আসিফ আরসালান
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে সমগ্র দেশবাসী যখন আলোচনায় মুখর তখন সুপ্রীমকোর্ট আরেকটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। সেটি হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনর্বহাল। সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে যে, ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগ ৪/৩ ভোটে যে রায় দিয়েছিলেন সে রায় গত ২০ নভেম্বর বুধবারের রায়ে সম্পূর্ণ বাতিল করা হলো। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই শেখ হাসিনার রাবার স্ট্যাম্প জাতীয় সংসদ ৫৫টি সংশোধনী সহ পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে। পক্ষান্তরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের ৭ সদস্যই সর্বসম্মতিক্রমে খায়রুল হকের ঐ রায় বাতিল করেন। এ রায় বাতিল হওয়ার সাথে সাথেই ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানে পুনর্বহাল হলো।
যেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলো তাই অনেকে ভাবতে পারেন যে, আগামী নির্বাচন কি কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হবে? যদি তাই হয় তাহলে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যত কী হবে? এবিষয়টিও পরিষ্কার করেছেন মাননীয় উচ্চ আদালত। রায়ের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেছেন এ্যাটর্নী জেনারেল আসাদুজ্জামান, অন্যতম বাদী সুজনের বদিউল আলম মজুমদার এবং জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী এ্যাডভোকেট শিশির মনির। তারা সকলেই বলেছেন যে, এবারের নির্বাচন অর্থাৎ আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে। এর ৫ বছর পর যে নির্বাচনটি হবে সেটি হবে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কেয়ারটেকার সরকার ফেরত আনার পক্ষে রায় দেন। কিন্তু সে রায়টি ত্রয়োদশ সংশোধনীর আংশিক পুনর্বহাল করেছিলো। সম্পূর্ণটা করেনি। উল্লেখ্য, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। হাইকোর্ট বিভাগ পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধান বিরোধী বলে মত দেন এবং ঐ দুটি ধারা বাতিল করেন। এখন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ সমগ্র ত্রয়োদশ সংশোধনীটিই পুনর্বহাল করলেন।
গত বুধবারের রায় ত্রয়োদশ সংশোধনীকে পুনর্বহাল করেছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণভাবে বাতিল হলো কি না সেটি পরিষ্কার হচ্ছে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর ৫ম তফসিলে রয়েছে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ। ষষ্ঠ তফসিলে রয়েছে ১৯৭১ সালের ২৬ জানুয়ারি শেখ মুজিবের বহু বিতর্কিত স্বাধীনতার ঘোষণা। ৭ম তফসিলে রয়েছে মেহেরপুরের আম্রকাননে গৃহীত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এ ৩টি বিষয়ে হয়তো পরবর্তীতে আইনি ও রাজনৈতিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল কোর্টের ফুল বেঞ্চ শুধুমাত্র ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহালই করেননি, অধিকন্তু সাবেক বিচারপতি খায়রুল হক কর্তৃক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ওপরও কঠোর মন্তব্য করেছেন। আপীল বিভাগ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় ছিলো কলঙ্কিত। আপীল বিভাগের রায়ে নানা ভুল ছিলো।
একটি দেশের বিচার বিভাগকে কিভাবে দলীয়করণ করা হয়েছিলো তার জ¦লন্ত প্রমাণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনর্বহাল এবং জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের বেকসুর খালাস। উল্লেখ করা যেতে পারে, শেখ হাসিনার আমলে জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তৎকালীন ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করা হয়। সুপ্রীমকোর্টও আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অতঃপর জামায়াত নেতা সুপ্রীমকোর্টে রিভিউ পিটিশন করেন। কথায় বলে, রাখে আল্লাহ মারে কে, মারে আল্লাহ রাখে কে। আজহারুল ইসলামের রিভিউ পিটিশন শুনানিতে বিলম্ব হয়। যদি সময় মতো শুনানি হতো তাহলে হয়তো তিনি আজ এ দুনিয়ায় থাকতেন না। রিভিউ পিটিশন শুনানিতে দেরী হওয়ার মাঝেই ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা খোলনলিচা সহ ভারতে পালিয়ে যান। পালিয়ে যান তার প্রধান বিচারপতি, অন্যান্য বিচারপতি এবং তার দলীয় চ্যালাচামুন্ডারা। সে রিভিউ পিটিশনের শুনানি হয় অবাধ মুক্ত নতুন বাংলাদেশে। নতুন বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের ফুল বেঞ্চ আজহারুল ইসলামকে শুধু মাত্র বেকসুর খলাসই দেননি, সাথে কিছু পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন।
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দিয়ে সুপ্রীমকোর্ট যে ৪টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সেগুলি হলো :
এক. এ উপমহাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি ও রীতিনীতি পাল্টে দেয়া হয়েছিলো।
দুই. সাক্ষ্য প্রমাণ এ্যাসেসমেন্ট ছাড়াই আজহারুল ইমলামকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছিলো।
তিন. নজিরবিহীনভাবে বিচারের নামে অবিচার করা হয়েছিলো।
চার. দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যেসব তথ্য প্রমাণ হাজির করা হয়েছিলো আগের আপিল বিভাগ সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।
এ ৪ পর্যবেক্ষনের পর এ্যাডভোকেট শিশির মনির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ও মন্তব্য করেছেন সেটিও সকলের জন্য প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, আমরা মনে করি সরকারের উচিত হবে এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর একটি রিভিউ বোর্ড গঠন করে অতীতের রায়গুলোকে পুনর্বিবেচনা করা, যেনো মৃত্যুপরবর্তীতে হলেও যাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে, তাদের পরিবার, তাদের দল ও এ দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পেতে পারে। এ রায় শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে আমরা মনে করি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সত্য বিজয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাভূত হয়েছে। এ রায়ের ফলে সিন্ডিকেটেড অবিচারের অবসান হয়েছে। তিনি আরো বলেন, জামায়াত-বিএনপির শীর্ষ ছয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। অন্তত পাঁচজন জেলে মারা গেছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল। তবে এটিএম আজহার সৌভাগ্যবান। তাকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন। এ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।
১৯ নভেম্বর বুধবার হাইকোর্টর একটি বেঞ্চ রায় দিয়েছেন যে, এখন থেকে জুলাই অগাস্টের গৌরবময় আন্দোলনকে ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে লিখতে হবে। হাইকোর্টর এ নির্দেশের সাথে কারোও দ্বিমত করার অবকাশ নাই। গত বছরের ৫ অগাস্ট জুলাই বিপ্লবের সমাপ্তির পর রাষ্ট্র ও সমাজের অনেক ক্ষেত্রে সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মিথ্যা পরাভূত হয়েছে। শেখ হাসিনার প্রথম মামলার রায় তার জ¦লন্ত প্রমাণ। এ মামলায় কোনো লুকোচুরি হয়নি। যেদিন চার্জশিট দাখিল করা হয় সেদিন সেটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। ভারত থেকে প্রচার করা হচ্ছে যে, শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অনুপস্থিতিতে বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে নাকি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। এসব বালখিল্য উক্তি হাসিনা-কামাল এবং ভারতীয়রা কিভাবে করেন সেটা ভেবে অবাক হতে হয়। তাদেরকে দেশে আসতে কেউ কি বাধা দিয়েছিলো? বরং বাংলাদেশের একাধিক খবরের কাগজে বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রচার করা হয় এবং একটি সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বাংলাদেশের হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টে কয়েক হাজার আইনজীবী আছেন। তাদের এক বা একাধিক আইনজীবীকে শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে নিযুক্ত করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিলো। তারা সে স্বাধীনতার সুযোগ গ্রহণ করেননি। তখন রাষ্ট্র নিজ ব্যয়ে একজন আইনজ্ঞ নিয়োগ করেন। বিচার ছিলো উন্মুক্ত। যে কেউ এসে প্রতিদিনের প্রসিডিংস দেখতে পারতেন। বেশ কয়েক মাস ধরে চলা এ বিচার কাজের আইনগত বৈধতা নিয়ে দেশে বা বিদেশে (একমাত্র ভারত ছাড়া) কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেন নাই। রায়ের পর বলা হয়েছে, রায়ের দিন থেকে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে হাসিনা এবং কামাল সুপ্রীমকোর্টে আপীল করতে পারেন। তো তারা দেশে এসে আপীল করেন না কেনো?
তাই ঐসব আবোল-তাবোল অভিযোগ করে তারা আসল উদ্দেশ্যকে ঢাকার চেষ্টা করছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ভারত ধরে রাখতে পারে না। বিশেষ করে যে দেশের সাথে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি রয়েছে। এ বন্দী বিনিময় চুক্তির অধীনে ভারত পশ্চিমবঙ্গে লুকিয়ে থাকা মুজিব হত্যামামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ক্যাপ্টেন মাজেদকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছিলো। ক্যাপ্টেন মাজেদকে বাংলাদেশে আনার পর সে রায় শেখ হাসিনা কার্যকর করেছেন। অর্থাৎ ক্যাপ্টেন মাজেদকে ফাঁসি কাষ্ঠে লটকানো হয়েছে। একই পদক্ষেপ শেখ হাসিনা এবং কামালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাদেরকে ভারত সরকার বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে পারে। তুলে দিলেই তো আর তাদের ফাঁসি হচ্ছে না। বাংলাদেশে ফেরত আসলে তারা তো সুপ্রীমকোর্টে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করতে পারেন। সে আপীলের ভবিষ্যত কী, সেটা তো কেউ জানে না। সুপ্রীমকোর্টে আপীল হবে। তারপরেও প্রয়োজন হলে সুপ্রীমকোর্টে রিভিউ হবে। সুতরাং শেখ হাসিনা ও কামাল বেশ কিছুদিন সময় পাবেন।
কিন্তু ভারত সেটি করবে না। হাসিনাকে তারা নিজেদের কব্জায় রেখেছে। সে সাথে প্রায় ১ লক্ষ আওয়ামী নেতাকর্মীকেও ভারতে আশ্রয় দিয়েছে। এরা সবাই এখন ভারতের হাতের পুতুল। এদেরকে পেলে-পুষে রাখা হচ্ছে। সময় মতো তাদেরকে ব্যবহার করা হবে। শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত তাদের অমূল্য সম্পদ বাংলাদেশ হারিয়েছে। বাংলাদেশ হারানো তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে যেমন বিরাট ক্ষতির কারণ তেমনি ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা বিরাট হোঁচট খেয়েছে।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ছাড়া ভারতের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। তাই যিনি যতো কথাই বলুন না কেনো, হাসিনাকে তারা ফেরৎ দেবে না। নিজেরা তাকে আটকে রেখে দোষটি বাংলাদেশে ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু ভারত ধরা পড়ে গেছে। তাদের চালবাজি সকলেই জেনে গেছেন। সুতরাং হাসিনাকে নিয়ে যত রকম মনগড়া কথাই ভারত বলুক না কেনো, তাতে বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।