ঈদ আনন্দের হলেও ঈদযাত্রাটা নিরানন্দের হয়; যখনই গাড়িতে বাড়ি যাওয়া-আসার কথাটা মাথায় আসে। ঈদের সময়ে এলে সরকার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বহু রকমের আশ^াস-প্রতিশ্রুতির কথা শুনানো হয়। বলা হয়, বহু প্লান পরিকল্পনার কথা। কিšুÍ দিন শেষে দেখা যায় যেই সেই। অর্থাৎ প্রতিবছর আনন্দের ঈদযাত্রায় শত শত মৃত্যুর বিষাদের খবর পাওয়া যায়।
২০২৪ সালের ঈদুল আযহায় দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩০৯টি দুর্ঘটনায় ৪৫৮ জন নিহত এবং ১৮৪০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলে ৩৩৭টি দুর্ঘটনায় ৪৮৮ জন নিহত ও ১৮৫০ জন আহত হন। (সূত্র: যাত্রী কল্যাণ সমিতি)। বিগত দশ বছরের পরিসংখ্যান টানলে একই ফলাফল আসবে। বরং দিন দিন এই দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে।
শুধু ঈদযাত্রা নয় ঈদযাত্রার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় সীমাহীন দুর্ভোগ। পত্রিকার পাতা ভরে খবর আসতে থাকে Ñমার্কেটিং, টিকেটিং, ভাড়া বৃদ্ধি, যানজট, দুর্ঘটনার কথা। এরপর প্রিয়জনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ আনন্দ। এরমধ্যেই শুনতে হয় শত শত মৃত্যু কিংবা হতাহতের মতো বিষাদের খবর। এরপর আবার বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরার যুদ্ধ। সেখানে আবারো আরেক দফা ভোগান্তি। এসব মিলেই আমাদের নগরবাসীর ঈদযাত্রা।
ঈদযাত্রার কথা এলে আরও যেসব বিষয় সামনে আসে তা হলো- টিকিট কালোবাজারি, যানজট, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জালনোট, সড়ক ও লঞ্চপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত-দেশের কোনো পথই ঘরমুখী মানুষের ঈদযাত্রার জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। সড়কপথ, নৌপথ ও রেলপথ ঈদের আগে কোথাও স্বস্তির কোনো চিত্র পরিলক্ষিত হয় না। নির্ঝঞ্ঝাট ও নিরাপদ ভ্রমণের প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ টিকিটের জন্য বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে ভিড় জমায়। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কাক্সিক্ষত গন্তব্যের টিকিট পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। মূলত অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ পন্থায় টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এ সময় মানুষকে উচ্চমূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য করা হয়।
মোটা দাগে বলতে গেলে আরও যেসব কারণে ঈদযাত্রায় প্রাণহানি ঘটে সেগুলো হলো ফিটনেসবিহীন গাড়ি, মোটর সাইকেলে করে দূরপাল্লায় যাত্রা, বেশি ভাড়ার কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাত্রী বহন, বেপরোয়া গতি এবং ঈদের সময় ছোট ছোট যানবাহন বিশেষ করে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া। এছাড়াও সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহনসহ নানা কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়।
বলা হচ্ছে, এবারের ঈদযাত্রা একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে শুরু হচ্ছে। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবারের ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে একটু বেশি তৎপরতা দেখাবে বলেই বিশ^াস জনগণের। অন্যান্য বছর ঈদ এলে যে অশুভ তৎপরতা লক্ষ্য করা যেত সেটা এবার হবে না বলেই মনে করে অংশীজনেরা। বলা হচ্ছে, এবার রাস্তাঘাটে চাঁদাবাজিটা থাকবে না। থাকবে না অযথা হয়রাণি জুলুম নির্যাতন। তবে একটু নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন পলিটিক্যাল পুলিশ আর এবারের পুলিশের আচরণে একটু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবার একটু চোখ ফেরাই ঈদে ঘরে ফেরা কিছু বাড়তি উদ্যোগের দিকে। এবার বলা হচ্ছে, এবছর ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ এড়াতে যমুনা সেতু পশ্চিম প্রান্ত থেকে উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
আসলে ঈদযাত্রায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পরে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। এজন্য এবছর বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ঈদযাত্রাকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে নির্মিত ১১টি উড়াল সেতুর মধ্যে ৯টি ও হাটিকুমরুল ইন্টারচেঞ্জের সার্ভিস সড়ক খুলে দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের চার লেন চালু হওয়ায় সুফল পাবে ঈদে ঘরমুখী মানুষ। ফলে বিগত সময়ে তীব্র যানজট দেখা গেলেও এবারের ঈদযাত্রা দুরর্ভোগমুক্ত ও স্বস্তিদায়ক হবে বলে আশা করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ এছাড়া যাত্রীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মহাসড়কের বিভিন্নস্থানে হাইওয়ে পুলিশের একাধিক টিক সার্বক্ষিণিক মোতায়েন থাকবে। এছাড়া হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা, যানজট নজরদারিতে সিসি ক্যামেরা ও ড্রোনের ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন ও লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি মহাসড়কে চলতে বাধা দেওয়ার ফলে বিগত বছরের ঈদযাত্রার মতো অসহনীয় যানজট এবার দেখা যাবে না। তাই উত্তরের ঘরমুখী মানুষের ঈদযাত্রা এক দশকের মধ্যে এবারই হবে সবচেয়ে স্বস্তির।
ঈদে রাজধানী ও অন্যান্য শহর থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ নাড়ির টানে পরিবার-পরিজনসহ গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। আসন্ন ঈদুল ফিতরেও এর ব্যতিক্রম হবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতি বছর ঈদ উৎসবের আগমুহূর্ত থেকেই ঘরমুখী মানুষের মনে নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হতে দেখা যায়। এমন নিরান্দ আসলে কবে দূর হবে তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। তবে দুর্ভোগ যে সঙ্গী হচ্ছে সেটা যেভাবে অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ অন্যান্য বছরের তুলনায় সার্বিক ব্যবস্থাপনা যে আহামরি কোন পরিবর্তন হয়েছে সেটা লক্ষ্য করা যায়নি। সরকারী বেসরকারী অফিস আদালতের ছুটিছাটার ক্ষেত্রে পরিকল্পিত কোন সিদ্ধান্ত; যা যানজোট নিরসনে সহায়তা করবে।
প্রতিবছর বিশেষজ্ঞরা নানা সুপারিশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু এগুলো নীতিনির্ধারকদের কাছে পাঠানো হয়। তারা এগুলো আমলে নেন বলে মনে হয় না। বোঝা যায় এগুলোকে তারা পরোয়া করেন না। অথবা এতগুলো মানুষের প্রাণহানি তারা গায়েই মাখেন না।
পরিশেষে বলতে চাই জীবিকার প্রয়োজনে ইট-কাঠের শহরে আবাস গড়লেও আমাদের সবার মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও অর্থাৎ নিজ গ্রামে। যেখানে রয়েছে মানুষের নাড়ির টান। বাড়ি বহুদূর হলেও ঈদের মধ্যে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হতে চায় সবাই। খুশিকে আরো পরিপূর্ণ করতে এবং আপনজনকে দেখার আকাক্সক্ষা মেটাতে পথের কষ্ট নিয়ে ভাবে না কেউ। যেভাবেই হোক ঈদে বাড়ি পৌঁছানো চাই! কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ঈদের আগে টিকিট পাওয়াটা যেন সোনার হরিণ পাওয়া। অনলাইনে টিকিট কাটার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, এক মিনিটের মধ্যেই যেন সব টিকিট গায়েব হয়ে যায়। স্টেশনে সারারাত অপেক্ষা করে টিকিট সংগ্রহের যে কষ্ট তা আপনজনের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে ক্ষণিকের মধ্যেই সেই কষ্টের কথা মানুষ ভুলে যায়। ঈদ মৌসুমে টিকিট কালোবাজারিরা স্টেশনকেন্দ্রিক বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যাত্রীদের কাজ থেকে আদায় করে নেয় অতিরিক্ত অর্থ। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিটি জেলায় রেলের টিকিটের ক্ষেত্রে কালোবাজারি চক্র সব সময় সক্রিয় থাকে, এদের হাত থেকে সাধারণ জনগণ কি কখনো মুক্তি পাবে না?
তবে আমাদেরও মনে রাখা উচিত, ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি’। কারণ একটু সচেতনতার অভাবে যে সর্বনাশ হয়ে যায়, তার জন্য পথে বসতে হয় একটি পরিবারকে। সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যায় একটি পরিবারের হাসিমাখা মুখ। অপেক্ষায় থাকা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ সবকিছু ভেবেই আমাদের উচিত হবে নিজ জায়গা থেকে সচেতনতার সঙ্গে বাড়ি ফেরা। প্রতি বছরই দেখা যায়, ঘরমুখো অতিরিক্ত যাত্রীদের চাপে সড়কে গণপরিবহন ও নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে। চাপ সামলাতে না পেরে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি গাড়ি ওঠানোর ফলে মাঝপথে ফেরিডুবির ঘটনায় শত শত মানুষ মারা যায়; যা রোজা কিংবা কোরবানির ঈদ এলেই দেখা যায়।
ঈদের সময় এলেই প্রতি বছরই ঘরে ফেরা হয় না এমন বহু মানুষের। তা ছাড়া দেখা যায়, যানজটের কবল থেকে রেহাই না পেয়ে স্বল্পপাল্লার গাড়িতে চড়ে ফেরি বা লঞ্চের পরিবর্তে স্পিডবোটে পার হয় অনেক যাত্রী। দ্রুততার সঙ্গে নদী পাড়ি দিতেই মূলত তারা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে। শেষ কথা হলো ঈদে যারা মাটির টানে ঘরে ফিরে যাবেন, যারা আনন্দ ভ্রমণে বের হবেন, তাদের সবার যাত্রা আনন্দময় ও নিরাপদ হোক। সবাইকে ঈদ মোবারক।
লেখক : সাংবাদিক।