আর্শিনা ফেরদৌস
মানবজীবনে অভ্যাস এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অনুসঙ্গ। কারণ মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাসই মানুষকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে; ঘুরপাক খেতে হয় এ বৃত্তের মধ্যেই। মূলত ভালো অভ্যাস আমাদের মনে স্বস্তি ও শান্তি আনে ও বিকশিত করে মানুষের মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্বকে। যেমনÑ প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম, বই পড়া, সত্য কথা বলা কিংবা মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাÑ এসব ইতিবাচক অভ্যাস দেহ, মন ও আত্মাকে প্রশান্ত ও জীবনকে সমৃদ্ধ করে। সময়ানুবর্তিতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা কিংবা প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণও ভালো অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। এসব অভ্যাস শুধু ব্যক্তিগত উন্নতিই সাধন করে না, বরং সমাজকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও গতিশীল করে তোলে। অন্যদিকে মানুষের এমন অনেক অভ্যাস রয়েছে যেগুলোর আসলে কোনো প্রয়োজন নেই; শুধু সময় ও শক্তি নষ্ট করে। যেমনÑ অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার, উদ্দেশ্যহীনভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করা, রাত জেগে সময় অপচয়, অনর্থক আলাপ বা অভিযোগ করার প্রবণতা। এসব করলে কাজের ক্ষতি হয়, মনোযোগ কমে যায় এবং জীবনের গতি ব্যাহত হয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আর খারাপ অভ্যাস যেমন হিংসা, পরনিন্দা, অলসতা পরশ্রীকাতরতা ও আসক্তি এসব মানসিক যন্ত্রণা তৈরি করে এবং ব্যক্তি ও সমাজে অসামঞ্জস্য আনে। উদাহরণস্বরূপ, কারো অলসতার কারণে তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিংবা পরনিন্দার অভ্যাস থেকে সমাজে অবিশ্বাস ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়তে পারে। খারাপ অভ্যাসের প্রভাব ব্যক্তিগত জীবনের বাইরেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দেখা যায়, যা সবার জন্যই পরিত্যাজ্য।
তবুও মানুষ বারবার খারাপ বা অপ্রয়োজনীয় অভ্যাসের দিকে ফিরে যায়, যেন স্বভাবজাত টান আমাদের আটকে রাখে। জীবন আসলে এক ধরনের পারফরমেন্স আর্ট, যেখানে প্রত্যেক মানুষ নিজের ভঙ্গিতে অভিনয় করে; কিন্তু অভিনয়ের মান নির্ভর করে অভ্যাসের ওপর। বাণী চিরন্তন অনুযায়ী ‘যেমন চিন্তা করবে, তেমনই হবে তুমি’। অর্থাৎ চিন্তার সাথে যুক্ত অভ্যাসই চরিত্র ও ভাগ্য গড়ে; নিজের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে নিয়ামক শক্তি হয়ে আবির্ভূত হয়। দার্শনিক সক্রেটিসের ভাষায়, ‘অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য নয়।’ তাই অভ্যাসকে যাচাই না করলে আমরা নিজেদের প্রকৃতিকে হারিয়ে ফেলি। তাই জীবনের সব ক্ষেত্রে বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করে ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলবে হবে।
আধুনিক বিজ্ঞানের মনে করে, অভ্যাস তৈরি হয় নিউরনের পুনরাবৃত্ত সঞ্চালন থেকে; যা আমরা নিয়মিত করি, তা-ই মস্তিষ্কে স্থায়ী ছাপ ফেলে। তাই ভালো অভ্যাস তৈরি করা মানে মস্তিষ্ককেও নতুনভাবে গঠন; নিজেকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা। অভ্যাস বদল কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। অপ্রয়োজনীয় ও খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করে ভালো অভ্যাস গ্রহণ করলে জীবন শুধু সুশৃঙ্খল নয়, বরং শিল্পের মতো সুন্দর ও গতিশীল হয়ে ওঠে।
রাজনীতিবিদদের অভ্যাস শুধু তাদের ব্যক্তি জীবন নয়, রাষ্ট্রের নীতি, সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রের ভিত্তিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাই সকল রাজনীতিকের উচিত জীবনের সকল ক্ষেত্রে বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করে ভালো কাজের অনুশীল ও অভ্যাস গড়ে তোলা, যা মানুষ বা আর্ত-মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হতে পারে। বহু পুরনো রাজনৈতিক অভ্যাস এখনো অনেক দেশে বিদ্যমান, যা আধুনিক সমাজের চাহিদার সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রচারণায় একসময় মিছিল-মিটিং আর মঞ্চকেন্দ্রিক বক্তৃতাই ছিল প্রধান মাধ্যম। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এ অভ্যাস আর যথেষ্ট নয়। আজকের নাগরিক সমাজ প্রত্যাশা করে সরাসরি যোগাযোগ, সামাজিক মাধ্যমে স্বচ্ছ জবাবদিহিতা এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। তাই প্রচলিত কৌশলকে বদলে জনগণের কাছে পৌঁছানোর নতুন ধারা তৈরি করতে হবে। তাহলেই দেশের প্রচলিত কক্ষচ্যুত রাজনীতি কক্ষেপথে ফিরে আসবে এবং জনগণের কাছে রাজনীতিকদের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে।
রাজনীতিতে একটি নেতিবাচক অভ্যাস হলোÑ ক্ষমতায় টিকে থাকার অশুভ প্রবণতা। যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত ও সমর্থনযোগ্য নয়। একথা অনস্বীকার্য যে, প্রচলিত রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি বা জনকল্যাণের বদলে কেবল দল বা ব্যক্তির ক্ষমতা রক্ষা অগ্রাধিকার পায়। ফলে গণতন্ত্র দুর্বল হয় এবং জনগণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা হারায়। আরেকটি বড় সমস্যা হলো পরিবারতন্ত্র ও ব্যক্তিপূজা। যেখানে নীতি, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব গড়ে ওঠা উচিত, সেখানে অনেক সময় নেতৃত্ব উত্তরাধিকারের মাধ্যমে আসে। গণতন্ত্রে মতভিন্নতা ও অংশগ্রহণ অপরিহার্য, কিন্তু অসহিষ্ণুতার অভ্যাস এটিকে দমিয়ে রাখে। যা জাতির বোধ-বিশ্বাস ও আশা-আকাক্সক্ষার সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, ‘মানুষ তার অভ্যাসের ফল।’ রাজনীতিবিদরা যদি সংকীর্ণ ও নেতিবাচক অভ্যাসে আটকে যান, তবে গণতন্ত্রও সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। একইভাবে জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ‘অন লিবার্টি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা মানে শুধু সরকারের নিয়ন্ত্রণের সীমা নয়, বরং মানুষের মত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ।’ এ বাণী স্পষ্ট করে যে, রাজনৈতিক অভ্যাস যদি মত প্রকাশ ও সংলাপের সুযোগ না দেয়, তবে গণতন্ত্রের মূল সত্তাই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বিঘ্নিত হয় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। আর স্বাধীনতার ৫ দশক পরও আমরা এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি।
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, পরিবর্তনের জন্য কিছু পদক্ষেপ জরুরি। প্রথমত, রাজনৈতিক প্রচারণায় স্বচ্ছতা আনা দরকার। অতিমাত্রায় আবেগ নির্ভরতা নয়, বরং তথ্য, বাস্তবতা ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা বৃদ্ধি করা উচিত, যাতে নেতৃত্ব জন্মগত উত্তরাধিকারের মাধ্যমে নয়, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আসে। তৃতীয়ত, বিরোধীদলের সাথে সংলাপের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মতভিন্নতাকে হুমকি নয়, বরং নীতি-প্রণয়নের বিকল্প পথ হিসেবে দেখতে হবে। চতুর্থত, প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমকে শুধু প্রচারণার হাতিয়ার নয়, জনগণের অংশগ্রহণের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই দেশ ও জাতির আগামী সুন্দর ও গতিশীল হয়ে উঠবে।
এছাড়া শিক্ষা ও গবেষণাভিত্তিক নীতি প্রণয়নের অভ্যাস তৈরি করা দরকার। মূলত, শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ থেকে কোন দেশ ও জাতির পক্ষে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। অনেক দেশে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাজনৈতিক সুবিধার জন্য, বাস্তব গবেষণার আলোকে নয়। এ প্রবণতা বদলালে নীতি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয়। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করার সংস্কৃতি তৈরি করা প্রয়োজন। কারণ তারা নতুন চিন্তা ও আধুনিক দক্ষতা নিয়ে আসে।
আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’। এ সংজ্ঞার আলোকে স্পষ্ট হয়, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে রাজনীতিবিদদের পুরনো ও ক্ষতিকর অভ্যাস পরিবর্তন করা অপরিহার্য। কেবল স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সহিষ্ণুতা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার সত্যিকারের জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদদের নতুন করে ভাবতে হবে; পরিবর্তন করতে হবে নেতিবাচক অভ্যাসের। তাহলেই আগামী দিন সমৃদ্ধ জাতি গড়া সম্ভব হবে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক