কিছুদিন আগে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সমস্যা সম্পর্কে আলোচনাকালে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অত্যন্ত দু:খের সঙ্গে বলেছিলেন, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশে দু’টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল। এর মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যাকে আমরা সবাই চিনি। আর একটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থাকা বিশেষ একটি গোষ্ঠী যাদের নির্দেশনা ছাড়া ব্যাংকিং সেক্টরে কোন আইন প্রণীত এবং বাস্তবায়ন হতো না। দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত একজন ব্যবসায়ি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে উপদেষ্টা পদমর্যাদায় আসীন ছিলেন। মূলত তিনি এবং তার মতো আরো ১০/১২ টি শিল্পগোষ্ঠীর অঙ্গুলি হেলনে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে পরিচালিত হতো। ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আন্তর্জাতিক মানের আইন ছিল তা এই গোষ্ঠী তাদের স্বীয় স্বার্থে পরিবর্তন করে। পরিবর্তিত আইনগুলো প্রকৃত পক্ষে বৃহৎ ঋণ খেলাপিদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। বিগত সরকার আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এমন কিছু আইনি সংস্কার করে যা দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে কার্যত অচল করে দেয়। বর্তমানে আমরা ব্যাংকিং সেক্টরের যে দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করছি তার পেছনে এ গোষ্ঠী অবদান সবচেয়ে বেশি। প্রচণ্ড জনরোষে সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
তার আশে পাশে থাকা যেসব বিতর্কিত ব্যক্তি ব্যাংকিং সেক্টরকে ধ্বংসের জন্য দায়ি তারাও পালিয়ে গেছেন অথবা গ্রেপ্তার হয়ে জেলে অবস্থান করছেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থাকা সেই অদৃশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর নেই। কিন্তু বিগত সরকারের আমলের সে প্রভাবশালী গোষ্ঠী পর্দার অন্তরালে চলে গেলেও এখনো এখনো ব্যাংকিং সেক্টরে প্রভাব রয়ে গেছে। বিগত সরকার আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যেসব আইনি সংস্কার করে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল কিস্তি আদায় না করেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো। বাংলাদেশের একমাত্র অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল যিনি পেশাগত ব্যবসায়ি তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক টাকাও বাড়বে না। সবাই আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এমনভাবে আইনি পরিবর্তন সাধন করতে থাকলেন যাতে কিস্তি আদায় না করেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো যায়। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি।
অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের আমলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু তারপরও খেলাপি ঋণ আদায় এবং ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান অন্যান্য সমস্যা সমাধানে তেমন কোন অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। কিছু কিছু আইন এমনভাবে পরিবর্তন ও সংশোধন করা হয়েছে যা আগের চেয়েও খারাপ ফল দেবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি দু’টি আইনি সংস্কার সাধন করেছে। এর উদ্দেশ্য অনুধাবনযোগ্য নয়। পরিবর্তিত আইন দু’টি নিয়ে ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন, তাহলে কি বিগত সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে থাকা অদৃশ্য শক্তিই এখনো ব্যাংকিং সেক্টরে চালাচ্ছে?
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারিকৃত এক সার্কুলারের মাধ্যমে ২ শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্ট জমা দিয়ে দু’বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুন:তফসিলিকরণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে এমন সুযোগ কেনো দিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিগত সরকারের আমলে আ হ ম মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী থাকাকালে একবার খেলাপি ঋণ পুন:তফসিলিকরণের এমন সুবিধা দেয়া হয়েছিল। সে সময় তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। তৎকালিন অর্থমন্ত্রী সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সুবিধা দেবার জন্যই এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগে তাদের খেলাপি ঋণ পুন:তফসিলিকরণ করিয়ে নিয়েছিলেন। যারা তাদের ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ করিয়ে নিয়েছেন তাদের এখন আর ঋণ খেলাপি বলা যাচ্ছে না। তখন গ্রেস পিরিয়ড ছিল এক বছর আর এখন তা দুই বছর করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেন এমন একটি আইনি সংস্কার করতে গেলে, তাও আবার জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহুর্তে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাহলে কি বড় বড় ব্যবসায়ি-উদ্যোক্তা যারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান অথচ ঋণ খেলাপি তাদের বিশেষ সুবিধা দেবার জন্যই এটা করা হয়েছে? উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রচলিত নির্বাচনী আইন কোন ঋণ খেলাপি-বিল খেলাপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারেন না। বিগত সরকার আমলে ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর শর্তের কারণে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন সে উদ্যোগ সম্পর্কে আর কোন কিছু শোনা যাচ্ছে না। যারা তাদের মোট পাওনা খেলাপি ঋণের ২ শতাংশ এককালিন ব্যাংকে জমা দেবেন তাদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঋণ খেলাপি বলা যাবে না। যারা এ সুবিধা পাবেন তাদের প্রথম দুই বছর কোন কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না।
ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ পুন:তফসিলিকরণ কোন নতুন ঘটনা নয়। আন্তর্জাতিকভাবেও পুন:তফসিলিকরণ স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় ১৯৯১ সালে। সেই বছর ২০ মে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ১শ’ ৭১ জন বৃহৎ ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছিল। পরিকল্পনা ছিল পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ঋণ খেলাপিদের আরো তালিকা প্রকাশ করা হবে। সরকারের এ উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ব্যবসায়ীরা সরকারের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন বাধ্য হয়ে খেলাপি ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণের সুযোগ দেয়। প্রতিবার তিন বছর মেয়াদে মোট তিনবার খেলাপি ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ করা যেতো। প্রথমবার মোট খেলাপি ঋণের ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ব্যাংকে জমা দিতে হতো। ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ হচ্ছে পাওনা ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো বা কমানো। তবে ঋণ পরিশোধের সময় কমানোর জন্য আইনের প্রয়োজন হয় না। একজন ঋণ গ্রহীতা চাইলে যে কোন মুহুর্তে সময় নির্ধারিত সময়ের আগেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন। কাজইে ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ বলতে বাস্তবে আমরা বুঝি কোন ঋণ হিসাবে পাওনা কিস্তির অর্থ পরিশোধের সময় সীমাকে বাড়িয়ে নেয়া। বিভিন্ন সময় ঋণ খেলাপিরা তাদের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বার্ধিত করে নিয়েছেন। কিন্তু যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তাদের কোন সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি দ্বিতীয় যে আইনটি পরিবর্তন করেছে তা হলো খেলাপি ঋণ হিসাব অবলোপন বা রাইট অফ করার বিধান। ঋণ হিসাব অবলোপন বা রাইট অফ কথাটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে এমন একটি ভাবের উদয় হয় যেনো সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবের নিকট ব্যাংক তার পাওনা অর্থ মওকুফ করে দিয়েছে। আসলে বিষয়টি তা নয়। ব্যাংক যখন বুঝতে পারে একটি ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ তখন ব্যাংক তার ঋণ হিসাব ক্লিন দেখানোর জন্য সে ঋণ হিসাবের নিকট পাওনা অর্থ অন্য একটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে। তবে ব্যাংক কোনভাবেই সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবের নিকট পাওনা অর্থের দাবি ত্যাগ করে না। আগে নিয়ম ছিল কোন ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরপূর্বক শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে সেই ঋণ হিসাবটি অবলোপন করতো। তবে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের জন্য ব্যাংক সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়। কোন কিস্তি আদায় হলে তা সরাসরি ব্যাংকের প্রফিটে যুক্ত হতো। বিগত সরকার আমলে আ হ ম মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ঋণ হিসাব অবলোপনের নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়। সংশোধিত আইনে কোন ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ২ বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যেতো। ঋণ হিসাব অবলোপনের জন্য শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের শর্ত পারিহার করা হয়। ৫ লাখ টাকার কম খেলাপি ঋণ অবলোপনের জন্য কোন আদালতে মামলা দায়ের করার বিধান প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ঋণ হিসাব অবলোপনের বিধানটি আবারো সংশোধন করেছে। সংশোধিত নতুন আইনে কোন ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা অবলোপন করা যাবে। এ জন্য কোন প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে না। এমন কি কোন মামলা দায়ের করার প্রয়োজন হবে না।
ঋণ হিসাব অবলোপনের এ সংশোধিত বিধানের কারণে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ হিসাব অবলোপনের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এ ধরনের অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে কেন? বিগত সরকার আমলে কিস্তি আদায় না করেই কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান প্রশাসন পূর্বসূরিদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করছে। শুধু তাই নয়, আগের প্রশাসন যে সুবিধা দিয়ে সমালোচিত হয়েছিল বর্তমান প্রশাসন সে সুবিধা আরো বেশি মাত্রায় দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য কি তা বোধগম্য হচ্ছে না। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে ঋণ খেলাপিদের এ ধরনের সুবিধা কেন দেয়া হচ্ছে? তাহলে কি বাংলাদেশ ব্যাংক কোন বিশেষ মহলের চাপে বৃহৎ ঋণ খেলাপিদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্যই এমন উদ্যোগ নিয়েছে? এ মুহূর্তে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা না করে তাদের সুবিধা দিচ্ছে।
যারা নানা প্রতিকূলতা সত্বেও গৃহীত ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করে চলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের স্বার্থ রক্ষায় কিছু ভাবছে কী? ঋণ খেলাপিদের যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে তাতে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারিগণ হতাশ হতে বাধ্য। তারা যদি ঋণ খেলাপি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে চান তাহলে কাকে দোষ দেবো? নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারিগণ হতাশ হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হলে তার দায় কে নেবে? ক্ষমতা আছে বলেই তার অপব্যবহার কাম্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপীদের সুবিধা প্রদানের আগে যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন তাদের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধা দিতে পারে। যেমন, যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তাদের ঋণের উপর আরোপিত সুদের হার ২ বা ৩ শতাংশ কমিয়ে দেয়া যেতে পারে। বিগত দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ গ্রহীতাদের যেসব সুবিধা দিয়েছে তার প্রায় সবই দেয়া হয়েছে ঋণ খেলাপিদের। এ দায় বাংলাদেশ ব্যাংক কিভাবে এড়াবে?
লেখক : সাবেক ব্যাংকার।