয়ায়। সে নিজে যা পরে, তাকেও তা পরায়। আর তার উপর যেন এমন কোন কাজ না চাপায়, যা তার শক্তির বাইরে। আর যদি তার উপর এমন কঠিন ভার দিতেই হয়, তাহলে সে নিজেও যেন তাকে সাহায্য করে।”(বুখারী:৬০৫০, কিতাবুল আদাব, বাবু মা উনহা মিনাস সিবাবে ওয়াল লায়ানে, বুখারী: ৩০, আ;প্র : ৫৬১৫, ইফা : ৫৫১১)

আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি নবী (সা:) এর নিকট প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি লোকটিকে দেখে বললেন: সে সমাজের নিকৃষ্ট লোক এবং সমাজের দুষ্ট সন্তান। এরপর সে যখন এসে বলল, তখন নবী (সা:) আনন্দ সহকারে তার সাথে মেলামেশা করলেন। লোকটি চলে গেলে ‘আয়িশাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসুল! যখন আপনি লোকটিকে দেখলেন তখন তার ব্যাপারে এমন বললেন, পরে তার সাথে আপনি আনন্দচিত্তে সাক্ষাৎ করলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা:) বললেন: হে আয়িশাহ! তুমি কখন আমাকে অশালীন দেখেছো? কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মর্যাদার দিক দিয়ে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি, যার দুষ্টামির কারণে মানুষ তাকে ত্যাগ করে। (বুখারী : ৬০৩২, কিতাবুল আদাব, বাবু লাম ইয়াকুন নাবীয়্যু ফাহিশান ওয়ালা মুতাফাহ্হিশান অর্থাৎ নবী (সা:) অশালীন ছিলেন এবং অশালীনের ভানও করতেন না, বুখারী : ৬০৫৪, ৬৪৩১, মুসলিম : ২৫৯১, আহমাদ : ২৪১৬১, আ.প্র:৫৫৯৭, ইফা : ৫৪৯৩)

মুসলমান যে কালিমা পাঠ ও আন্তরিক বিশ্বাসের মাধ্যমে পবিত্র হয়েছেন, যে কালিমার মাধ্যমে ঈমান নামক সবুজ অরণ্যে প্রবেশ করেছেন, সে কালিমাকে আল কুরআনে অত্যন্ত পবিত্র কথা বলে অভিহিত করা হয়েছে। যার মূল মাটির অতল গভীরে প্রোথিত, যার শাখা প্রশাখা বিস্তর জায়গা দখল করেছে। যার ফল অত্যন্ত মিষ্টি। সে ব্যক্তির মুখ থেকে তো কখনো ‘ফাহেশা’ কথা বা ‘লাগবে’ কথা বের হতে পারে না। তাহলে তো সফলকাম মু’মিন হতে পারে না। কারণ সফলকাম মু’মিনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন,“বাজে কাজ থেকে দূরে থাকে।” (সুরা মু’মিনুন : ৩) উপরের ৫টি হাদীস ও কুরআনে আয়াত অনুসারে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, মানুষের মধ্যে ঈমান ও ফাহেশা কথা ও কাজ এক সাথে পাশাপাশি থাকতে পারে না। হয় সে মু’মিন থাকবে নয়তো ফাসিক। যদি কোন ঈমানদারদের মুখ থেকে কোন ফাহেশা কথা বের হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি তাকে তাওবা ইস্তেগফার করে ঈমানের চৌহদ্দির মধ্যে ফিরে আসতে হবে। অন্যথায় সে ফাসিক হিসাবে মৃত্যুবরণ করবে।

যিনি মু’মিন, তার আচরণ হবে সহনশীল, মুখ থেকে সর্বদা মধুবাক্য ঝড়বে। পবিত্র কথা ছাড়া কোন অশালীন কথা তার মুখ থেকে বের হবে না। আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।” (সুরা আহযাব : ৭০) একজন মুমিন এমন কথা বলা উচিত নয়, যা একটি মারাত্মক বোমার চেয়েও ক্ষতিকর। একটি বোমা নির্দিষ্ট কিছু লোকের জান-মালের ক্ষতি করে থাকে। কিন্তু একটি খারাপ কথা সমাজ ভাঙ্গনের কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে থাকে। সমাজকে বিভিষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখী করে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধের স্থান দখল করে নেয় হিংসা-হানাহানি, বিদ্বেষ আর অহংবোধ। আর এর ফলে মানুষ চরম দুঃখ-দূর্দশার সম্মুখীন হয়। অথচ একজন মুমিন কখনো অন্য একজন মু’মিনকে কষ্ট দিতে পারে না। সে কথাটি যদি আবার সঠিক না হয়, কিংবা সেটি লক্ষ লক্ষ মানুষের মনোকষ্টের কারণ হয়, তাহলে ব্যাপারটি আরো মারাত্মক। কারন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: “মু’মিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি মেহেরবাণী করা হবে।” (সুরা হুজরাত : ১০) “মানুষ খারাপ কথা বলে বেড়াক, তা আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না। তবে কারো জুলুম করা হলে তার কথা স্বতন্ত্র। আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।” (সুরা নিসা : ১৪৮) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে সহযোগীতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোন ব্যক্তির জন্য তার কোন মুসলমান ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করার মত অপকর্ম আর নাই।” (মুসনাদে আহমাদ)

মন্দ কথা ঐক্য বিনষ্ট করে। অথচ ইসলাম একতা, অখণ্ডতা ও অবিভাজ্যতারূপকে অধিক পছন্দ করে। অনৈক্য ঈমানেরও পরিপন্থি। কারণ ইসলামের প্রতিটি ইবাদাতই মানুষদেরকে মন্দ কথা ও কাজ পরিহার করে ভালো কথা বলা ও চলার জন্য সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে। দৈনন্দিনের প্রতিটি ইবাদাতই ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে একেকটি বিশেষ কর্মসূচী। ইসলাম বলে ‘মানুষের প্রতি রহম তথা সহানুভূূতিশীল হও, তাহলে আকাশের মালিকও দয়া করবেন। তাওহীদ, নামায, যাকাত, রোযা ও হজ্বের প্রতি গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বুঝা যায় যে, প্রতিটি ইবাদাতই মানুষের সামগ্রীক জীবনকে ইসলামের ধাঁচে গঠনে সুনিপূণভাবে সাহায্য করে থাকে। মানুষকে দানশীল, উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল, মানব-দরদী ও পারস্পরিক কল্যাণকামী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য এর কোন বিকল্প খোঁেজ পাওয়া যাবে না।‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ সত্যটি থেকেই ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

পৃথিবীর প্রথম মহামানব হযরত আদম (আ:) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা:) পর্যন্ত ইসলাম যে জিনিসটির প্রয়োজনীয়তাকে তীব্রাকারে উপলব্ধি করেছে সেটি হলো ঐক্য বা ‘বুনিয়ানুম মারসুস’। আর এ বুনিয়ানুম মারসুস বা ঐক্য গড়ার জন্য আল্লাহ তা’আলা মানুষকে প্রথমেই যে শিক্ষা দিয়েছেন তা হলো: সুন্দর ভাষায় ও ভালো কথার মাধ্যমে মানুষকে ডাকো। সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম তাদের মিশণকে এগিয়ে নেয়ার সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবীদার ছিল ‘তাদের সুন্দর আচরণ, যাকে আল কুরআন ‘শুয়াদা আ’লান নাস’ বা বাস্তব সাক্ষ্য হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। ইসলামে ভালো কথা ও আচরনের গুবুত্ব কতটুকু তা নিম্নলিখিত আযাতগুলো থেকে অনুমেয়।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি দাউদের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা আর সর্বোত্তম বাগ্নিতার শক্তি বা অকাট্য কথা বলার যোগ্যতা।” (সূরা সোয়াদ : ২০) হযরত মুসা ও হারুন (আ:) ফিরাউনের কাছে প্রেরণের প্রাক্কালে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তোমরা দু’জন যাও ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে। আর তার সাথে কোমলভাবে কথা বলবে, যাতে করে সে উপদেশ গ্রহণ করে, কিংবা ভীত হয়ে যায়।” (সুরা ত্বাহা : ৪৩-৪৪)

শেষ নবী মুহাম্মদ (সা:)কে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “হে মুহাম্মদ, আমার বান্দাদেরকে বলো, তারা যেন মুখ হতে সে সব কথাই বের করে যা অতি উত্তম। আসলে শয়তানই মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে থাকে। প্রকৃত কথা হলো, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” (সুরা বনী ইসরাঈল : ৫৩) আল্লাহ তা’আলা বলেন: “এটা আল্লাহ তা’আলারই দয়া যে, তুমি তাদের প্রতি ছিলে কোমল প্রকৃতির। তা না হয়ে যদি তুমি তাদের প্রতি কঠোর হতে, তাহলে তারা তোমার নিকট থেকে সরে যেত।” (সুরা আল ইমরান : ১৫৯) রাসুল (সা:) ও মু’মিনদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তখন আল্লাহ তার রাসুল ও মুমিনদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদের জন্যে ন্যায় ও বিবেকসম্মত বা তাক্ওয়ার কথা বলা কর্তব্য করে দিলেন, আর তারাই এ ধরনের কথা বলার অধিক উপযুক্ত।” (সুরা ফাতাহ : ২৬)

লেখক : ব্যাংকার।