॥ মো: রিশাদ আহমেদ ॥

পাড়ার আড্ডা ছিল একসময় গ্রামের বাঁশবাগান কিংবা শহরের গলির চায়ের দোকানের মতোই চিরচেনা। সন্ধ্যার বাতাসে গল্পের ঢেউ ছড়িয়ে যেতো, কারো হাসি ভেসে আসতো, কারো অভিমান আবার মুহূর্তেই গলে যেতো। যেনো এক অদৃশ্য সুতায় বাঁধা ছিল মানুষ-বয়স, পেশা, বা অবস্থানের ভেদাভেদ সেখানে বড় কিছু ছিল না। ঠিক যেমন নদীর দু’তীরকে বাঁধে একটি সেতু, তেমনি পাড়া ছিল আমাদের সমাজকে বেঁধে রাখার মূল সেতু। কিন্তু সে সেতুতে আজ ফাটল ধরেছে। মানুষের ব্যস্ততা আর প্রযুক্তির ঝড় সে আড্ডার বাতিঘরকে নিভিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে জীবনে পাড়া সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের জায়গা ছিল না, এটি ছিল এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়। নতুন কোনো খবর, উৎসবের আয়োজন, কিংবা বিপদের সময় সাহায্যের হাত-সবকিছুই শুরু হতো পাড়া থেকে। পাড়ার চায়ের দোকানে বসে রাজনীতি থেকে শুরু করে ক্রিকেট ম্যাচের স্কোর, এমনকি কারো সংসারের সমস্যাও আলোচনা হতো অবলীলায়। সেখানে ছিল পারস্পরিক বোঝাপড়া আর বিশ্বাসের অনন্য বন্ধন। আজকের দিনে সে সম্পর্কগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। মানুষ একই ভবনে থাকে, কিন্তু একে অপরের নামও জানে না।

সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরের ৭০ শতাংশ তরুণ তাদের পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, সেটাও জানে না। একইসাথে গ্রামের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই স্থানীয় মেলা, নাটক বা পালাগানে আগ্রহ দেখায় না। তারা সময় কাটায় মূলত মোবাইল ফোন, টিভি সিরিজ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়। সমীক্ষার আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো—যেখানে ২০ বছর আগে ৮০ শতাংশ মানুষ বলেছিল তারা প্রয়োজনে প্রতিবেশীর কাছে সাহায্য চেয়েছে, এখন সে সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৩০ শতাংশে। অর্থাৎ, মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে, ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে নিজের সমাজ থেকে।

এ পরিবর্তনের পেছনে কয়েকটি বড় কারণ কাজ করছে। প্রথমত, নগরায়ণ মানুষের জীবনকে ছোট ছোট ফ্ল্যাটে আটকে ফেলেছে। পাঁচতলা বা দশতলার ভবনে মানুষ কেবল নিজের দরজার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। একসময় যে উঠোনে একসাথে খাওয়াদাওয়া হতো, সেখানে এখনো জায়গার অভাব। ফলে মানুষ আর একত্রিত হয় না। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি মানুষের সময় কেড়ে নিয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স-এসব বিনোদনের মাধ্যম মানুষকে বাস্তবের আড্ডা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে ভার্চুয়াল জগতে। তৃতীয়ত, সমাজে বেড়েছে প্রতিযোগিতা আর অবিশ্বাস। আজকাল অনেকে মনে করে, পাশের মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বী। অর্থনৈতিক লড়াইয়ের এই সময়ে মানুষ তাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। চতুর্থত, পাড়ার ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। মেলা, যাত্রাপালা, কীর্তন বা রাসমেলা-এসব সামাজিক আয়োজন মানুষকে এক করতো। কিন্তু এখন এগুলো কমে এসেছে প্রচুর। আরেকটি কারণ হলো, অভিভাবকরা সন্তানদের নিরাপত্তার অজুহাতে বাইরে খেলতে দিতে চান না। ফলে শিশুদের খেলাধুলা সীমিত হয়ে গেছে টিভি বা মোবাইল গেমসে। শিশুদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ও শিখন হতো পাড়ার খেলায়, তা আর হচ্ছে না।

তবে এ সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান নেই, তা বলা ভুল হবে। প্রথমেই প্রয়োজন সচেতনতা। মানুষকে বুঝতে হবে যে সামাজিক বন্ধন ছাড়া একা বাঁচা যায় না। পরিবার ও প্রতিবেশীকে একসাথে সময় দেওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজকর্মীদের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি এলাকায় বছরে অন্তত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যেখানে সবাই মিলিত হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে। স্কুল-কলেজে পাড়াভিত্তিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা বা ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজন করলে তরুণ প্রজন্ম পাড়া সংস্কৃতির গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করবে। চতুর্থত, প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ দোষারোপ না করে একে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা দরকার। স্থানীয় পাড়ার জন্য ফেসবুক গ্রুপ বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে, যা মানুষকে আবার বাস্তবে একত্রিত হতে উৎসাহিত করবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিরাপদ খেলার মাঠ তৈরি করা। মাঠ থাকলে শিশুরা আবার পাড়ার আড্ডা ও খেলায় ফিরবে।

আমার মতে, পাড়া সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া মানে কেবল কয়েকটি অভ্যাস বা বিনোদন হারিয়ে যাওয়া নয়। এটি মানে হলো মানুষের সম্পর্কের ভাঙন। সমাজ তখনই শক্তিশালী হয়, যখন মানুষ একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে। আমরা যদি কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য ও আরামকে গুরুত্ব দিই, তবে শেষমেশ একাকিত্ব আমাদের গ্রাস করবে। পাড়া সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা মানে কেবল পুরনো ঐতিহ্যকে বাঁচানো নয়, বরং নতুন প্রজন্মকে একত্রিত হওয়ার আনন্দ শেখানো। একসময় যে উঠোনের গল্প, মেলার হইচই, কিংবা চায়ের দোকানের তর্ক-বিতর্ক আমাদের সমাজের প্রাণ ছিল, সেটাকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে।

আজকের শিশু যদি পাড়া বন্ধু না পায়, কালকের সমাজ পাবে না একত্রিত হওয়ার অভ্যাস। তাই এখনই দরকার সবাইকে নিয়ে নতুন করে সেতু গড়াÑযেখানে মানুষ শুধু চার দেয়ালের ভেতর নয়, বরং প্রতিবেশীর সাথে ভাগাভাগি করবে সুখ-দুঃখ। পাড়া সংস্কৃতি হয়তো কিছুটা পিছিয়ে গেছে, কিন্তু চাইলে আবারো জাগ্রত করা সম্ভব। মানুষই তো মানুষকে টানে, আর সম্পর্কই তো জীবনকে অর্থ দেয়। পাড়া সংস্কৃতি তাই বিলুপ্তির পথে নয়, বরং আমাদের হাতেই আছে এর পুনর্জন্মের চাবিকাঠি।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।