গত চব্বিশ আগষ্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি সংবাদ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। নানা ধরনের সমস্যা থাকা সত্বেও রপ্তানি আয় ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৪৮ হাজার ২৯৯ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছিল ৪৪ হাজার ৪৭৪ দশমিক ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একইভাবে গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ৩০ হাজার ৩২৮ দশমিক ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগের বছর রেমিট্যান্স আয় হয়েছিল ২৩ হাজার ৯১২ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

গত অর্থবছরের প্রায় পুরোটাই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ছিল। গত বছর জুলাই-আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে। বিগত সরকার আমলে দেশের অর্থনীতি নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়েছে। সে ক্ষতির মারাত্মক চিহ্ন বিভিন্ন সেক্টরে ফুটে উঠে। দেশের অর্থনীতির অধিকাংশ খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সে অবস্থা থেকে এখনো আমরা উত্তরণের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারিনি। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বিগত সরকার পতনের পর থেকেই পণ্য রপ্তানি খাত চাঙ্গা হতে শুরু করে। একই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিরা পর্যাপ্ত পরিমাণে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করতে শুরু থাকে। অনেকেই মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ প্রবাসী বাংলাদেশিরা বেশি বেশে করে রেমিট্যান্স প্রেরণ করছেন। কিন্তু তাদের এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। প্রবাসী বাংলাদেশিরা অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতি ভালোবাসার টানে বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স প্রেরণ করছেন না। তারা অধিক লাভের আশায় বেশি করে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করছেন। ঠিক একই কারণে রপ্তানিকারকগণ তাদের উপার্জিত আয়ের অধিকাংশই এখন দেশে নিয়ে আসছেন। ফলে রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স আয় উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দু’টি খাত হচ্ছে রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স। পণ্য রপ্তানি খাত চাঙ্গা থাকা এবং বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স দেশে আসার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশি ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করার পরও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ আশাব্যাঞ্জকভাবে বাড়ছে।

অর্থের মালিক বুঝেন লাভ। কোথায় বিনিয়োগ করলে অথবা কিভাবে অর্থ দেশে প্রেরণ করলে বেশি লাভ পাওয়া যাবে সেটাই তারা বিবেচনা করেন। হঠাৎ করেই রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রতি বছরই রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সেটা বৈধ চ্যানেলে দেশে না আসার কারণে তা দৃশ্যমান হতো না। বিগত সরকার আমলে যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন তাদের কিছু উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভুলের কারণেই মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ বৈধ পথে দেশে আসতো না। একইভাবে পণ্য রপ্তানিকারকগণ স্থানীয় মুদ্রায় কম অর্থ পাবার আশঙ্কায় উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশই বিভিন্ন দেশে রেখে দিতেন। মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটলে পণ্য রপ্তানিকারকগণ উপার্জিত অর্থ দেশে আনতে উৎসাহি হয়। কিন্তু মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা অতিমূল্যায়িত হয়ে থাকলে রপ্তানিকারকগণ তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে আনতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

অন্যান্য কিছু কারণ থাকলেও বিগত সরকার আমলে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণেই রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে দেশে আসতো না। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্থানীয় মুদ্রায় বেশি অর্থ পাবার প্রত্যাশায় হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করতেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক দিন ধরে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ফিক্সড করে রেখেছিল। প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা। অথচ সে একই সময়ে কার্ব মার্কেটে প্রতি মার্কিন ডলার ১২০ থেকে ১২৩ টাকায় বিক্রি হতো। অর্থনীতিবিদগণ বারবার মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার কথা বললেও তাতে কোনো কর্ণপাত করা হয় নি। সরকার সমর্থক উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ি গোষ্ঠীকে তুলনামূলক স্বল্প মূল্যে মার্কিন ডলার যোগান দেবার জন্যই মূলত মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকায় ফিক্সড করে রাখা হয়েছিল। কার্ব মার্কেটে যেহেতু মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বেশি তাই প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডির মাধ্যমে তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করতেন। সাধারণ মানুষ ব্যাংকে গিয়ে নির্ধারিত রেটে মার্কিন ডলার ক্রয় করতে পারতেন না। কিন্তু সরকার সমর্থক ব্যবসায়ি গোষ্ঠী বিভিন্ন্ন কৌশলে চাপ প্রয়োগ করে মার্কিন ডলার বের করে নিতেন। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক আরো একটি মারাত্মক অপরাধ করে ব্যাংক আমানত এবং ঋণের সুদের হার ৬ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়ে। সরকার সমর্থক ব্যবসায়ি গোষ্ঠীর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতের উপর সুদের সর্বোচ্চ হার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের বেলায় ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যেনো ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে ফেভার করার জন্যই তৎপর ছিল। তা না হলে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের আমানতের উপর সুদের হার দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি কেনো নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল? বাংলাদেশ ব্যাংকের অসৎ উদ্দেশ্য প্রতীয়মান হয় আরো একটি সিদ্ধান্তের প্রতি দৃষ্টি দিলে। আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তাদের আমানতের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে পারতো। সে নিয়ম পরিবর্তন করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৫০ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় তখন একটি ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ছিল সোয়া ৮ শতাংশ। কোনো ব্যাংক সোয়া ৮ শতাংশ ব্যয় করে ফান্ড তৈরি করে কিভাবে তা ৯ শতাংশে বিনিয়োগ করে? সে সময় ব্যাংকগুলো ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু সরকারির ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালী গোষ্ঠী নানাভাবে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণের নামে হাতিয়ে নেয়। সে সময় এক মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। আর বাস্তবে অর্জিত হয় ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ একই সময়ে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছিল। কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছিল ১৪ শতাংশ করে। তাহলে এত বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ কোথায় গেলো? ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হতো তাহলে দেশে শিল্প-কারখানায় ভরে যাবার কথা। সরকারের মদদপুষ্ট এক শ্রেণির উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ি বিভিন্ন ভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করেছে। আনেকেই এই অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। ব্যাংকিং সেক্টর হচ্ছে বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক। কিন্তু বিগত সরকার আমলে ব্যাংকিং সেক্টর আতঙ্কের স্থানে পরিণত হয়েছিল। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে ব্যবহার বা বিদেশে পাচার করার সুবিধার্থে নানাভাবে প্রচলিত আইন পরিবর্তন করা হয়েছিল।

অন্তর্বর্তীকালিন সরকার গঠিত হবার পর বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে অর্থ লোপাট অনেকটাই কমেছে। আওয়ামী লীগ আমলে যারা সরকারি সহায়তায় ব্যাংক থেকে অর্থ লুটে নিচ্ছিল তারা এখন অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। এক শ্রেণির অর্থনীতিবিদ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে প্রচার করতেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটবে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাথমিকভাবে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি আরোপ করে। পরবর্তীতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজার ভিত্তিক করা হয়েছে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করার ফলে মুদ্রা বাজারে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বাজারে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১২২/১২৩ টাকায় উঠানামা করছে। এমনকি এ পর্যায়ে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১৭ টাকায় নেমে গিয়েছিল। সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে কিছু মার্কিন ডলার কিনে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এখন ব্যাংকিং চ্যানেল এবং কার্ব মার্কেটে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার অনেকটাই একই পর্যায়ে রয়েছে।

ব্যাংকিং চ্যানেলে এবং কার্ব মার্কেটে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার প্রায় কাছাকাছি হবার ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করছেন। গত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার এটাই প্রধান কারণ। রপ্তানিকারকগণও তাদের উপার্জিত অর্থ বিদেশে না রেখে দেশে নিয়ে আসছেন। এছাড়া বিগত সরকার আমলে যারা হুন্ডি ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই রাজনৈতিক কারণে এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। মূলত এসব কারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। তবে রেমিট্যান্স আরো বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা বিদেশে কাজ করেন তাদের অধিকাংশই সাধারণ শ্রমিক। তারা চাইলেই কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করতে পারেন না। কিন্তু হুন্ডি ব্যবসায়িরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের আবাসস্থলে গিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে থাকেন। বিদেশে বাংলাদেশের যেসব ব্যাংকের শাখা রয়েছে তারা যদি এজেন্টের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন তাহলে এ সমস্যা অনেকটাই সমাধান হতে পারে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করেন তার বেশির ভাগই বাড়ি-ঘর নির্মাণ, জমি ক্রয় ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ যদি দেশে শিল্প স্থাপনের জন্য ব্যবহার করা যেতো তাহলে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হতো। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।